আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন স্বতন্ত্রস্বরে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক রবিশংকর বল তাঁর গভীর মানবিক দৃষ্টি, সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং বর্ণনাশৈলীর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ—সব ধারাতেই তাঁর লেখা জীবনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির মিশ্রণে সমৃদ্ধ। সাহিত্যজীবনে তিনি পাঠককে দিয়েছেন দোজখনামা, কলকাতার অমৃত, মাহরূপাসহ বহু উল্লেখযোগ্য রচনা।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে রবিশংকর বল ব্যক্তিগত স্মৃতি, সাহিত্যপাঠ ও শিল্পানুভূতির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র সাহিত্যিক নন, বরং এক অন্তরঙ্গ সহযাত্রী—যিনি তাঁর সৃজনযাত্রায় প্রেরণার উৎস, চিন্তার সহচর ও নান্দনিকতার মাপকাঠি। পাঠকের কাছে এই লেখা হয়ে উঠবে এক ঔপন্যাসিকের হৃদয়ে ধারণ করা এবং কলমে পুনর্নির্মিত রবীন্দ্রনাথের অনন্য প্রতিচ্ছবি।

যদি বলা হয়, তোমাকে নির্বাসনে পাঠার আর সঙ্গে নিতে দেওয়া হবে একটিই | মাত্র বই, আমি সঙ্গে সঙ্গে হাতে তুলে নেব রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’। এ বই যেমন চিঠি হিসাবে পড়ি, তেমনই কখনও উপন্যাস হিসাবে। কখনও পড়ি এক একটি ছোটগল্প। এক দীর্ঘ কাব্যগ্রন্থও তো বলা যায়।
অথবা একটা ছবির বই, যেখানে হারানো বাংলাদেশের একেকটা ছবি পরপর সাজানো আছে। পৃথিবীর কোনও ভাষাতেই এমন বই সম্ভবত আর নেই। ‘গল্পগুচ্ছ’-এর গল্পরাও সেই সব হারানো ছবি, হলুদ হয়ে যাওয়া, সময়ের ধুলো ছড়িয়ে আছে তাদের শরীরে, আর আমরা যে মাঝে মাঝেই তাদের কাছে ফিরে যাই, তার কারণ ওই ভাষা-পৃথিবীর কাছে গিয়ে শুদ্ধ শ্বাস নেওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে একদিকে হতে পারে চোখে পিচুটি অধ্যাপকীয় কৃমি-খোঁটার ভাষ্য, নয়তো বা উত্তরাধুনিক ভাষার কুস্তি, যেখানে লিখিয়েবাবু পাঠকের চেয়ে উঁচু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বারবার ঘোষণা করেন, দ্যাখো আমি কত জানি, আমার এই ভাষা বোঝা তোমার কম্মো নয়, এ হচ্ছে অভয়বাবুর জাগলারি। এই সার্কাস থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে অবশ্য তাঁর রবীন্দ্র-অনুভবের কথা বলে চলেছেন কবি শঙ্খ ঘোষ সেই কবে থেকে। ক’জনই বা শুনেছেন তাঁর কবিধর্মের উচ্চারণ? আমার মতো যাঁরা অর্ধশতাব্দী ছুঁতে চলেছি, তাঁদের তো এবার সহজিয়ার পথে যাত্রা। যেমন ‘লিপিকা’র একটি দিনের আখ্যান :
মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টিধারা ক্লান্ত হয়ে আসে, আবার দমকা হাওয়া তাকে মাতিয়ে তোলে। ঘরে অন্ধকার, কাজে মন যায় না। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বর্ষার গানে মল্লারের সুর লাগালেম। পাশের ঘর থেকে একবার সে কেবল দুয়ার পর্যন্ত এল। আবার ফিরে গেল। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে ভিতরে এসে বসল। হাতে তার সেলাইয়ের কাজ ছিল, মাথা নীচু করে সেলাই করতে লাগল। তারপরে বন্ধ করে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইল। বৃষ্টি ধরে এল, আমার গান থামল। সে উঠে চুল বাঁধতে গেল।
এইটুকু ছাড়া আর কিছুই না। বৃষ্টিতে গানেতে অকাজে আঁধারে জড়ানো সেই একটি দুপুরবেলা ৷ ইতিহাসে রাজাবাদশার কথা, যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনি, সস্তা হয়ে ছড়াছড়ি যায়। কিন্তু, একটি দুপুরবেলার ছোট একটু কথার টুকরো দুর্লভ রত্নর মতো কালের কৌটোর মধ্যে লুকোনো রইল, দুটি লোক তার খবর জানে।’
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প প্রতাপ সিংহ ও প্রতাপাদিত্যের—রাজাবাদশাদের জীবন থেকে সরে এসে ওই ‘বৃষ্টিতে গানেতে অকাজে আঁধার জড়ানো কয়েকটি দুপুরবেলাকে ধরে রাখল। বিস্মিত হয়ে লক্ষ করার, একজন মানুষ একা-একা বাংলা ভাষার একটি শিল্প-রূপকে গড়ে তুললেন।
লাতিনে এমন ঘটনাকে sui generis বলা হয়। ‘ভিখারিণী’, ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’, ‘মুকুট’ ইত্যাদি লেখার পর যেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই পরপর ‘দেনাপাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’ ‘গিন্নি’ ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’, ‘তারাপ্রসন্নর কীর্তি’র মতো গল্প জন্ম নিল। একেবারে সাধারণ, আটপৌরে বাঙালি জীবনের কাহিনি। নিজের ছোটগল্পের কথা বলতে গিয়ে বারবার রবীন্দ্রনাথ এই গল্পগুলিকে ‘পল্লিজীবনের গল্প’ বলেছেন। এরা সব ইতিহাসের প্রধান সড়কের আড়ালে পড়ে থাকা জীবনের আখ্যান ৷
জমিদারির কাজ দেখতে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসরে। প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, …১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জমিদারির দায়িত্ব পাওয়ার পরে পদ্মা ও অন্যান্য অনেক ছোটবড় নদীর সঙ্গে পরিচয় ক্রমশ গভীর হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের জীবনপ্রবাহে নদীর প্রবাহের ভূমিকা খুব অল্প নয়। শিলাইদহে, সাজাদপুরে বা পতিসরে জমিদারি পরিদর্শনে যাওয়ার সময়ে তিনি জলপথে ভ্রমণ করা পছন্দ করতেন, সম্ভব হলে বাসও করতেন জলের উপর বোটে—সেখান থেকে তিনি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখতেন গ্রামীণ মানুষের, বিশেষত নারীদের জীবনযাত্রার খণ্ডাংশ, সেটিকেই তিনি কল্পনায় রাঙিয়ে নিয়ে রচনা করতেন ছোটগল্প।’ এই পর্বের জীবন নিয়ে যেমন ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিগুলি হয়ে ওঠে ‘ছিন্নপত্রাবলী’, তেমনই বাংলা ছোটগল্পের চেহারা চরিত্রও তৈরি হয়ে উঠতে থাকে। শিলাইদহ থেকে ১৮৯৪-এর ২৭ জুন তিনি লেখেন :
‘কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে। আমি চিন্তা করে দেখলুম, পৃথিবীর উপকার করার ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য হওয়া যায় না, কিন্তু তার বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনি পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হচ্ছে, যদি আমি আর কিছু না করে ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হলে বোধহয় পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়।
সাধনায় উচ্চ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে বঙ্গদেশকে লগি ঠেলে নিয়ে যাওয়া খুব মহৎ কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু সম্প্রতি তাতে আমি তেমন সুখ পাচ্ছিনে এবং পেরেও উঠছিনে। গল্প লেখবার একটা সুখ এই—যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বন্ধ ঘরের বিরহ দূর করবে এবং রৌদ্রের সময় পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে। আজ সকালবেলা তাই গিরিবালা নাম্নী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ একটি ছোট অভিমানিনী মেয়েকে আমার কল্পনারাজ্যে অবতারণ করা গেছে।’ জন্ম নিল ‘মেঘ ও রৌদ্র’-এর মতো গল্প ।
পাঠক, ভয় পাবেন না, আমি এই সব আশ্চর্য গল্পের কোনও ব্যাখ্যা আপনাদের কাছে রাখব না বা এদের নিয়ে উত্তরাধুনিক চ্যাংড়ামি করারও উচ্চাশা আমার নেই। যেহেতু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ‘গ্রন্থসকল নীরবতার সন্তান’। এমন বাক্য কমলকুমারের মতো পৌরাণিক মানুষই লিখতে পারতেন। এই ভুলে যাওয়া ভাষার প্রতি আমার বড় টান এখন।
তাই মধুকবি পড়ি, গিরিশচন্দ্রের নাটক পড়ি, আর ফিরে ফিরে পড়ি ‘গল্পগুচ্ছ’, ‘লিপিকা’, ‘সে’। কবুল করি, ‘তিনসঙ্গী’র কোনও গল্পই আমার ভালো লাগে না। ‘শেষের কবিতা’-র মতোই এই গল্পগুলিতে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক হয়ে ওঠার যে দুর্মর প্রচেষ্টা, তা তাঁর স্বভাবের সঙ্গে খাপ খায় না। তাঁর মতো আধুনিক কেউ ছিল না, সে-কথা যেন বিস্মৃত হয়েছিলেন।

নিজের ছোটগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরই কিছু কথা আমি আপনাদের করকমলে তুলে দিতে চাই। হ্যাঁ, আপনাদের হাতে নয়, করকমলে। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যদি কোনও দায় থাকে, তবে এসএমএস প্রবণতার বিরুদ্ধে এই ভাষাকেই নিরন্তর লিখে যেতে হবে। লিখে যেতে হবে সব সারল্যের কথা, কেন-না বাংলাভাষা কুস্তিবীরদের লড়াইয়ের আখড়া নয়।
যেভাবে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প সম্পর্কে ১৮৯৪-এর ৫ সেপ্টেম্বর সাজাদপুর থেকে ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন, “…আমার এই সাজাদপুরের দুপুরবেলা গল্পের দুপুরবেলা—মনে আছে ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম। আমিও লিখছিলুম এবং আমার চারদিকে আলো এবং বাতাস এবং তরুশাখার কম্পন তাদের ভাষা যোগ করে দিচ্ছিল।’
‘কঙ্কাল’ গল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কথার অনুলিপি লিখেছেন সীতাদেবী তাঁর ‘পুণ্যস্মৃতি’তে : ‘ছেলেবেলায় আমরা যে ঘরে শুতুম, তাতে একটা মেয়ের Skeleton ঝুলানো ছিল। আমাদের কিন্তু কিছু ভয়টয় করত না। তারপর অনেকদিন কেটে গিয়েছে, আমি তখন ভিতরবাড়িতে শুই। একদিন কয়েকজন আত্মীয়া এসেছেন, তাঁরা আমার ঘরে শোবেন, আমার উপর হুকুম হয়েছে বাইরে শোওয়ার। অনেকদিন পরে আমি আবার সেই ঘরে এসে শুয়েছি।
শুয়ে চেয়ে দেখলুম, সেজের আলোটা ক্রমে কাঁপতে কাঁপতে নিবে গেল। আমার মাথায় বোধহয় তখন রক্ত বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল, আমার মনে হতে লাগল কে যেন মশারির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বলছে, ‘আমার কঙ্কালটা কোথায় গেল? আমার কঙ্কালটা কোথায় গেল?’ ক্রমে মনে হতে লাগল যে দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। এই আমার মাথায় গল্প এসে গেল আর কি।’
সীতাদেবীর ‘পুণ্যস্মৃতি’র কথাই আবার বলি ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প সম্পর্কে। সীতাদেবী লিখেছেন, আমি বললুম, ‘মেয়েরা খুব যা তা বকতে ভালোবাসে, ছেলেরা গুরুগম্ভীর বিষয় না হলে কথাই বলতে চায় না।’ রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘যা-তা গল্পই তো গল্প। আমার ভারী soothing লাগে। ছোট ছেলের সঙ্গে ছোট মেয়ের ওইখানে প্রভেদ। অভি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে সারাদিন ওইরকম বলে যেত।’ আমি বলিলাম, ‘কাবুলিওয়ালার মিনির মতো?’ কবি বলিলেন, ‘বেলাটা ঠিক অমনি ছিল, মিনির কথা প্রায় তার কথাই সব তুলে দিয়েছি।’ একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টই জানিয়ে দেন, ‘কাবুলিওয়ালা বাস্তব ঘটনা নয়। মিনি আমার বড় মেয়ের আর্দশে রচিত।’
‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’-এ মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন রবীন্দ্র-বয়ানে ‘সমাপ্তি’ গল্পের জন্মের কথা : ‘দেখতুম কি না বোট থেকে মেয়েরা ঘাটে আসত, কেউ বা ছেলে কোলে, কেউ বা একপাঁজা বাসন নিয়ে, কেউ বা কলসি কাঁখে। ও-ই দশ-এগারো বছরের মেয়েটা, ছোট ছোট করে চুল ছাঁটা, কাঁখে একটা ছেলে নিয়ে রোজ আসত। রোগা রোগা দেখতে, শ্যামলা রং। বোটের উপর আমাকে সবাই দেখত, কিন্তু ওর দেখাটা ছিল অন্যরকম।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে কোলের ছেলেটাকে আমাকে দেখাত আঙুল দিয়ে ঃ ‘ওই দেখ’। আমার ভারী মজা লাগত ৷ এমন একটা স্বাভাবিক স্ফূর্তি চঞ্চলতা ছিল তার, যা ও বয়সের জড়সড় বাঙালি মেয়েদের বেশি দেখা যায় না। তারপর একদিন দেখলুম বধূবেশে শ্বশুরবাড়ি চলল সেই মেয়ে, সেই ঘাটে নৌকো বাঁধা। কী তার কান্না! অন্য মেয়েদের বলাবলি কানে এল : ‘যা দুরন্ত মেয়ে।
কী হবে এর শ্বশুরবাড়িতে?’ ভারী দুঃখ হল তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দেখে। চঞ্চলা হরিণীকে বন্দিনী করবে। ওর কথা মনে করেই এই গল্পটা লিখেছিলুম। ওই বোটে বাংলাদেশের গ্রামের এমন একটা সজীব ছবি দেখেছি যা অনেকে দ্যাখেনি।’ এই গল্পের জন্মসূত্রের কথা ইন্দিরা দেবীকেও ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১২৯৮ থেকে ১৩০২ ‘হিতবাদী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকায় ৪৪টি গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর আবার ১৩০৫ থেকে ১৩০৭-এ ‘ভারতী’, ‘প্রদীপ’ ও ‘প্রভাত’ পত্রিকায় লিখেছেন ১৫টি গল্প। এর পরে আরও গল্প লিখলেও সেগুলি সম্ভবত তাঁকেও আনন্দিত করেনি। শ্রীহেমন্তবালা দেবীকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন, ‘অল্প বয়সে বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে যখন আমার চোখে চোখে পরিচয় হয়েছিল।
তখন প্রতিদিন আমার মনে যে আনন্দের ধারা উদ্ভাসিত হয়েছিল তাই সহজে প্রবাহিত হয়েছিল ওই নিরলংকৃত সরল গল্পগুলির ভিতর দিয়ে। আমার নিজের বিশ্বাস এই আনন্দবিস্মিত দৃষ্টির ভিতর দিয়ে বাংলাদেশকে দেখা আমাদের সাহিত্যে আর কোথাও নেই। বাংলা পল্লীর সেই অন্তরঙ্গ আতিথ্য থেকে সরে এসেছি তাই সাহিত্যের সেই শ্যামছায়াশীতল নিভৃত বীথিকার ভিতর দিয়ে আমার বর্তমান মোটরচলা কলম আর কোনওদিন চলতেই পারবে না। আবার যদি শিলাইদহে বাসা উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারি তা হলে মন হয়তো আবার স্নিগ্ধ সরলতার মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে।’ এমন স্বীকারোক্তি আজকের কোনও বাঙালি লেখক দিতে পারবেন না, শনাক্ত করবেন না তাঁর ‘মোটরচলা কলম’-কে।

এই সব গল্প নিয়ে কত কথাই যে শুনতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। ১৯৪০- এর ২ মার্চ বাঁকুড়ার এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বললেন, “লোকে অনেক সময়ই আমার সম্বন্ধে সমালোচনা করে ঘরগড়া মত নিয়ে। বলে, উনি তো ধনী ঘরের ছেলে। ইংরেজিতে যাকে বলে রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন।
পল্লীগ্রামের কথা উনি কী জানেন? আমি বলতে পারি, আমার থেকে কম জানেন তাঁরা যাঁরা এমন কথা বলেন। কী দিয়ে জানেন তাঁরা? অভ্যাসের জড়তার ভিতর দিয়ে কী জানা যায়? যথার্থ জানায় ভালোবাসা। কুঁড়ির মধ্যে যে কীট জন্মেছে সে জানে না ফুলকে। জানে বাইরে থেকে যে পেয়েছে আনন্দ। আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লীগ্রামকে দেখেছি তাতেই তার হৃদয়ের দ্বার খুলে গিয়েছে। আজ বললে অহঙ্কারের মতো শোনাবে, তবু বলব আমাদের দেশের খুব অল্প লেখকই এই রসবোধের চোখে বাংলাদেশকে দেখেছেন। আমার রচনাতে পল্লীপরিচয়ের যে অন্তরঙ্গতা আছে, কোনও বাঁধাবুলি দিয়ে তার সত্যতাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। সেই পল্লীর প্রতি যে একটা আনন্দময় আকর্ষণ আমার যৌবনের মুখে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, আজও তা যায়নি।’
১৩৪৮-এর ‘পরিচয়’ পত্রিকায় হরপ্রসাদ মিত্র ‘গল্পগুচ্ছের রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। যেন এই প্রথম তিনি গল্পলেখক হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন। ১৯৪১-এর ২৬ মে রানি চন্দকে চিঠি লিখলেন, ‘আমি এতদিন পরে একটি বিষয়ে ভারী খুশি হয়েছি—এইবারের ‘পরিচয়’-এ একটা অ্যাকিউরেট সমালোচনা প্রকাশ করেছে।
‘আমাদের দেশের লোকেরা স্বীকার করেনি কখনও যে আমার ছোট গল্পগুলোর কোনও লিটারেরি ভ্যালু আছে। এডওয়ার্ড টমসন আমাকে বলেছিল যে, তোমার এই গল্পগুলিতে গল্পের যে একটা আসল রস, তা আছে। অন্যান্য লেখার তুলনায় এগুলো অনেক বড়।’
‘সম্পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে এরকম রচনা খুব কম লিখেছি।’ ‘বাংলাদেশের যে একটা মাহাত্ম্য আছে—আমার আগে এ আর কেউ দ্যাখেনি এই চোখে। আমাদের দেশের লোকের ধারণা আছে যে আমি কী করে বুঝব— আমি কি তাদের মধ্যে থেকেছি, দেখেছি। আমি হলুম বড়লোক; গরিবের বেদনা, দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের ওঠানামা- —তার আমি কি জানি । ‘আমি চুপ করে সব সহ্য করেই গেছি।…’
একজন লোককে এভাবেই চারপাশের সব ভুল ব্যাখ্যা, দুর্বিনয় সহ্য করে যেতে হয়। কিন্তু তিনি জানেন, তাঁর পরেও বাংলাদেশের আত্মাকে ছুঁতে কেউ কেউ আসবে। একজন জীবনানন্দ দাশ। একজন ঋত্বিক ঘটক। এভাবেই বেঁচে থাকে গিরিবালা মৃন্ময়ী, মৃণালেরা। এর পূরবী যে ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাবে, এ তাঁর অন্তরের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ছাড়া কোনও রচনাই মহাবিশ্বের আত্মাকে ছুঁতে পারে না।