আমার রবীন্দ্রনাথ- যোগেন চৌধুরী

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী তাঁর অনন্য শিল্পভাষা, সূক্ষ্ম রেখার কারুকাজ এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ভরা সামাজিক বাস্তবতার চিত্রায়ণের জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত। ভারতীয় আধুনিক শিল্পের জগতে তিনি এক উজ্জ্বল নাম, যার কাজ বিশ্বব্যাপী প্রদর্শিত ও সমাদৃত হয়েছে। চিত্রকলার পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ বিষয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ রয়েছে, যা প্রায়শই তাঁর শিল্পচিন্তা ও সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়।

আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে যোগেন চৌধুরী তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও ব্যক্তিগত অনুভূতি। একজন চিত্রশিল্পীর দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, চিত্রকলা ও সংগীত কীভাবে তাঁর সৃজনশীলতা ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছে, তা তিনি আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। এই লেখায় আছে স্মৃতিচারণ, অনুপ্রেরণার উৎস এবং শিল্পীসত্তার সাথে রবীন্দ্রনাথের অবিচ্ছেদ্য যোগের এক অন্তর্মুখী বয়ান, যা পাঠককে শিল্প ও সাহিত্যের মেলবন্ধনের গভীরে নিয়ে যাবে।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- যোগেন চৌধুরী
আমার রবীন্দ্রনাথ- যোগেন চৌধুরী

 

ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমাকে সর্বাঙ্গীন ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সে | কলেজ জীবনে তা আরও গাঢ় হয়ে উঠল—যখন তাঁর লেখা পড়তে শুরু করি। পৃথিবীর সকল মনীষীদের মধ্য থেকে যদি একজন মানুষকে আমার প্রিয় এবং শ্রেয় হিসেবে বেছে নিতে হয় তা হলে তিনি আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথের লেখা, ছবি ও গানের মধ্য দিয়েই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।

তাঁর লেখা, গান বা ছবির আন্তরিক অনুভব, সত্যতা এবং সংবেদনশীলতা রবীন্দ্রনাথকে আমার মন ও প্রাণের কাছাকাছি নিয়ে আসে, ঘনিষ্ঠ করে। তাঁর লেখা, গান এবং ছবি মনের ওপর স্পষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করে মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাঁর ভাবনা, জীবনবোধ—যা এই বিশ্বপ্রকৃতি, মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা, ধর্ম, শিক্ষা, আন্তর্জাতিকতা অথবা নারী স্বাধীনতা—সকল বিষয়ে নিয়ে যা তাঁর লেখা ও সৃষ্টির মধ্যে নানারূপে ছড়িয়ে আছে এবং আমাকে, অন্য অনেকের মতোই, গভীরভাবে আকর্ষণ করে এবং অনুপ্রাণিত করে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত প্রকৃতি ও অস্তিত্ব নিয়ে আমাকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন। এক এক সময় মনে হয় আমার অজান্তে তিনি আমার মস্তিষ্কের গভীরে বাসা বেঁধে আছেন। আমি তাঁকে সরাতে পারব না, সরাতে চাইও না। যখন একা এবং অসহায় লাগে, তখন আরও কিছু প্রিয় লেখক বা মানুষের সঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ সেই একাকিত্ব এবং বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায় মনের গভীরে সহায় এবং স্থিরতা নিয়ে আসেন। মনে হয়, এমন একজন আছেন, আমার পাশেই, আমার কাছাকাছি যিনি আমার সহায়, আমার বিশ্বাস, সত্য, আদর্শ ও নৈতিকতার সমর্থক। তিনি তখন হয়ে ওঠেন চিরসঙ্গী এবং বন্ধু ৷

কৈশোরে যখন স্কুলের ওপরের ক্লাসে পড়ি, সে সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই পাড়ার ক্লাবে রবীন্দ্র জন্মোৎসব। তাঁর গান, কবিতা, নাচ, এবং নাটক নিয়ে উৎসব। হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকায় আমার আঁকা রবীন্দ্রনাথের মুখাকৃতি, সঙ্গে ক্লাবের সদস্যদের লেখা। মনে পড়ে ১৯৬১-র কথা। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী—আমি তখন আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে এসেছি।

আমাদের ক্লাবে সেই শতবর্ষ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল ২৫টি বড় বড় আমারই হাতে আঁকা ও লেখা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনীর একটি প্রদর্শনী। আন্তরিকতা ও উদ্দীপনায় ভরা সে সব ছবি। জানি না, তার দু-একটি হয়তো এখনও কোথাও খুঁজে পেতে পারি। সে বছরই আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত ১৪ খণ্ডের সমগ্র রবীন্দ্ররচনাবলীটি নিজের সংগ্রহের জন্য কিনেছিলাম—নিজের জমানো অর্থ দিয়ে। তখন আমি হাওড়া জেলা স্কুলের ছবি আঁকার শিক্ষক—সামান্য মাইনে পাই এবং আমার সামান্যই বয়স তখন।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল
আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল

 

রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার সম্পূর্ণ ভালোবাসা ও আকর্ষণই আমাকে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের কাজে যুক্ত হওয়ার পিছনে আগ্রহী করে। আমি দীর্ঘ ১৫ বছর দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সুযোগ-সুবিধে, আরাম এবং আকর্ষণীয় শিল্পকলা সংরক্ষকের চাকরিটি ছেড়ে কলাভবনের শিক্ষকতায় যোগ দিই। কেউ কেউ খুব অবাক হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমার বিশেষ ভাবে কোনও আর্থিক লাভও হয়নি শান্তিনিকেতনে এসে। বলা যায় বরং পারিবারিক ভাবে বড় রকমের ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। তবু রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণই ছিল সমস্ত কিছুর ওপরে। কী এক রহস্যময় সেই আকর্ষণ।

মনে হয় তিনি শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জ কিংবা ছাতিমতলায় অথবা কলাভবনের চত্বরে যেন এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা নিজের নিজের অনুভবের বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখা আমার পড়া হয়নি। তবে যতটুকু পড়তে পেরেছি—তাতে মনে হয় এই অসাধারণ মানুষটিকে যেন স্পর্শ করতে পেরেছি। আমি রবীন্দ্রজ্ঞ নই, তবে রবীন্দ্রনাথের জীবন, ভরসা ও আদর্শের মূল স্রোতকে যেন ছুঁতে পেরেছি, এমনই বিশ্বাস হয়।

বাংলার মনীষী মানুষজনের মধ্যে অনেকেই দেশের ও সমাজের কথা, মানুষের উন্নয়নের কথা ভেবেছেন। রবীন্দ্রনাথ সে বিষয়ে যে ভাবে দেশ, মানুষ ও সমাজের কথা সর্বাঙ্গীন ভাবে ভেবেছেন, সমাজের একটি রূপরেখা আমাদের কাছে তুলে ধরেন, এমনটি আর কারও কাছ থেকে আমরা পাইনি। তাঁর লেখা এবং কাজের মধ্য দিয়ে তিনি বারবার সেসব কথা বলেছেন। তিনি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা, গ্রামের উন্নয়ন, ধর্ম, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, আন্তর্জাতিকতা, বিশ্বমানবতা, ধর্ম, শিক্ষাব্যবস্থা— এসব কিছু নিয়ে তাঁর অনুভবলব্ধ জ্ঞান ও ভাবনা বিস্তারিত ভাবে তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং লেখায় স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- যোগেন চৌধুরী
আমার রবীন্দ্রনাথ- যোগেন চৌধুরী

 

বলেছেন নারীস্বাধীনতা বা নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে। বলেছেন শিক্ষা অথবা জীবনের সঙ্গে শিল্পকলা, সঙ্গীত বা সৌন্দর্য কীভাবে যুক্ত থাকবে বা জীবনকে সমৃদ্ধ করবে—সে সব কথা। বলেছেন প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক কেমন হবে। কাজের মধ্য দিয়ে, শ্রীনিকেতন- শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে তিনি তাঁর স্বপ্ন ও কল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছিলেন। তার সৃষ্ট চিত্রকলা, গান, নৃত্যনাট্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থা এ দেশের শিল্প- সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

তার অজস্র গান সুরে-ছন্দে, ভাষায় আমাদের মনকে পরিপূর্ণ করে। তাঁর অসংখ্য ছবি আমাদের আশ্চর্য করে, তাঁর নান্দনিক সৌন্দর্য মনকে সম্মোহিত করে। তার ভাবনা আমাদের ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে। মানুষ হিসেবে আমাদের পরিবর্তিত করে। আজ ১৫০ তম জন্মবর্ষে সৃষ্টিশীল প্রিয় মানুষ রবীন্দ্রনাথকে আমার গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।

মন্তব্য করুন