আমার রবীন্দ্রনাথ- রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত

বাংলা নাট্যাঙ্গনের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত একাধারে অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও শিক্ষক হিসেবে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে মঞ্চশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। বহুমাত্রিক অভিনয়শৈলী, সংলাপের নিখুঁত উচ্চারণ এবং চরিত্রের গভীরে প্রবেশের ক্ষমতার জন্য তিনি বাংলা থিয়েটারের এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছেন। “নান্দীকরণ” নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি অসংখ্য প্রযোজনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ের মাধ্যমে সমসাময়িক মঞ্চকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন।

আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক, শৈশব ও যৌবনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও নাট্যচিন্তার প্রভাব, এবং মঞ্চনাট্যে রবীন্দ্রনাথের পাঠ থেকে প্রাপ্ত অভিনয়-দর্শন। একজন নাট্যশিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির এই বিশ্লেষণ পাঠককে কেবল সাহিত্যিক নয়, বরং নাট্য-রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে অনুধাবনের সুযোগ করে দেবে।

 

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত

 

আমার শৈশবে যে খুব একটা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা, | কবিতা বা গানের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে, তেমনটা নয়। ছেলেবেলায় ঠিক নিয়ম করে ওঁর লেখা আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। বরং তিনি বার বার আচমকা এসেছেন—অনেকটা দমকা হাওয়ার মতো। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, সাহিত্যচর্চা বিষয়টাই ঠিক রুটিন মেনে আমি করিনি কখনও। এমনকী যে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমার পেশাগত জীবন, সেই সাহিত্যও আমি নিয়ম করে পড়িনি।

এ সবই এসেছে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো, আর তাতেই ঝলমল করে উঠেছি আমি। সাধারণ বাঙালি পরিবারগুলিতে যেমন বাড়ির ছোটদের নিয়ম করে শিশু ভোলানাথ, সহজপাঠ ইত্যাদি পড়ানো হয়, আমাদের বাড়িতে সে সবের চল ছিল না। একটু অন্য রকম একটা ব্যাপার ছিল সেখানে। যেটা আমার চিন্তা-চেতনার জগৎকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল। আমার মেজদা ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক।

বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে রাখতেন শেক্সপিয়র বা রবীন্দ্রনাথের কোনও পংক্তি। যেমন দোতলায় যে ঘরে থাকতাম, তার দেওয়ালে লেখা ছিল—‘মনেরে আজ কহ যে, ভালোমন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে। দিদি, সেজদা সারাক্ষণ ঘুরে-ফিরে নানান কবিতা আবৃত্তি করতেন, তর্ক করতেন, আলোচনা করতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথও ছিল।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল
আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল

 

আমি মন দিয়ে শুনতাম। আর এমন করেই ছেলেবেলার, কৈশোরের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া—তাঁর সাহিত্যগুণ, সাংগীতিক বিরাটত্ব ও মূল্যবোধ আমার ভিতর সঞ্চারিত হওয়া। পরবর্তী জীবনেও এই passing gift-এর মতো রবীন্দ্রনাথের রচনা বার বার এসেছে। বাংলাদেশ থেকে মাঝে মধ্যেই কলকাতায় আসতেন জমিল আহমেদ— থিয়েটারের প্রশিক্ষণ দিতে। অবসর সময়ে সারাদিন চলত তাঁর এলপি রেকর্ড।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ওঁর খুব প্রিয় শিল্পী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমিও শুনতাম সেই গান, সমৃদ্ধ হতাম। তবে যখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানাবিধ বিপন্নতা জড়ো হল মনের মধ্যে, sense of mortality বাসা বাঁধল—তখন থেকে শুরু হল আমার নিয়মিত রবীন্দ্রনাথ পড়া। একজন মানুষ জীবনে কত ঝড়-ঝঞ্ঝা সামলেছেন। তার পরেও জীবনকে ভালোবাসার কথাই বলে গিয়েছেন বার বার। আরও বেশি করে আমি ওঁর চেতনের কাছাকাছি এলাম, যখন ১৯২৪ সালে বুয়েনাস এয়ার্স-এ এলমহার্স্ট-এর সঙ্গে ওঁর কথোপকথন পড়লাম।

ছোটদের থিয়েটার নিয়ে ওঁর এত গভীর ও বিস্তৃত ভাবনা—মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ছোটদের শরীর ও মন- এই দুইয়ের টানাপোড়েনটা ঠিক কেমন, আর ছোটদের থিয়েটার করতে গেলে প্রশিক্ষক বা নির্দেশক কীভাবে সেগুলিকে deal করবেন, এ সব নিয়ে আলোচনা। ছোটদের থিয়েটার নিয়ে যাবতীয় কাজকর্মের পিছনে ওই লেখাটিই ছিল আমার মূল চাবিকাঠি।

আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের মানুষ তিনি। অন্নদাশংকর তাঁকে বলতেন জীবনশিল্পী। শরীরচর্চা থেকে সাহিত্য— সবেতেই তাঁর অবাধ যাতায়াত। এবার নাটকের প্রসঙ্গে আসি। আমার তো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের নাটকের সঠিক মূল্যায়ন খুব কম হয়েছে। বাংলায় ওঁর নাটকের যথাযথ রূপায়ণ যদি কেউ করে থাকেন, তবে তিনি শম্ভু মিত্র। রক্তকরবী থেকে ডাকঘর—রবীন্দ্রনাথের নাটকের এই যে বিশাল ব্যাপ্তি, এটা একমাত্র উনিই সম্পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং সে কারণেই বাংলা থিয়েটারের মাইলস্টোন প্রোডাকশনগুলির জন্ম সম্ভব হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের নাটক ওঁর অন্তস্থলে এত গভীর ভাবে ছিল বলেই ‘চাঁদ বণিকের পালা’র মতো নাটক সৃষ্টি হয়, যা বোধহয় আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ নাটক। রবীন্দ্রনাথের নাটকের সম্পর্কে বলা যায়, ‘It’s a journey of a an Indian, in search of a new dramatic language. ওঁর সমনে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের থিয়েটার সংক্রান্ত কাজকর্ম সম্পর্কে উনি যে কতটা সচেতন ছিলেন, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ পাওয়া যায় চার অধ্যায় নাটকে। সেখানে অন্ত ও এলার কথোপকথনে তিনি ব্যবহার করেছেন হেনরিক ইবসেনের অপেক্ষাকৃত অ-নামী একটি নাটকের একটি সংলাপ। এর পরেও যখন আমাদের দেশের পুরস্কারপ্রাপ্ত ও

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যকারেরা এই মানুষটির নাটককে যোগ্য মর্যাদা দেন না, তখন অত্যন্ত ব্যথিত হই। আবার পিএল দেশপাণ্ডের মতো মানুষও আছেন। অত্যন্ত রবীন্দ্রভক্ত—নিজের উদ্যোগে বাংলা শিখেছেন, শান্তিনিকেতনেও নিয়মিত আসেন। মনে আছে, National Theatre Festival-এ একবার তিনি নান্দীকারকে বাংলায় শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন। তাই যত কু-মন্তব্যই তাঁর নাটকের সম্পর্কে করা হোক না কেন, ভারতবর্ষের থিয়েটারে ওঁর অবদান অনস্বীকার্য।

আর ব্যক্তি আমি-র কথা যদি বলি, তিনি এখন আমার জীবনে নানাভাবে আছেন—কখনও সখা, কখনও সচিব, কখনও বা স্নোহাস্পদ। নানান রূপে যেন তিনি প্রতিভাত হন প্রতি মুহূর্তে। নানা ছলে বার বার আমাকে চ্যালেঞ্জ করে চলেন— নিজের মনকে কাঁচা রাখতে হয়, সংবেদনশীল রাখতে। যাতে আমি এই ক্ষুদ্র জীবনে আরও আরও কিছু ভালো কাজ মানুষের জন্য রেখে যেতে পারি।

মন্তব্য করুন