“মিলন” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহুয়া (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। প্রকৃতি, প্রেম এবং মানবজীবনের উচ্ছ্বাসকে একাকার করে এখানে কবি মিলনের উৎসবকে চিত্রিত করেছেন। বসন্তের ফুলেল অরণ্য, প্রজাপতি, পাখির গান ও মানুষের প্রেমবন্ধন—সব মিলিয়ে কবিতাটি হয়ে উঠেছে আনন্দ, নবজাগরণ ও জীবনের নবীন আচ্ছাদনের এক সুরম্য গাথা। এখানে মিলনকে কবি কেবল ব্যক্তিগত প্রেমে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং বিশ্বসৌন্দর্যের রহস্যলীলা ও মানবমনের উল্লাসের এক মহোৎসবে রূপ দিয়েছেন।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কাব্যগ্রন্থ: মহুয়া
প্রকাশকাল: ১৯২৯
কবিতার নাম: মিলন
কাব্যের ধারা: প্রেম ও প্রকৃতিনির্ভর রোম্যান্টিক কবিতা
বিষয়বস্তু: প্রেম, প্রকৃতি, নবজাগরণ ও জীবনোৎসব
মিলন – কবিতার পাঠ
সৃষ্টির প্রাঙ্গণে দেখি বসন্তে অরণ্যে ফুলে ফুলে
দুটিরে মিলানো নিয়ে খেলা।
রেণুলিপি বহি বায়ু প্রশ্ন করে মুকুলে মুকুলে
কবে হবে ফুটিবার বেলা।
তাই নিয়ে বর্ণচ্ছটা, চঞ্চলতা শাখায় শাখায়,
সুন্দরের ছন্দ বহে প্রজাপতি পাখায় পাখায়,
পাখির সংগীত সাথে বন হতে বনান্তরে ধায়
উচ্ছ্বসিত উৎসবের মেলা।
সৃষ্টির সে রঙ্গ আজি দেখি মানবের লোকালয়ে
দুজনায় গ্রন্থির বাঁধন।
অপূর্ব জীবন তাহে জাগিবে বিচিত্র রূপ লয়ে
বিধাতার আপন সাধন।
ছেড়েছে সকল কাজ, রঙিন বসনে ওরা সেজে
চলেছে প্রান্তর বেয়ে, পথে পথে বাঁশি চলে বেজে,
পুরানো সংসার হতে জীর্ণতার সব চিহ্ন মেজে
রচিল নবীন আচ্ছাদন।
যাহা সবচেয়ে সত্য সবচেয়ে খেলা যেন তাই,
যেন সে ফাল্গুনকলোল্লাস।
যেন তাহা নিঃসংশয়, মর্তের ম্লানতা যেন নাই,
দেবতার যেন সে উচ্ছ্বাস।
সহজে মিশিছে তাই আত্মভোলা মানুষের সনে
আকাশের আলো আজি গোধূলির রক্তিম লগনে,
বিশ্বের রহস্যলীলা মানুষের উৎসবপ্রাঙ্গণে
লভিয়াছে আপন প্রকাশ।
বাজা তোরা বাজা বাঁশি, মৃদঙ্গ উঠুক তালে মেতে
দুরন্ত নাচের নেশা পাওয়া।
নদীপ্রান্তে তরুগুলি ওই দেখ্ আছে কান পেতে,
ওই সূর্য চাহে শেষ চাওয়া।
নিবি তোরা তীর্থবারি সে অনাদি উৎসের প্রবাহে
অনন্তকালের বক্ষ নিমগ্ন করিতে যাহা চাহে
বর্ণে গন্ধে রূপে রসে, তরঙ্গিত সংগীত উৎসাহে
জাগায় প্রাণের মত্ত হাওয়া।
সহস্র দিনের মাঝে আজিকার এই দিনখানি
হয়েছে স্বতন্ত্র চিরন্তন।
তুচ্ছতার বেড়া হতে মুক্তি তারে কে দিয়েছে আনি
প্রত্যহের ছিঁড়েছে বন্ধন।
প্রাণদেবতার হাতে জয়টিকা পরেছে সে ভালে,
সূর্যতারকার সাথে স্থান সে পেয়েছে সমকালে,
সৃষ্টির প্রথম বাণী যে প্রত্যাশা আকাশে জাগালে
তাই এল করিয়া বহন।
ভাবার্থ
কবিতায় কবি মিলনকে প্রকৃতি ও জীবনের সর্বজনীন আনন্দ হিসেবে দেখিয়েছেন। বসন্তের ফুলেল অরণ্যের মতো মানবজীবনেও প্রেম ও মিলনের রঙে ভরে ওঠে আনন্দ। বাঁশির সুর, রঙিন সাজ, উৎসবমুখর পরিবেশ জীবনের জীর্ণতা মুছে নতুন আবেশ আনে। মিলন এখানে শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়—এটি বিশ্বসৌন্দর্যের সঙ্গে মানুষের সৃষ্টিশীল সংযোগ, যা ক্ষণিক হলেও চিরন্তনের স্বাদ দেয়।
শব্দার্থ
গ্রন্থির বাঁধন – বিবাহ বা মিলনের প্রতীকী বন্ধন
ফাল্গুনকলোল্লাস – বসন্তের আনন্দোৎসব
আচ্ছাদন – আচ্ছাদন, নতুন আবরণ
জয়টিকা – বিজয়ের প্রতীকী শোভা বা অলংকার
তীর্থবারি – পবিত্র জলের প্রবাহ