দেশের উন্নতি কবিতা [ Desher Unnoti kobita ] টি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মানসী কাব্যগ্রন্থের অংশ।
কাব্যগ্রন্থের নামঃ মানসী
কবিতার নামঃ দেশের উন্নতি

দেশের উন্নতি কবিতা | Desher Unnoti kobita | মানসী কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বক্তৃতাটা লেগেছে বেশ,
রয়েছে রেশ কানে–
কী যেন করা উচিত ছিল,
কী করি কে তা জানে!
অন্ধকারে ওই রে শোন্
ভারতমাতা করেন “গ্রোন’
এ হেন কালে ভীষ্ম দ্রোণ
গেলেন কোন্খানে!
দেশের দুখে সতত দহি
মনের ব্যথা সবারে কহি,
এস তো করি নামটা সহি
লম্বা পিটিশানে।
আয় রে ভাই, সবাই মাতি
যতটা পারি ফুলাই ছাতি,
নহিলে গেল আর্যজাতি
রসাতলের পানে।
উৎসাহেতে জ্বলিয়া উঠি
দুহাতে দাও তালি!
আমরা “বড়ো’ এ যে না বলে
তাহারে দাও গালি!
কাগজ ভ’রে লেখো রে লেখো,
এমনি করে যুদ্ধ শেখো,
হাতের কাছে রেখো রে রেখো
কলম আর কালি!
চারটি করে অন্ন খেয়ো,
দুপুর বেলা আপিস যেয়ো,
তাহার পরে সভায় ধেয়ো
বাক্যানল জ্বালি–
কাঁদিয়া লয়ে দেশের দুখে
সন্ধেবেলা বাসায় ঢুকে
শ্যালীর সাথে হাস্যমুখে
করিয়ো চতুরালি।
দূর হউক এ বিড়ম্বনা,
বিদ্রূপের ভান।
সবারে চাহে বেদনা দিতে
বেদনা-ভরা প্রাণ।
আমার এই হৃদয়তলে
শরম-তাপ সতত জ্বলে,
তাই তো চাহি হাসির ছলে
করিতে লাজ দান।
আয়-না ভাই, বিরোধ ভুলি,
কেন রে মিছে লাথিয়ে তুলি
পথের যত মতের ধূলি
আকাশপরিমাণ?
পরের মাঝে, ঘরের মাঝে
মহৎ হব সকল কাজে,
নীরবে যেন মরে গো লাজে
মিথ্যা অভিমান।
ক্ষুদ্রতার মন্দিরেতে
বসায়ে আপনারে
আপন পায়ে না দিই যেন
অর্ঘ্য ভারে ভারে।
জগতে যত মহৎ আছে
হইব নত সবার কাছে,
হৃদয় যেন প্রসাদ যাচে
তাঁদের দ্বারে দ্বারে।
যখন কাজ ভুলিয়া যাই
মর্মে যেন লজ্জা পাই,
নিজেরে নাহি ভুলাতে চাই
বাক্যের আঁধারে।
ক্ষুদ্র কাজ ক্ষুদ্র নয়
এ কথা মনে জাগিয়া রয়,
বৃহৎ ব’লে না মনে হয়
বৃহৎ কল্পনারে।
পরের কাছে হইব বড়ো
এ কথা গিয়ে ভুলে
বৃহৎ যেন হইতে পারি
নিজের প্রাণমূলে।
অনেক দূরে লক্ষ্য রাখি
চুপ করে না বসিয়া থাকি
স্বপ্নাতুর দুইটি আঁখি
শূন্যপানে তুলে।
ঘরের কাজ রয়েছে পড়ি,
তাহাই যেন সমাধা করি,
“কী করি’ বলে ভেবে না মরি
সংশয়েতে দুলে।
করিব কাজ নীরবে থেকে,
মরণ যবে লইবে ডেকে
জীবনরাশি যাইব রেখে
ভবের উপকূলে।
সবাই বড়ো হইলে তবে
স্বদেশ বড়ো হবে,
যে কাজে মোরা লাগাব হাত
সিদ্ধ হবে তবে।
সত্যপথে আপন বলে
তুলিয়া শির সকলে চলে,
মরণভয় চরণতলে
দলিত হয়ে রবে।
নহিলে শুধু কথাই সার,
বিফল আশা লক্ষবার,
দলাদলি ও অহংকার
উচ্চ কলরবে।
আমোদ কর কাজের ভানে–

পেখম তুলি গগন-পানে
সবাই মাতে আপন মানে
আপন গৌরবে।
বাহবা কবি! বলিছ ভালো,
শুনিতে লাগে বেশ–
এমনি ভাবে বলিলে হবে
উন্নতি বিশেষ।
“ওজস্বিতা’ “উদ্দীপনা’
ছুটাও ভাষা অগ্নিকণা,
আমরা করি সমালোচনা
জাগায়ে তুলি দেশ!
বীর্যবল বাঙ্গালার
কেমনে বলো টিঁকিবে আর,
প্রেমের গানে করেছে তার
দুর্দশার শেষ।
যাক-না দেখা দিন-কতক
যেখানে যত রয়েছে লোক
সকলে মিলে লিখুক শ্লোক
“জাতীয়’ উপদেশ।
নয়ন বাহি অনর্গল
ফেলিব সবে অশ্রুজল,
উৎসাহেতে বীরের দল
লোমাঞ্চিতকেশ।
রক্ষা করো! উৎসাহের
যোগ্য আমি কই!
সভা-কাঁপানো করতালিতে
কাতর হয়ে রই।
দশজনাতে যুক্তি ক’রে
দেশের যারা মুক্তি করে,
কাঁপায় ধরা বসিয়া ঘরে,
তাদের আমি নই।
“জাতীয়’ শোকে সবাই জুটে
মরিছে যবে মাথাটা কুটে,
দশ দিকেতে উঠিছে ফুটে
বক্তৃতার খই–
হয়তো আমি শয্যা পেতে
মুগ্ধহিয়া আলস্যেতে
ছন্দ গেঁথে নেশায় মেতে
প্রেমের কথা কই।
শুনিয়া যত বীরশাবক
দেশের যাঁরা অভিভাবক
দেশের কানে হস্ত হানে,
ফুকারে হই-হই!
চাহি না আমি অনুগ্রহ-
বচন এত শত।
“ওজস্বিতা’ “উদ্দীপনা’
থাকুক আপাতত।
স্পষ্ট তবে খুলিয়া বলি–
তুমিও চলো আমিও চলি,
পরস্পরে কেন এ ছলি
নির্বোধের মতো?
ঘরেতে ফিরে খেলো গে তাস,
লুটায়ে ভুঁয়ে মিটায়ে আশ
মরিয়া থাকো বারোটি মাস
আপন আঙিনায়।
পরের দোষে নাসিকা গুঁজে
গল্প খুঁজে গুজব খুঁজে
আরামে আঁখি আসিবে বুজে
মলিনপশুপ্রায়।
তরল হাসি-লহরী তুলি
রচিয়ো বসি বিবিধ বুলি,
সকল কিছু যাইয়ো ভুলি
ভুলো না আপনায়!
আমিও রব তোমারি দলে
পড়িয়া এক ধার!
মাদুর পেতে ঘরের ছাতে
ডাবা হুঁকোটি ধরিয়া হাতে
করিব আমি সবার সাথে
দেশের উপকার।
বিজ্ঞভাবে নাড়িব শির,
অসংশয়ে করিব স্থির
মোদের বড়ো এ পৃথিবীর
কেহই নহে আর!
নয়ন যদি মুদিয়া থাকো
সে ভুল কভু ভাঙিবে নাকো
নিজেরে বড়ো করিয়া রাখো
মনেতে আপনার!
বাঙালি বড়ো চতুর, তাই
আপনি বড়ো হইয়া যাই,
অথচ কোনো কষ্ট নাই
চেষ্টা নাই তার।
হোথায় দেখো খাটিয়া মরে,
দেশে বিদেশে ছড়ায়ে পড়ে,
জীবন দেয় ধরার তরে
ম্লেচ্ছ সংসার!
ফুকারো তবে উচ্চ রবে
বাঁধিয়া এক-সার–
মহৎ মোরা বঙ্গবাসী
আর্যপরিবার!
আরও দেখুনঃ
ইঁটের গাদার নিচে কবিতা | iter gadar niche kobita | খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাম তার ভেলুরাম কবিতা | nam tar bheluram kobita | খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সভাতলে ভুঁয়ে কবিতা | sobhatole bhuye kobita | খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সন্ধেবেলায় বন্ধুঘরে কবিতা | sondhebelay bondhughore kobita | খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মুরগি পাখির পরে কবিতা | murgi pakhir pore kobita | খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর