বাংলা সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে সুপরিচিত বাচিকশিল্পী ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক গৌতম ঘোষদস্তিদার বহু বছর ধরে কণ্ঠশিল্পের মাধ্যমে কবিতা ও সাহিত্যকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। নিখুঁত উচ্চারণ, আবেগময় কণ্ঠস্বর এবং সংবেদনশীল পরিবেশনার জন্য তিনি আবৃত্তিশিল্পে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেছেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, রেডিও ও টেলিভিশনে তাঁর পরিবেশনা শ্রোতা ও দর্শকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। কবিতা পাঠের পাশাপাশি তিনি আবৃত্তি চর্চা ও শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে গৌতম ঘোষদস্তিদার প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ও শিল্পীজীবনে রবীন্দ্রনাথের গভীর প্রভাব। এখানে তিনি বর্ণনা করেছেন, কীভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও ভাবনা তাঁর কণ্ঠে সুর ও আবেগের সমন্বয়ে নতুন অর্থ পেয়েছে এবং কীভাবে তাঁর শিল্পসাধনা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির আলোয় পথ দেখেছে। পাঠকের কাছে এই নিবন্ধ হয়ে উঠবে এক বাচিকশিল্পীর কণ্ঠে ধরা রবীন্দ্রনাথের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

“আমি যেন দাঁড়িয়ে আছো এক একাকী নদীর পারে। একটু আগে তুমি এসে পৌঁছেছ এই তীরে। তোমার সঙ্গে এই প্রথম নির্জনে দেখা হবে কোনও নতুন নারীর। তাই তুমি বেলা পেরিয়ে কথামতো এসে দাঁড়িয়েছ এই নদীতটে। দীর্ঘ অপেক্ষমান তুমি দেখলে, হঠাৎই, নদীর সঙ্গে আকাশের এক নীরব মিলন ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনে। ফাল্গুনের নীল ঝকঝকে আকাশ নেমে আসছে তরঙ্গিত নদীর বুকের ওপর। যেন, কোনও স্তব্ধ প্রণয়িণীর বুকের আঁচল সরিয়ে এখনই ঠোট নামাবে অধীর প্রেমিক। অন্তত, তোমার তেমনই মনে হল।
তুমি দেখলে, নদীর বুকে পড়েছে আকাশের নিবিড়তর নীল ছায়া। অতর্কিতে আবছায়া নেমে এল নদীর মৃদু-তরঙ্গিত জলে। আর, একটি শীর্ণ ডিঙিনৌকা সেই জলের ওপর ফুটে উঠল যেন এই দৃশ্যকে পূর্ণতা দেবে বলে। নৌকোর দোলা নয়, তোমার মনে হল, সম্পূর্ণ নদীটিই যেন দুলে উঠল তোমার চোখের সামনে। সেই দোল লাগল তোমার গহনেও।
তুমি নিকটবর্তী নৌকোর পাটাতনে হলুদ শাড়ির অলঙ্কৃত আঁচল ধ্বজার মতো উড়তে দেখলে বাতাসে। ওই আঁচলের ওড়ার তুমি দেখতে পেলে বাতাসকেও। তোমার মনে হল, আঁচল নয়, তোমার চোখের সামনে উলটে গেল কোনও পবিত্রতম বইয়ের পৃষ্ঠা। তুমি চোখ বুজে বইটাকে চিনতে চাইলে। তোমার স্পষ্ট মনে পড়ল না। পরিবর্তে, তোমার ভিতরে বেজে উঠল, এক আশ্চর্য গান, তুমি শুনলে, ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,/ বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’।
তুমি কি বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হলে চকিতে। তোমার তো ইতিমধ্যে মনে পড়েই গেছে, গানটি ধারণ করে আছে যে-বইটি, তাঁর নাম। মনে মনে সেই মহাগ্রন্থটির সর্বনামে নিজের অগোচরেই তুমি একটি চন্দ্রবিন্দু আরোপ করলে। আর, গীতাঞ্জলির মলাট উলটে গেল তোমার চোখের সামনে। তুমি গানটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলে। তোমার কণ্ঠে সুর নেই একটুও। অথচ, তুমি টের পেলে, তোমার ভিতরে কে অবিরল গেয়ে চলেছে গানটি। গানটির প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে শুনছ তুমি।
কিংবা, আগে কখনও তুমি শোনোনি এই গানটি, আজই প্রথম শুনছ। অথচ, তুমি জানো, গানটি কোথাও গাইছে না কেউ। তা বেজে চলেছে তোমার নিজের ভিতরে, নির্জনে। তোমার সামনে থেকে নদী মুছে গেল, আকাশ মুছে গেল, নদীজল আকাশনীল তরঙ্গ মুছে গেল, এমনকী মুছে গেল সেই হলুদ আঁচলও। তুমি গানটির সঙ্গ নিলে।
আসলে, তোমার সামনে তো আদপে কোনও নদী ছিলও না। তুমি মনে মনে সেসব বানিয়ে নিয়েছিলে। বসিয়েছিলে কাগজে। এখন যখন পেয়ে গেলে একটি পরিপূর্ণ গানের সন্ধান, তখন তোমার আর কোনও অনুষঙ্গ, আর কোনও পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজন রইল না। তুমি সেই গানটির সঙ্গী হলে অনায়াসে।
তুমি সেই গানটির আশ্রয় পেলে। তুমি সেই গানটিকেই ধ্রুব মানলে। পারিপার্শ্বিক তখন যেন তুচ্ছ হয়ে গেল তোমার কাছে। তুমি নিজের ভিতরে কান পেতে শুনলে, ‘এ যে তব দয়া জানি জানি হায়, / নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়, / পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন / তব মিলনেরই যোগ্য করে। আধা ইচ্ছার সংকট হতে / বাঁচায়ে মোরে।’
গান শেষ হতে তুমি বোধ করলে এক নিরবচ্ছিন্ন একাকিত্ব। তোমার সামনে গানটি মেলে ধরল নিজেকে কোনও অলীক ঈশ্বরীর মতো। তুমি সেই গানের বিধুর পেখম দেখতে পেলে অবিকল। তোমার ভিতর নিমেষে জেগে উঠল এতদিনের সব প্রাণপণ বাসনা, বঞ্চনার মায়াময় অনুষঙ্গ—সব। কিন্তু, তুমি যেন আজ সব নতুন করে দেখলে, নতুন করে অনুভব করলে, তোমার সামনে সব সঞ্চিত বেদনা অপরূপ উন্মোচিত হল।
গানের বাণী আর সুর তোমার মতো এক শঠ, অবিশ্বস্ত, মিথ্যাচারীকেও যেন এক পবিত্রতার সন্ধান দিয়ে গেল, দিতে থাকল। বঞ্চনা যে এমন অভিপ্রেত হতে পারে তা তুমি এই প্রথম বুঝলে। জীবনের এই সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তুমি নতুন করে বুঝলে, এই গান কোনও সাধারণ মানুষের রচনা হতে পারে না, প্রকৃতপ্রস্তাবে কোনও মানুষেরই রচনা হতে পারে না। তোমার যেমন চিরকালই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ নামে কোনও মানুষ আদপে কখনও ছিলেন না এই মর-পৃথিবীতে। রবীন্দ্রনাথ আদৌ কোনও মানুষ হতে পারেন না।
গ্রহ্যস্তর থেকে এসেছিলেন কেউ, এসে লিখে দিয়ে গিয়েছেন এইসব নিয়তিলেখা। কিংবা, এইসব গান প্রণীত হয়েছে কোনও ঈশ্বরেরই লেখনীতে। আর, সেইসব ঐশ্বরিক গান নিয়ে সূর্য-চন্দ্রের মতো এই একশো বছর পরেও জেগে আছে দুটি অবিনশ্বর গ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলী’ আর ‘গীতবিতান’।
তোমার মতো অধার্মিকের কাছে আজও সে-গ্রন্থ দুটিকে মহান ও পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ বলেই মনে হয়। বেদনায়, বিস্ময়ে, বিষাদে, বিরহে, অভিসারে, আশ্লেষে, বিচ্ছেদে সেই গ্রন্থ দুটি আজ তোমার এক পরম পরিত্রাণ হয়ে উঠল। তুমি এক কল্পিত নদীতটে, কল্পিত জলের কাছে, কল্পিত আকাশের নীচে এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব হয়ে পৃষ্ঠা ওলটাতে চাইলে সেই দুটি বইয়ের।
না, শেষে একটি সরিয়ে রেখে, ওই আকস্মিক গানের অনুষঙ্গে, তুমি বেছে নিলে এই গীতাঞ্জলিকেই। তুমি ভুলে গেলে বইটির আন্তর্জাতিক মাহাত্ম্য, তাঁকে ঘিরে কত শত গুণিজনের অনেকানেক স্তব, তর্পণ। তোমার সামনে অবিরল পৃষ্ঠা উলটে যেতে থাকল বইটির। তুমি ভুলে গেলে পরিপাশ। এক গহন তোমাকে অধিকার করে নিল।
তুমি তখনও গীতাঞ্জলির ওই দ্বিতীয় গানটি থেকে নিস্তার পাওনি। তুমি ভাবতে থাকলে, ঠিক কী বলল গানটি। যাকে প্রাণপণে চাওয়া হচ্ছে, তার বঞ্চনায়ই আসছে পরিত্রাণ, রক্ষা, বাঁচা? “দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় / সে মহাদানেরই যোগ্য করে / অতি ইচ্ছার সংকট হতে / বাঁচায়ে মোরে। তা হলে, চাওয়া নয়, নিবেদন, সমর্পণ? তুমি একটু আলো দেখতে পেলে যেন গানটির পক্তি মধ্যবর্তী বিধুর কুহকের পরতে পরতে। তুমি নত হয়ে এলে, তুমি শান্ত হয়ে এলে, কোমল হলে তুমি, আলোকিত হলে।
তুমি ঈশ্বরনির্ভর নও, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস নেই তোমার। তুমি জানো, এই গানের উদ্দিষ্ট ‘তুমি’ আসলে ঈশ্বর। তুমি নিজের মতো করে নিজস্ব তুমিকে বসিয়ে নিলে গানের ঈশ্বরের কল্পে। তোমার সেই ‘তুমি’ অবশ্যই নারী, তোমার ব্যক্তিগত ঈশ্বরী। সেই ঈশ্বরীকে তুমি চিরকাল প্রাণপণে চেয়েছ, পাওনি কখনওই।
এই গানের অনুষঙ্গে তোমার আবার দীর্ঘকাল পরে মনে পড়েছে সেই আশ্চর্য নারীকে। তার সঙ্গে কখনও মিলন হয়নি তোমার। তার কথা ভেবে আজ এতকাল পরেও তোমার চোখের কোণ সজল হয়ে আসে। তুমি বুঝতে পার, তুমি নিজেই আসলে কখনও তার মিলনের যোগ্য হয়ে ওঠোনি। আজ তুমি টের পাচ্ছ, এক মলিনতর আধাইচ্ছার সংকটে চিরকাল আবৃত হয়ে ছিলে তুমি। সেই সংকট থেকে তুমি আজ যেন মুক্ত হচ্ছ, সে-ই না পাওয়া, সে-ই বঞ্চনা তোমাকে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীরতর পূর্ণতার দিকে। অনন্ত বিরহের মধ্যেই আজ তুমি তার মিলনের যোগ্য হয়ে উঠছ।
তুমি পৃষ্ঠা উলটে গেলে। বইয়ের স্মৃতিরও। যে অদূরবর্তী নৌকোর কথা তুমি একদিন কল্পনা করেছিলে, তা তো আসলে তরঙ্গিত জলে দুলে উঠেছিল স্মৃতির মধ্যেই। সেই তরঙ্গ তো আসলে স্মৃতিই, বা সেই স্মৃতি আসলে গভীরতর তরঙ্গই। তুমি জানো, স্মৃতি তো আসলে গান, অন্তত কবিতা। তুমি যদি নিমগ্নতার মধ্যে পৃষ্ঠা উলটে যাও গীতাঞ্জলির, তা হলে তো আসলে মুখোমুখি হও স্মৃতিরই।

এক-একটি গানের সঙ্গে জড়িয়ে যায় এক একটি স্মৃতি—–দিন, রাত ধূসর ও উদ্ভাসিত। বেদনার পাশে এসে বসে গভীরতর কোনও আনন্দও। বেদনা আর আনন্দ যেন একীভূত হয়ে যায়। তোমাকে কেবল গানগুলির অভিমুখ খানিকটা ঘুরিয়ে নিতে হয়। গীতের এই অঞ্জলি তুমি অৰ্পণ করো দুঃখের মতো কোনও নারীকে, পূজাকে অনুবাদ করে নাও প্রেমে, প্রেমের বিষাদে রাখো পূজা।
নির্জন দুপুরের সেই গানঘরটি তুমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাও। চিরকালই তুমি কথামতো বেলা অবেলায় ঘণ্টি বাজিয়ে দিলেই গান এসে নিজের হাতে দরজা খুলেছে প্রতিবার। কোনও অন্যথা হয়নি। গানের পরনে থাকত ঢোলা-আলখাল্লা জাতীয় কোনও রঙিন পোশাক। গানকে তখন তোমার প্রায় বিদেশিনী মনে হত। তুমি দেখতে কখনও সেই পোশাকে ফুল ফুটেছে হেনা, যে-ফুল তুমি কখনও চোখে দ্যাখোনি, পোশাকের সেই অচেনা ফুলদলকে তুমি ওই নামই দিয়েছিলে।
কখনও লাল রঙের মেঘ এসে পুঞ্জীভূত হত সেই পোশাকে। কখনও বর্ষা, কখনও বসত্ত, কখনও শরৎ, কখনও হেমন্ত গানের সেই পোশাকে লীন হয়ে থাকত। তুমি নিয়মিতই অবাক হতে। তা যে কেবল ওইসব রহস্যাবরণের জন তা নয়। তুমি জানতে, গানের সেই মলাটের অন্তরালে আছে বাণী, সুর, স্বরলিপি, প্রাণ আর আলো।
তারপর যখন গান তার আদিগন্ত চুল খুলে দিত নদীর মতো, আর তুমি আকাশের মতো ঝুঁকে পড়তে সেই স্বচ্ছতোয়া জলের ওপর ছায়ার মতো, আর এক-একদিন এক একটি নতুন গানে উৎসারিত হত তার আলো, ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘গীতবিতান’ একেবারে ভর করত তার ওপর, এক অপরূপ মায়াপাশে তোমরা সেইসব নিজস্ব গানের দুই পারে বসে থাকতে মিলনোন্মুখ চাতক-চাতকীর মতো, তোমাদের গানের ভুবনে সন্ধ্যা নামত, বিভাবরী শেষে ফুটে উঠত ভোর, তোমরা টেরও পেতে না।
গান শেষ হয়ে গেলে চুম্বনেই পিপাসা মেটাতে তোমরা। গানের দেবতা অলক্ষে তোমাদের আশীর্বাদ করতেন নিশ্চয়ই। কেমন ছিল সেইসব গান? নানারকম। কিংবা একইরকম। তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ/দুখের অশ্রুধারা’ গাইতে গেলেই গানের চোখ ভরে উঠত জলে, সেই অশ্রু ক্রমশ সংক্রামিত হত তোমার ভিতরেও। তারপর দুই অশ্রুতে মাখামাখি হয়ে যেতে তোমরা। গানটির জননী, মুক্তাহার, চন্দ্র, সূর্য মালা নিয়ে। স্তব্ধ বসে থাকতে তোমরা। বাইরে হঠাৎ অঝোর বৃষ্টি নামত। তোমরা মনে মনে।
ঘর পেরিয়ে মাঠে গিয়ে দাঁড়াতে। মাঠের ও-প্রান্ত থেকে উড়ে আসত হাওয়া আর বৃষ্টির ধারা। তোমরা ভিজতে রাতভর বৃষ্টিতে। কিংবা, ধরো, সেই গান, ‘কোথায় আলো, কোথায় জ্বরে আলো।/বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো’। অথবা ‘মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে, / আঁধার করে আসে,/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ/ একা ঘরের পাশে’।
বা, সেই-যে, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার’। তোমার তো মনে পড়বেই, ‘প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে;/দেখা নাই পাই,/পথ চাই,/সেও মনে ভালো লাগে’। আর, “আমার মিলন লাগি তুমি/আসছ কবে থেকে।/ তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়/রাখবে কোথায় ঢেকে’। আরও, ‘গায়ে আমার পুলক লাগে,/ চোখে ঘনায় ঘোর, হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে/রাঙা রাখির ডোর’। বা ‘চাই গো আমি তোমারে চাই/তোমায় আমি চাই –/ এই কথাটি সদাই মনে/বলতে যেন পাই’।

অথবা, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি/ভাঙল ঝরে/জানি নাই তো তুমি এলে/আমার ঘরে’। আর, শেষ পর্যন্ত, “দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি, ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে,/ এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি/অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে’। গানের পর গানে, তোমাদের সেই সব সুদিন-দুর্দিন যেন একাকার হয়ে যেত।
সুর আর শব্দের সেতু বেয়ে তোমরা একে অন্যের আরও কাছে, আরও দূরে চলে যেতে পারতে। তোমাদের প্রেম আর পূজা সারা হয়ে যেত গান থেকে গানে। সব শেষ হয়ে গেলে তুমি যখন তার মৃদুল পায়ের পাতায় ঠোঁট রাখতে আর মনে মনে উচ্চারণ করতে, ‘শেষের মধ্যে অশেষ আছে,/ এই কথাটি মনে/ আজকে আমার গানের শেষে/জাগছে। ক্ষণে ক্ষণে’, তখন আমর্ম কেঁপে উঠত সে, তার আবার ঢেউ ভাঙত। তোমার দু-ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ত সেই পদপল্লবে, বকুলের মতো। তুমি চোখ বুজে ফেলতে।
তুমি আজ সেইসব সুদিনের কথা মনে করো, আর বিষাদের ছায়া ফুটে। ওঠে তোমার সামনে। তুমি দেখতে পাও, আজ আর বৃষ্টি নেই সেই মাঠে। অবিরাম। খরা অধিকার করে নিয়েছে সেই দিগন্তপ্রবণ মাঠটিকে। তোমার গানের মানবী আজ নতুন করে মালাচন্দন পরেছে। পেরিয়ে গিয়েছে দিগন্ত। আর তার সঙ্গে সেইসব গানও চলে গেছে তোমাকে ছেড়ে, চিরতরে, যেমন আগেও গিয়েছে কখনও। আর তুমি সেই রুক্ষ মাঠে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রয়েছ, গানবিস্তৃত, একা ও একাকী। বিষাদ আজ ছায়ার মতো তোমার পাশে দাঁড়িয়েছে নিবিড় হয়ে।
তা হলে কি গানও অবশেষে যায় শেষ হয়ে? সব গান? অবশিষ্ট থাকে না আর কিছুই? সব অবসানের শেষে কেবলই শূন্যতা, বিধুর? ঢেউ সরে গেলে বালির ওপর যেমন থেকে যায় জলের দাগ, ঝিনুক ও মায়াবী পাথরকুচি, গানের শেষে তেমন অবশিষ্টাংশ কিছু থাকে না আর?
তুমি হঠাৎই টের পেলে, তুমি তার কথা ভাবতে গিয়ে আসলে ভাবছ সেইসব অবিশ্রান্ত গানের কথা, যা তোমাকে এতকাল ঘিরে রেখেছে বৃষ্টির মতো, আলোর মতো, কুয়াশার মতো, বাতাসের মতো, প্রশ্বাসের মতো। গান তোমার কণ্ঠে আসেনি কখনও, কিন্তু এক অবিকল ঝরনার মতো ঝরে পড়েছে তোমার ভিতরে। তা হলে কেন মনে হয়, গানেরা সব হারিয়ে গিয়েছে আজ বহু দূরান্তে, আর গভীর নির্জন পথে তুমি আজও খুঁজে ফিরছ সেইসব গান!
এ-কথা ঠিক, তোমার প্রায়শই মনে হয়েছে, কোনও গানের বাণী যেন কখনও ঈষৎ এলিয়ে পড়েছে, কোনও মিল হঠাৎ বেশ অকিঞ্চিতকর লেগেছে তোমার। কিন্তু, সে-সব ভাবনা অচিরেই বিলীন হয়েছে সুরের আশ্চর্য মায়ায়। তুমি বিভোর হয়েছ সেই সুর আর শব্দের গান্ধর্ব-বিবাহে। তুমি জানো, অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তোমরা সব রবিকার জীবনী খুঁজছ, রবিকার গানই তো তাঁর জীবনী। গানের মধ্যে রবিকার সারা জীবন ধরা আছে। সুর ও কথার অন্তরে তাঁর জীবন্ত ছবি ওইখানেই পাবে।
এ তথ্যটি যখন খেয়াল করেছ (‘দামিনীর গান’, শঙ্খ ঘোষ) , তখন তোমার ওইসব বক্রতার জন্য লজ্জিত হয়েছ নিজেই। সেসব ভুলে তুমি ভাবতে বসেছ, একজনের, রবীন্দ্রনাথের মতো একজনের জীবনী কী করে নিমেষে অন্যের, বিশেষত, তোমার মতো তুচ্ছতর মানুষেরও, জীবনী হয়ে উঠতে পারে। একশো বছরেরও বেশি বয়স হল তাঁর কোনও গানের। এতদিন ধরে এত মানুষ এই গানকে তাদের নিজের জীবনী ভেবে এল! এ কোন ইন্দ্রজাল। তখনই আর রবীন্দ্রনাথকে এই নশ্বর পৃথিবীর মানুষ মনে হয় না তোমার।
তুমি টের পাও, এই গানের কোনও অবসান হয় না। গায়িকা চলে যেতে পারে। চলে যেতে পারে তোমার সব গান নিয়েই। সেসব গান অর্পণ করতে পারে অন্য-ভিন্ন শ্রোতাকেও, সেই নতুন শ্রোতার সামনে খুলে যেতে পারে নতুনতর কোনও স্বর্গ। তাতে কিছু না। তুমি দিগন্তের দিকে চোখ রাখো, ওই যে অলীক আলোর মতো নৌকা এসে লাগছে তীরে, আর নৌকো থেকে নেমে আসছে কোনও বিদেশিনী, তুমি দেখছ।
তুমি জলে কান পাতো, তুমি বাতাসে কান পাতো, তুমি আকাশে কান পাতো, গান বেজে উঠছে, ওই ‘গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি/বাহির মনে/চিরদিবস মোর জীবনে/নিয়ে গেছে গান আমারে/ ঘরে ঘরে দ্বারে,/গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই/এই ভুবনে। তুমি বুঝতে পার, নতুন করে অশ্রু জাগছে তোমার ভিতরে, জেগে উঠছে নতুনতর গান।