বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ ও সমালোচনা ধারার প্রখ্যাত লেখক কুমারশঙ্কর বাগচী তাঁর গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সাহিত্যপ্রীতি ও নিখুঁত ভাষাশৈলীর জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত। সমকালীন সাহিত্য থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যবাহী সাহিত্যভাণ্ডার পর্যন্ত তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে সুগভীর পাঠদৃষ্টি ও মননশীলতা। প্রবন্ধ, সাহিত্য-সমালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন সাহিত্যকর্মের নানামাত্রিক ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে কুমারশঙ্কর বাগচী ব্যক্তিগত অনুভূতি ও গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণের সমন্বয়ে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর দৃষ্টিতে। শৈশব থেকে পাঠ-অভিজ্ঞতা, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক বহুমাত্রিকতা, তাঁর দর্শন, এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের ওপর তিনি যে আলোকপাত করেছেন, তা পাঠকের কাছে একাধারে তথ্যবহুল ও আবেগময় হয়ে উঠেছে। এই লেখা হয়ে উঠেছে এক সাহিত্যসমালোচকের চোখে দেখা ও হৃদয়ে ধারণ করা রবীন্দ্রনাথের মনোজগৎ অনুসন্ধানের অন্তরঙ্গ দলিল।
‘আমার ও মার রবীন্দ্রনাথ’—এই নিয়ে লিখতে হবে শুনে প্রচণ্ড উত্তেজনা ও ভয় মানবকুলের অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন তাঁকে আমার রবীন্দ্রনাথ বলে ভাবলে শিহরিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও তাঁরই কথায়—
‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহান তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারংবার।’
এই মহত্বের শিক্ষায় আমার বড় হয়ে ওঠা এবং আজকের আমি পুরোপুরি তাঁর বন্ধনে বাঁধা।
কবি রবীন্দ্রনাথ, ছোট গল্পের রবীন্দ্রনাথ, উপন্যাসের রবীন্দ্রনাথ, প্রবন্ধের রবীন্দ্রনাথ, গানের রবীন্দ্রনাথ— সব কিছু ছাপিয়েও মানুষ রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে অনেক বড়। হয়তো বা আকাশের চেয়েও বড়। যখনই কোনও কারণে দুশ্চিাত্তগ্রস্ত। হই, তাঁর লেখা কোনও কবিতা বা গানে আমার মানসিক অস্থিরতার সমাধান খুঁজে পাই। কখনও বা ভীষণ আনন্দে বেসুরে তাঁর গান গেয়ে উঠি। গভীর দুঃখেও তিনি।
একমাত্র সান্ত্বনার জায়গা। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। যখন কোনও বাড়ির নকশা করি, ভাবতে থাকি ঘরে কোথা দিয়ে আলো ঢুকবে, বাতাস ঢুকবে আমাদের প্রথাগত পড়াশোনা, শিক্ষা দিয়ে বিচার করে তৈরি হয় নকশা। কিন্তু যখনই বিশ্বকবির সৃষ্টি ‘শ্যামলী’ বাড়িটিকে দেখি, যে বাড়ির দেওয়াল মাটি দিয়ে তৈরি এবং প্রথমদিকে বাড়ির ছাদও ছিল মাটির—অবাক হয়ে যাই।
ওই বাড়িতে যাঁরা থাকবেন, গ্রীষ্মের গরমে যাতে তাঁদের কষ্ট না হয় সেই জন্য কবি দেওয়ালের ভিতর মাটি খুঁড়ে পরপর সাজিয়ে একটা বাতাসের আস্তরণ তৈরি করেছিলেন। তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার এই অভিনব ভাবনা, আজও যে-কোনও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাছে শিক্ষণীয়। কবি বলেছিলেন, ‘আমি গরিব মানুষ, মাটির কুঁড়েঘরই আমার ভালো। আর দুদিন পরে তো মাটিতেই মিশব–সম্বন্ধটা এখন থেকেই ঘনিষ্ঠ করে রাখি।’
ওঁর সৃষ্টির সঙ্গে ওঁর বাসস্থান নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। যখনই ওঁর মনে হয়েছে, সৃষ্টির কাজে বাড়ির বা ঘরের দিক থেকে কোনও বাধা আসছে, তা পরিকল্পনা বা অবস্থান যে কারণেই হোক না কেন, সঙ্গে সঙ্গে সে বাড়ি বা ঘর পালটে ফেলতেন।
আমরা রানি চন্দের লেখায় দেখতে পাই উনি যখন ‘কোনার্ক’ বাড়িটিতে থাকতেন, তার পশ্চিম দিকের বারান্দায় কবি বিকেলবেলায় বসতেন ডুবন্ত সূর্যের আভা ও সৌন্দর্যকে দেখার জন্যে। একদিন ওঁর মনে হল ওই বারান্দায় বসে সূর্যাস্ত দেখার অসুবিধা হচ্ছে কারণ বিকেলের দিকে বড্ড বেশি রোদ থাকে।
উনি সঙ্গে সঙ্গে সুরেনবাবুকে ডেকে (যাঁকে উনি সুরেন সাহেব বলে ডাকতেন) বলেন ওই বারান্দার বাইরে থেকে পিলার করে ছাদ করে দিতে। যাতে রোদ না আসে। কিছুটা দেওয়াল আর তার ওপর কাচের জানালা। কিছুদিন কবি মহা আনন্দে ওই বারান্দায় বসে সূর্যাস্ত দেখলেন ও সবাইকে তাঁর ছবি আঁকা দেখালেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর আবার সুরেনবাবুর ডাক পড়ল। আদেশ হল, পশ্চিমের বারান্দায় খুব গরম হয়, তাই আর চারটি পিলার তুলে ছাদ ঢেলে একটা এল শেপ-এর ঘর তৈরি হোক। কবির কথামতো ঘর তৈরি হল। এবার কবি খুব খুশি। সবাইকে ডেকে ঘর দেখাতে লাগলেন এবং বললেন, ‘এবার আমার একটা প্রাইভেসি এল।’
ওই ঘরের আসবাবপত্র সব সিমেন্টের ছিল, মায় খাটসমেত। সেই খাটে কম্বল পেতে কবি ঘুমোতেন। কিছুদিন পরে পশ্চিমের বারান্দার এই ঘরের মায়া ছেড়ে ‘উদয়ন’-এ উঠে এলেন ওঁর বউমার কাছে। যখন তিনি তৈরি করলেন ‘শ্যামলী’—সেই মাটির বাড়িটি যার কথা আগে বলেছি। ওই বাড়িতে প্রথম এসে রাত কাটিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধি।
এরপর উনি তৈরি করলেন ‘পুনশ্চ’। যে বাড়ির বারান্দায় বসে উনি দূর দিগন্ত, শালবীথি, মাধবীলতা কুঞ্জ এবং বসন্তে শিমূল ফুলের রং-এর জৌলুস দেখতে পেতেন। কত গান, কবিতা তিনি পুনশ্চের বারান্দায় বসে লিখেছেন। তবে সেখানেও কবি কিছু দিনের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠলেন। তখন তৈরি করলেন উদীচী’। এবং সেখান থেকেই উনি শেষযাত্রা করলেন কালিম্পং-এর উদ্দেশ্যে।
শান্তিনিকেতনে যখন জলের ভীষণ কষ্ট, রবীন্দ্রনাথ তখন আমেরিকা থেকে টিউবওয়েল আনিয়ে অমূল্য বিশ্বাস মহাশয়কে দিয়ে মাটির তলা থেকে জল তুলে জলকষ্ট দূর করেছিলেন। তাই ভাবি, কবি কোন দিকে ছিলেন বলুন তো! এসব সৃষ্টির মধ্যেও ঈশ্বরের প্রতি কবির যে টান তা কিন্তু প্রতিনিয়ত তাঁর হৃদয়ে বেজে উঠত। তার পরিচয় আমরা তাঁর পূজা পর্যায়ের সবক’টি গানে, কবিতায় ও অন্যান্য লেখাতে পাই।

কবির এই বারবার বাড়ি পরিবর্তন আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। যিনি সৃষ্টিতে মগ্ন, তিনি কখনওই একই ঘরে বসে তাঁর সৃষ্টির পূর্ণতা পেতে পারেন না। তাই তিনি কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, লেখালেখি করতে একই ঘরে হাঁপিয়ে উঠতেন এবং বারবার ঘর পরিবর্তন করতেন। এই রবীন্দ্রনাথ আমার ভীষণ প্রিয়। এই আপাত ছেলেমানুষ বা শিশুমনের রবীন্দ্রনাথ আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করে। তাই ওপরের কথাগুলি আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে ছোটবেলায় প্রথম যিনি রবীন্দ্রনাথকে চিনতে শিখিয়েছিলেন, তিনি আমার মা।
কোচবিহারের এক সাবডিভিশনে আমার জন্ম। আমি তখন খুব ছোট। পুজো বা গরমের ছুটি হলেই মায়ের আদেশ ছিল রোজ সকালে রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতার এক পংক্তি মুখস্থ করে তারপর খেলতে যাওয়া। ছোট থেকেই আমি পিতৃহীন। মায়ের কাছেই বড় হয়েছি। রাতে যখন মায়ের কাছে ঘুমোতে যেতাম, উনি কিন্তু প্রথমেই বলতেন, ‘আজ কোন কবিতার পংক্তি পড়লে বাবা, একবার বল!’ যখনই দেখতেন যে সেই পংক্তিটি মুখস্থ হয়নি, তখন শাস্তিস্বরূপ আদেশ হত যে, পরেরদিন ওইটি এবং আরও একটি পংক্তি মুখস্থ করতে হবে। রাতে মা কিন্তু নিয়ম করে পরীক্ষাটি নিতেন।
আমার মায়ের এই আদেশ যা তাঁর বোধের থেকেই এসেছিল, আমাকে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সৃষ্টির দিকে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট করেছে। এখন বুঝি, যদি রবীন্দ্রনাথকে ওইভাবে না পড়তাম, তা হলে হয়তো আজ এত দূর পথ পাড়ি দিতে পারতাম না। কোচবিহারের স্কুল জীবনে আমাদের কারও বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। হ্যারিকেন বা কুপির আলোয় পড়াশোনা করতাম। বাড়ি থেকে বেশ দূরে বাজারে ব্যাটারিচালিত রেডিয়ো ইত্যাদি বিক্রি হত। সেখানে ওই দোকানের মালিক রোজ বিকেলে মাইকে গান বাজাতেন। তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা বড় জায়গা ছিল।
স্কুল শেষ হওয়ার পরে ছুটে চলে যেতাম শুধু গান শোনার জন্য। তখনই বুঝতে পারতাম আমার অজান্তেই রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার মনে কতটা ভালোবাসার এবং শ্রদ্ধার জায়গা করে নিয়েছে। আজও ছুটি থাকলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনব না বা রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতা পড়ব না, এমনটা হয় না কখনও। সোভিয়েত রাশিয়া বা চিনের বিপ্লব নয়, কবির কাছ থেকে পেয়েছি ‘আলো-আঁধারির’ বিপ্লব।
একবার শান্তিনিকেতনের আশ্রমে মিসেস মার্গারেট আয়েঙ্গার এসেছিলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে। মার্গারেট বলেছিলেন, সবারই দুটি কি তিনটি মাত্র সন্তান হওয়া উচিত। পিতামাতার যা ভালো ভালো গুণ, ভালো স্বাস্থ্য—সর্বপ্রথমে বড় সন্তান পায়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তানও পায়। তারপর সব কিছুই কমতে থাকে। বেশি সন্তান হলে শেষের দিকের সন্তানরা মা-বাবার ভালোটার কিছুই পায় না। কবি শুনে মৃদু হেসেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আমি পিতামাতার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।’
ঘটনাচক্রে আমিও আমার মায়ের শেষ সন্তান। তবু মায়ের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি। এ আমার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি। সে দিন আমার খুব কাছের একজন মানুষ এসেছিলেন। তিনি হঠাৎ আমার খুব প্রিয় একটি গান গাইলেন—
“আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত।”
শুনতে শুনতে আমি চোখের জল আটকাতে পারিনি।
আজ বাংলাদেশের যেখানে তাঁর চিহ্ন আছে সেখানেই রবীন্দ্রস্মৃতিকে ধারণ করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি, পতিসর। ইদানীং খুলনা শহরের কাছাকাছি দক্ষিণদিহিতে তাঁর শ্বশুরকূলের স্মৃতিকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে সংরক্ষণাগার, সরকারি উদ্যোগে। এক সময় পতিসরে নদীপথে তো যেতে হত, তাই পথটাও ছিল বেশ কষ্টকর, দুর্গমই বলতে হত, কিন্তু আজ সেখানেও যেতে নেই কোনও অসুবিধে। সবার আমন্ত্রণ সবখানে।
বর্তমান গণতান্ত্রিক মহাজোট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ায় রবীন্দ্র ভাবনার জগৎটাও প্রসারিত হয়েছে। আগেও রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হত সাড়ম্বরে পাড়া-মহল্লায়, স্কুল-কলেজে—–নানা বিদ্যাপীঠে। শিলাইদহে হত আগেও কিন্তু প্রথম তত্ত্ববধায়ক সরকার এল বাংলাদেশে, তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল ঢাকার বাইরে রবীন্দ্রজয়ন্তী বিশাল আকারে সরকারিভাবে করতে।
রবীন্দ্রপ্রেমী বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেড়শো বছর জন্মের বার্ষিকী উদযাপন করবে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারি পর্যায়ে এবং যৌথভাবে। কী অনন্য সিদ্ধান্ত। এখন থেকেই তুমুল উদ্যোগ শুরু হয়েছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তো বটেই, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। প্রতি জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে এ কর্মোদ্যোগ।
লেখক বিশিষ্ট উদ্যোগপতি কুমারশঙ্কর বাগচী