আমার রবীন্দ্রনাথ – মাধবী মুখোপাধ্যায়

বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় তাঁর অসাধারণ অভিনয়শৈলী, স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি ও অনন্য ব্যক্তিত্ব দিয়ে দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা, মহানগর, কাপুরুষসহ একাধিক কালজয়ী ছবিতে তাঁর অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রে নারীর চরিত্রায়ণকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। মঞ্চ ও চলচ্চিত্র উভয় ধারায় তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এবং সমালোচক ও দর্শকের সমান প্রশংসা অর্জন করেছেন।

আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে মাধবী মুখোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভব, শিল্পীজীবনের নানা পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রভাব এবং তাঁর সৃষ্টির সাথে গড়ে ওঠা আত্মিক সম্পর্ক। একজন অভিনেত্রীর দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের চরিত্র, কাব্যিক ভাষা ও নাট্যভাবনা কীভাবে অভিনয়ের ব্যঞ্জনা ও গভীরতায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তা তিনি আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। পাঠকের কাছে এটি হয়ে উঠবে এক অভিনেত্রীর অন্তরঙ্গ রবীন্দ্রনাথ অন্বেষণের গল্প।

আমার রবীন্দ্রনাথ - মাধবী মুখোপাধ্যায়
মাধবী মুখোপাধ্যায়

 

চেয়ে দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন কালে

চেয়ে দেখি তিমিরগহন রাতি।

কেঁদে বলি মাথা করে নীচু।

শক্তি আমার রইল না আর কিছু।’ সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি কখন পিছু পিছু এসেছে মোর চিরপথের সাথী।

ছেচল্লিশের দাঙ্গা, দেশভাগ, দুই মেয়ের হাত ধরে আমার মায়ের স্বামীর গৃহ ছেড়ে বেরিয়ে আসা আর তার পরে যখন ‘কুমোর পাড়ায় গোরুর গাড়ি দুলে দুলে মুখস্থ করার বয়স, সেই ছোটবেলা থেকেই সংসারের প্রয়োজনে মায়ের হাত ধরে থিয়েটারে প্রবেশ—তার মধ্যে সত্যি কথা বলতে কী, রবীন্দ্রনাথের স্থান কতটুকু বা আদৌ ছিল কি না এখন ভাবতে বসলে তার নাগাল পাই না। তবে মায়ের মুখে শুনতাম গান, নানা ধরনের। অবশ্যই তার মধ্যে ছিল রবিবাবুর গান। মা গাইতেন—’গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে/কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে/চির সৌদামিনী রাধিকা’। গানটি যে রবীন্দ্রনাথের, বহু দিন পর্যন্ত তা জানা ছিল না। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে একজন ভদ্রমহিলার কণ্ঠে শুনে জানলাম ওইটি রবীন্দ্রসঙ্গীত।

এ ছাড়াও মায়ের গলায় গুনগুনিয়ে উঠত ‘তোমারি ঝরণাতলার নির্জনে’, আমার বেলা যে যায়, সাঁঝবেলাতে এইসব গানগুলি। নিজের গলায় তুলে নিতাম। খুব ছোট থেকেই গান গাইতে পারতাম আমি। মনে পড়ে কোনও একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গেয়েছিলাম ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। তখন আমার বয়স সাড়ে তিন কি চার। ওই বয়সে ওই গান গাওয়ায় প্রবল আপত্তি মায়ের। কিন্তু আমি তা শুনিনি। মা-ও শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে আমার গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন। সেজন্য তিন নম্বর কাটা গেলেও প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হয়েছিলাম।

প্রথাগত স্কুল-কলেজের শিক্ষা আমার বেশি দূর এগোয়নি ঠিকই, কিন্তু নিজের ভালোলাগার তাগিদে এবং অভিনয় শিক্ষার প্রয়োজনে বিস্তর পড়াশোনা করতে হত। তার মধ্যে প্রথম দিকে অবশ্যই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সবই পড়তাম। কবিতাও। কবিতার অর্থ হয়তো সবটা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু কবিতার ছন্দ, তার কোনও কোনও শব্দের ব্যবহার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত। ‘এই দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়/ দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়’—কবিতাটি ভীষণ ভালো লাগত। আরও একটা কবিতা — মস্তক তুলিতে দাও উন্মুক্ত আকাশে’—তখন তো আমারও মাথা তুলে বাঁচার লড়াই চলছে।

মা অবশ্য বলতেন, সাহিত্য পড়তে গেলে শুধু রবীন্দ্রনাথ পড়লে চলবে না। শুরু করতে হবে বঙ্কিমচন্দ্র দিয়ে। নইলে সাহিত্যচর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। নতুন বই কেনার পয়সা ছিল না। কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে এনেছিলাম বঙ্কিম রচনাবলী, রমেশচন্দ্র দত্ত, শরৎচন্দ্র—এঁদের বই। এই ভাবেই বই পড়ার অভ্যাস জীবনে গেঁথে গেল।

কবিতা পড়ার পাশাপাশি শিখতে হত আবৃত্তি। ভালো অভিনয়ের জন্য সেটা সবচেয়ে জরুরি। গলা তৈরি হত আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। শুদ্ধ উচ্চারণ, কণ্ঠের ওঠানামা, এসবই আবৃত্তির অঙ্গ। শ্রীরঙ্গমে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে নামী অতিথিরা আসতেন। সবার নাম মনে নেই। মনে আছে, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র— এঁদের কথা। ওঁরা আসতেন, বক্তৃতা দিতেন, আবৃত্তি করতেন শিশির ভাদুড়ি মশাই। ‘পঞ্চনদীর তীরে/বেণী পাকাইয়া শিরে’—গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। আরও একটা কবিতা আবৃত্তি করতেন—মনে ছিল আশা ধরণীর এক কোণে, রহিব আপনমনে/ধন নয়, মান নয়/ এতটুকু বাসা, করেছিনু আশা’। মনের ভিতর ওই কথাগুলো ঢুকে গেল। একজন শিল্পীর কী চাওয়া উচিত? ধন নয় মান নয়, মানুষের মনের মধ্যে একটু বাসা।

সম্প্রতি সঞ্চয়িতার সব কবিতাগুলোর আবৃত্তি সঙ্কলিত আমার একটি সিডি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে আমি ছাড়াও আবৃত্তি করেছেন আরও দুজন। কথা সেটা নয়, কথা হল এই প্রচেষ্টায় নতুন ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনিতে তো কবিতা রচনার পর্ব মিলিয়ে পড়া হয়ে ওঠে না—বেছে নিতে হত ইতস্তত একটি কি দুটি কবিতা। কিন্তু এই উদ্যোগের সুবাদে ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্বের কবিতা পড়তে গিয়ে সমগ্র রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে আমার সামনে প্রতিভাত হলেন। কীভাবে, ক্রমান্বয়ে তাঁর এই দর্শন এক ভাবনা থেকে অন্য আর এক ভাবনায় প্রবাহিত হয়েছে, পরিণত হয়েছে তা সম্যক ভাবে বুঝবার সুযোগ হল। মনে হল রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্য যেন কবির নিজস্ব জীবনদেবতার উদ্দেশে চরম নিবেদনের লক্ষ্যে বয়ে যাওয়া এক ধারা।

আমি তো আসলে একজন অভিনেত্রী এবং রবীন্দ্রসাহিত্য আশ্রিত ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে বার বার পড়তে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। সত্যজিৎবাবু যখন ঠিক করলেন ‘নষ্টনীড়’ গল্পটাকে নিয়ে ছবি বানাবেন, আমাকে বললেন—’গল্পটা পাঠালাম পড়বার জন্য।’ আমি বললাম, ‘গল্পটা তো আমার পড়া’। উনি বললেন, ‘আবার পড়ো’। আবার পড়লাম ‘নষ্টনীড়’। একবার নয়, বার বার। ছবিটা দেখে কে কী ভেবেছেন আমার জানার কথা নয়। আমার ভাবনায় যে ‘চারু’ সে কিন্তু compromise করেনি। অমল কিছুতেই বলতে পারল না, হ্যাঁ, আমি বউঠানকে ভালোবাসি’।

ভূপতি হৃদয়বান ব্যক্তি। সে চারুকে ক্ষমা করল। গল্পের শেষ অংশে আছে, ভূপতি বলছে, চলো চারু, বেড়িয়ে আসি’। চারু কহিল, ‘না থাক”। এই বেড়ানো প্রতীকী। চারু-অমলের সম্পর্ককে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার থেকে বেরোনো। চারু বলল, ‘না, আমি এই সংসারে থেকেই ভালোবেসে যাব।” সংসারে চারু থাকল, মনের মধ্যে অমলকে নিয়েই থাকল। এই প্রেমকেই বলে মধুর প্রেম। রাধা-কৃষ্ণের যে প্রেম, সেই প্রেম থেকে আমাদের প্রেমের ধারণা এসেছে। সেই প্রেম চার রকম—সথা, দাস্য, বাৎসল্য, মধুর।

সাখ্য প্রেমে দুজনেই সমান, শুধুই দেওয়া-নেওয়া। দাস্য প্রেম হল দাসরূপে সেবা করা, অসমান সম্পর্ক। বাৎসল্যে শাসন ও আদর একই সঙ্গে, সেই ভাবে ঋণশোধ। রাধার প্রেমে চাহিদা নেই, কৃষ্ণের সুখেই তার সুখ—কাম-গন্ধ নাহি তায়। সেই জন্য পরবর্তীকালে কৃষ্ণকে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল একই অঙ্গে ‘রাধা ও কৃষ্ণ’—গৌরাঙ্গ হয়ে।

রাধা রাধা বলে কাঁদতেও হয়েছিল। কিন্তু অমলের পরবর্তী জন্ম হয়েছিল কি না জানি না। রবীন্দ্রনাথ সে কথা লিখে যাননি।

‘স্ত্রীর পত্র’-এ মৃণালের উপলব্ধি অন্য মাত্রায়। সে দেখল সমাজের মধ্যে মেয়েদের অবস্থানটা কোথায়। সেটা মৃণাল জানতে পারল বিন্দুকে দিয়ে। বিন্দুই মৃণালকে সাজাত আর বলত—’তোমার এই রূপটা আমি ছাড়া আর কেউ দেখেনি।’ এই রূপ বাইরের রূপ নয়, মৃণালের অন্তরের রূপ, তার সত্তা, তার সব কিছু।

এই বিন্দুকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন পুড়িয়ে মেরেছিল পাগল স্বামীর সঙ্গে ঘর করতে না চাওয়ার অপরাধে। বিন্দুর মৃত্যু মৃণালের চোখ খুলে দিল। মীরাবাঈ-এর শিকলও তো কম ভারী ছিল না। কিন্তু তাকে তো বাঁচার জন্য মরতে হয়নি। মীরার গানে আছে—’ছাড়ুক মা, ছাড়ুক বাপ, যে যেখানে আছে ছাড়ুক। মীরা কিন্তু লেগেই রইল প্রভু’। এই লেগে থাকাই তো বেঁচে থাকা। মৃণাল স্বামীকে লিখল— ‘আমিও বাঁচলাম। তোমাদের চরণতলাশ্রয়চ্ছিন্না মৃণাল।

চারু বা মৃণাল যে ভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে, হয়তো বা তাদের সেই সংগ্রাম, সেই তেজ আমার জীবনকে অনুপ্রাণিত করেছে নানাভাবে। কিংবা, আমার চরিত্রের মধ্যেই হয়তো বা সে সব দিক কিছু ছিল যা ওই চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। কী হয়েছে জানি না। তবে আজ যে আমি এই সংসারের ‘চরণতলাশ্রয়াচ্ছিন্না’ মাধবী—নিজের মতো করে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে পারছি—হয়তো বা চারুলতার মতো করেও—আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গি কতা সবচেয়ে বেশি করে এইখানেই।

মন্তব্য করুন