Site icon Amar Rabindranath [ আমার রবীন্দ্রনাথ ] GOLN

আমার রবীন্দ্রনাথ – ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা ভাষার অন্যতম প্রথিতযশা বাচিকশিল্পী ব্রততী বন্দোপাধ্যায় [Bratati Bandyopadhyay, ব্রততী ব্যানার্জী] আবৃত্তিশিল্পের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের সুধা পৌঁছে দিয়েছেন অসংখ্য শ্রোতার হৃদয়ে। কলকাতার হৃদয়পুরে জন্ম নেওয়া ব্রততীর বাবা মঞ্জুল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা মায়া বন্দোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকুমার রায় ও শঙ্খ ঘোষের কবিতা তাঁর কণ্ঠে নতুন মাত্রা পায়, যা শ্রোতাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। তিনি ‘সারথি’ নামের আবৃত্তি-দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।

আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে ব্রততী বন্দোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর অন্তরের টান, শ্রদ্ধা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। বাচিকশিল্পী হিসেবে তাঁর রবীন্দ্রনাথপাঠ কেবল শব্দ উচ্চারণের শিল্প নয়, বরং তা হয়ে ওঠে অনুভবের গভীর সেতুবন্ধন। এই লেখায় তিনি প্রকাশ করেছেন কীভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও ভাবনা তাঁর শিল্পীসত্তা ও জীবনের দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে তুলেছে। পাঠকের কাছে এটি হবে এক বাচিকশিল্পীর চোখে দেখা ও হৃদয়ে ধারণ করা রবীন্দ্রনাথের নিবিড় অনুধাবন।

 

কি স্পষ্ট করে মনে নেই, ঠিক কবে, কখন, কোন মুহূর্তে ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। সে এত ছোট বয়সের কথা। শুধু এইটুকু জানি, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তিনি আমায় ভরে আছেন, ঘিরে আছেন—সর্বক্ষণ। কবিগুরু, বিশ্বকবি, গুরুদেব—ছেলেবেলায় শেখা এই গালভরা নামে ডাকতে ডাকতে কখন যে তিনি আমার রবীন্দ্রনাথ, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ধরা দিয়েছেন, আমি নিজেও জানি না। মা-বাবার হাত ধরে তাঁকে চেনা—তাঁর কবিতায়, গানে বিভোর হয়ে যাওয়া। এমনটা হতে হতে কৈশোরে একটা সময় পর মনে হল, তিনি যেন আমাদের পরিবারেরই সদস্য। মনে হত উনি যেন শুধু ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’—আমার, একান্ত ব্যক্তিগত!

তখন আমার বয়স কম। আলমারিতে থরে থরে সাজানো থাকত ওঁর বইগুলি। সেই তখন থেকেই ওঁর লেখা পড়া— বুঝে, না-বুঝে। শিশু ভোলানাথের কবিতাগুলি কেমন অদ্ভুত এক রহস্য-রূপকথার মায়াজাল বুনে দিত। আমি চুপ করে তার মাঝে ডুব দিয়ে বসে থাকতাম। ওঁর প্রথম যে কবিতাটি আবৃত্তি করি, সেটি ছিল বীরপুরুষ। তখন বয়স হবে চার কি পাঁচ। ‘অন্য মা’, ‘খেলাভোলা’, ইচ্ছামতী’, ‘তালগাছ’—সবক’টি কবিতাই বারবার করে পড়তাম।

আমার চারপাশের অতি পরিচিত বিষয়গুলি অন্য চোখে দেখতে শিখতাম। একটা নতুন দৃষ্টিকোণ গড়ে উঠেছিল। এখনকার ছোটরা কেমন যেন মনে হয় বঞ্চিত। আমাদের সময় টেলিভিশন ছিল না, ভিডিয়ো গেমস ছিল না সে সময় আমরা রবীন্দ্রনাথকে যে মাত্রায় পেয়েছি, এই প্রজন্মের শিশুরা তা পাবে না কখনও। আজও যখন ফিরে যেতে চাই শৈশবে, ওঁরই হাত ধরি।

ঠিক যেমন ওঁর হাত ধরেই হাঁটতে হাঁটতে একদিন বড় হয়ে গেলাম। অনেক দিন আগে পড়া, শোনা একটা পংক্তি হঠাৎ নতুন করে ধরা দিল— ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। যে মানুষটিকে ছেলেবেলায় খেলার সাথী হিসেবে পেয়েছিলাম, তাঁর সঙ্গে নতুন করে যেন দৃষ্টি বিনিময় হল। আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেলেন ‘জল দাও, জল দাও। গণ্ডি থেকে বেরিয়ে, সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার শিক্ষা দিলেন তিনি। আমি আবারও পেলাম আমার রবীন্দ্রনাথকে –ঔদার্যে, বিশ্বমানবতায়।

আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় পরীক্ষার আগে ওঁর ছবিতে প্রণাম করে যেতাম। আর এই বড়বেলায় তো জীবনের সব পরীক্ষাতেই তিনি আমার সহায়। তাঁর রচনাতেই নিরন্তর খুঁজে চলি—–কখনও ঈশ্বরকে, কখনও বা প্রেমাস্পদকে। জীবনের খুঁটিনাটি অনুভূতি ওঁর সুরে-কথায় এত সম্পৃক্ত—কোনও দিন ঘুম থেকে উঠে সুন্দর ভোর দেখে ভাবি, আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’। কখনও বা বসন্তের সকাল আসে নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগিয়ে। আবার এমনও হয়েছে, সব কিছু বুঝেও, জেনেও আবেগের বশে কোনও কাজ করে বসেছি। সে সময় তিনিই যেন আমার অপর সত্তা হয়ে মনের মধ্যে বলেছেন, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান।

আবার কখনও কাউকে হারিয়ে আপনমনে গেয়েছি, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে। আমার আবৃত্তিকার হয়ে ওঠার পিছনে ওঁর কবিতার প্রতি প্রেম তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই সার্ধশতবর্ষে একের পর এক আমন্ত্রণ এসে চলেছে—শুধুই ওঁর কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আমার এই পরিচয়টা যদি আদৌ না থাকত, যদি আমি এমন কোনও কাজে বা পেশায় যেতাম যেখানে ওঁর রচনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনও সংযোগ নেই—তা হলেও ওঁকে নিয়ে আমার এই সম্পৃক্ততা একটুও কমত না।

আমার বেডরুমে, ওঁর ছবিটা রেখে খুব মজার একটা জায়গায়। বিছানার মুখোমুখি—যাতে চোখ বন্ধ করার আগে ওঁকে দেখি আবার চোখ খুলেও প্রথম ওঁকেই দেখি। কতবার যে স্বপ্নে এসে ডাক দিয়েছেন। আপশোশ হয়, কেন ওঁর সময়ে জন্মালাম না। সামনে বসে ওঁরই কবিতা পড়ে শোনাতাম তা হলে। কল্পনা করলেই গায়ে কাঁটা দেয়। শান্তিনিকেতনে আমার একটা ছোট্ট বাসা আছে। নাম, পদ্য। শুধুমাত্র ওঁর জন্যই। আম্রকুঞ্জ, ছাতিমতলায় হেঁটে বেড়াই আর শিহরণ হয়। এই পথ দিয়ে একদিন গিয়েছেন তিনি। শতবর্ষ পরে, সেই সময়টা ছুঁতে বারবার ছুটে যাই ওখানে।

কী ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকলে একজন মানুষ সুর দিয়ে, কথা দিয়ে জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির অন্তঃস্থলে পৌঁছে যেতে পারেন। যেমন ‘গীতাঞ্জলী’র কথা ধরি। আমার কাছে তো ওই বইটাই ‘গীতা”। তাই গীতাঞ্জলীর শতবর্ষে ও কবির সার্ধশতবর্ষে ওঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছি আমার একটি অ্যালবামের মাধ্যমে— গীতাঞ্জলীর ১৫৭টি কবিতার মধ্যে ৩০টি কবিতার আবৃত্তি ও সরোদের যুগলবন্দিতে। সহশিল্পী প্রত্যূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই গীতামন্ত্রগুলির জন্য নতুন বন্দিশ রচনা করেছেন। এ বছর ওঁকে নিয়ে আরও একটি কাজ করার কথা ভাবছি। একেবারে নিতান্ত সাধারণ মানুষ, যাঁরা সে ভাবে ওঁর লেখা পড়েননি, তাঁদের কাছে অত্যন্ত সহজবোধ্য কিছু কবিতা ও কবিতার ছবি (সিডি ও ডিভিডি) পৌঁছে দেওয়া। মোট ১৪টি কবিতা থাকবে। সম্ভাব্য নামও একটা ভেবেছি। আমার কাছে উনি যেমন, ঠিক সেইটাই— চিরসখা!

Exit mobile version