পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের সান্ত্বনা কবিতা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – [ Swantona Kobita ]

“সান্ত্বনা” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত, যা তাঁর শেষ জীবনের গভীর চিন্তাভাবনা ও জীবনদর্শনের প্রতিফলন। এই কবিতায় কবি প্রকৃতিকে—বিশেষত মাটি ও বৃক্ষরাজিকে—মানুষের দুঃখ-সহনশীলতার চিরন্তন প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কবিতাটি দুঃখ ও ক্ষতির মুখে নীরব, ধৈর্যশীল, ও অনন্ত সহিষ্ণু সৌন্দর্যের এক গভীর দার্শনিক বার্তা বহন করে।

কবিতার মৌলিক তথ্য

  • কাব্যগ্রন্থ: পরিশেষ

  • কবিতার নাম: সান্ত্বনা (২)

  • প্রকাশকাল: ১৯৩৯ (পরিশেষ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশকাল)

  • ধারা: দার্শনিক ও ভাববাদী কবিতা

  • বিষয়বস্তু: দুঃখ-সহিষ্ণু প্রকৃতির নীরব সান্ত্বনা

 

সান্ত্বনা কবিতা

 

যে বোবা দুঃখের ভার

ওরে দুঃখী, বহিতেছ, তার কোনো নেই প্রতিকার।

                 সহায় কোথাও নাই, ব্যর্থ প্রার্থনায়

                       চিত্তদৈন্য শুধু বেড়ে যায়।

ওরে বোবা মাটি,

      বক্ষ তোর যায় না তো ফাটি

বহিয়া বিশ্বের বোঝা দুঃখবেদনার

            বক্ষে আপনার

                 বহু যুগ ধরে।

                       বোবা গাছ ওরে,

           সহজে বহিস শিরে বৈশাখের নির্দয় দাহন, —

                     তুই সর্বসহিষ্ণু বাহন

                         শ্রাবণের

                      বিশ্বব্যাপী প্লাবনের।

      তাই মনে ভাবি,

                 যাবে নাবি

           সর্ব দুঃখ সন্তাপ নিঃশেষে

      উদার মাটির বক্ষোদেশে,

                       গভীর শীতল

                 যার স্তব্ধ অন্ধকার তল

কালের মথিত বিষ নিরন্তর নিতেছে সংহরি।

       সেই বিলুপ্তির ‘পরে দিবাবিভাবরী

           দুলিছে শ্যামল তৃণস্তর

                 নিঃশব্দ সুন্দর।

     শতাব্দীর সব ক্ষতি সব মৃত্যুক্ষত

          যেখানে একান্ত অপগত

     সেইখানে বনস্পতি প্রশান্ত গম্ভীর

         সূর্যোদয়-পানে তোলে শির,

               পুষ্প তার পত্রপুটে

         শোভা পায় ধরিত্রীর মহিমামুকুটে।

      বোবা মাটি, বোবা তরুদল,

ধৈর্যহারা মানুষের বিশ্বের দুঃসহ কোলাহল

      স্তব্ধতায় মিলাইছ প্রতি মুহূর্তেই, —

           নির্বাক সান্ত্বনা সেই

                 তোমাদের শান্তরূপে দেখিলাম,

                         করিনু প্রণাম।

           দেখিলাম সব ব্যথা প্রতিক্ষণে লইতেছে জিনি

                    সুন্দরের ভৈরবী রাগিণী

                       সর্ব অবসানে

                              শব্দহীন গানে।

 

ভাবার্থ

কবি এখানে মাটি ও বৃক্ষরাজিকে মানুষের ধৈর্য ও নীরব সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। যেমন মাটি ও বৃক্ষ নীরবে সহ্য করে নেয় বৈশাখের প্রখর তাপ বা শ্রাবণের বন্যা, তেমনি মানুষের জীবনে আসা অনিবার্য দুঃখ ও বেদনা প্রকৃতির এই ধৈর্য থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কবি অনুভব করেন যে, প্রকৃতির এই নিঃশব্দ গ্রহণযোগ্যতা ও শান্ত সৌন্দর্যই জীবনের চূড়ান্ত সান্ত্বনা—যেখানে সব ক্ষতি ও দুঃখ মিলিয়ে গিয়ে রূপ নেয় চিরন্তন, শব্দহীন গানে।

মন্তব্য করুন