“উত্তিষ্ঠত নিবোধত কবিতা” রবীন্দ্রনাথের পরিণত-পর্বের প্রেরণামূলক রচনা, অন্তর্ভুক্ত পরিশেষ (১৯৩২) কাব্যগ্রন্থে। কবিতাটি সম্বোধিত শ্রীমতী রমা দেবী-কে জন্মদিনের উপলক্ষে; তবে বার্তাটি সর্বজনীন—উপনিষদের মন্ত্র “উত্তিষ্ঠত, নিবোধত” (উঠো, জাগো, জ্ঞানলাভ করো)–র আধুনিক প্রতিধ্বনি। এখানে জীবনকে ভোগ বা খেলার নয়, দায়িত্ব ও সাধনার পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কবি বলেন, নিজের অন্তরের দীপ জ্বেলে অন্ধকার পথ আলোকিত করতে হবে, অসত্যের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে সত্যলক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে, দুঃখ স্বীকার করে জীবনের “বীণাতন্ত্রে” বেসুরকে সুরে আনতে হবে। জন্মদিন তাই কেবল উৎসব নয়—স্ব-শুদ্ধি, শপথ ও কর্তব্যজাগরণের দিন।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কাব্যগ্রন্থ: পরিশেষ
কবিতার নাম: উত্তিষ্ঠত নিবোধত
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশকাল: ১৯৩২
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: প্রেরণামূলক, আধ্যাত্মিক, নৈতিকতা ও জীবনদর্শন
উত্তিষ্ঠত নিবোধত – কবিতার পাঠ
কল্যাণীয়া শ্রীমতী রমা দেবী
আজি তব জন্মদিনে এই কথা করাব স্মরণ —
জয় করে নিতে হয় আপনার জীবন মরণ
আপন অক্লান্ত বলে দিনে দিনে; যা পেয়েছ দান
তার মূল্য দিতে হবে, দিতে হবে তাহারে সম্মান
নিত্য তব নির্মল নিষ্ঠায়। নহে ভোগ, নহে খেলা
এ জীবন, নহে ইহা কালস্রোতে ভাসাইতে ভেলা
খেয়ালের পাল তুলে। আপনারে দীপ করি জ্বালো,
দুর্গম সংসারপথে অন্ধকারে দিতে হবে আলো,
সত্যলক্ষ্যে যেতে হবে অসত্যের বিঘ্ন করি দূর,
জীবনের বীণাতন্ত্রে বেসুরে আনিতে হবে সুর–
দুঃখেরে স্বীকার করি; অনিত্যের যত আবর্জনা
পূজার প্রাঙ্গণ হতে নিরালস্যে করিবে মার্জনা
প্রতিক্ষণে সাবধানে, এই মন্ত্র বাজুক নিয়ত
চিন্তায় বচনে কর্মে তব — উত্তিষ্ঠত-নিবোধত।
ভাবার্থ
এই কবিতায় কবিগুরু জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্তব্য সম্পর্কে গভীর প্রেরণা দিয়েছেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে জীবন শুধুমাত্র ভোগ বা খেলা নয়—এটি একটি গুরুদায়িত্বপূর্ণ যাত্রা, যেখানে সত্যকে ধারণ করতে এবং অসত্যকে দূর করতে হবে। জীবনকে দীপশিখার মতো জ্বালিয়ে নিজের ও অপরের পথ আলোকিত করতে হবে। দুঃখ, কষ্ট ও অনিত্যতার মধ্য দিয়ে গিয়েও জীবনকে নির্মল ও সুরেলাভাবে গড়ে তোলাই মানুষের প্রকৃত সাধনা। “উত্তিষ্ঠত-নিবোধত” মন্ত্রের মাধ্যমে কবি আহ্বান জানিয়েছেন—উঠে দাঁড়াও, সচেতন হও এবং সৎপথে অগ্রসর হও।
শব্দার্থ
উত্তিষ্ঠত-নিবোধত: উঠো, জাগো, সচেতন হও। (সংস্কৃত মন্ত্র, উপনিষদ থেকে উদ্ভূত)
অক্লান্ত: যে ক্লান্ত হয় না; অবিচল।
দুর্গম: কঠিন বা দুঃসাধ্য।
বীণাতন্ত্র: বীণার তার; জীবনের সূক্ষ্ম সুরের প্রতীক।
আবর্জনা: অপ্রয়োজনীয় ও নিকৃষ্ট বস্তু।