“আকুল আহ্বান” (Akul Ahban) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু (১৯০৩) কাব্যগ্রন্থের একটি মর্মস্পর্শী কবিতা। এই কবিতায় এক মায়ের প্রিয় সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য গভীর ব্যাকুলতা, অশ্রুভেজা অপেক্ষা এবং হারানোর বেদনা ফুটে উঠেছে। সহজ কিন্তু আবেগপূর্ণ ভাষা, প্রকৃতির চিত্র এবং মাতৃত্বের অনন্য আবেদন এই কবিতাটিকে শিশু কাব্যের অন্যতম হৃদয়গ্রাহী রচনা করে তুলেছে।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ: শিশু
প্রকাশকাল: ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ (১৩১০ বঙ্গাব্দ)
কবিতার নাম: আকুল আহ্বান
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: মাতৃস্নেহ, বেদনা, আকুলতা
আকুল আহ্বান – কবিতার পাঠ
সন্ধে হল, গৃহ অন্ধকার —
মা গো, হেথায় প্রদীপ জ্বলে না।
একে একে সবাই ঘরে এল,
আমায় যে মা, “মা’ কেউ বলে না।
সময় হল, বেঁধে দেব চুল,
পরিয়ে দেব রাঙা কাপড়খানি।
সাঁঝের তারা সাঁঝের গগনে —
কোথায় গেল রানী আমার রানী।
রাত্রি হল, আঁধার করে আসে,
ঘরে ঘরে প্রদীপ নিবে যায়।
আমার ঘরে ঘুম নেইকো শুধু —
শূন্য শেজ শূন্য-পানে চায়।
কোথায় দুটি নয়ন ঘুমে-ভরা,
নেতিয়ে-পড়া ঘুমিয়ে-পড়া মেয়ে।
শ্রান্ত দেহ ঢুলে পড়ে, তবু
মায়ের তরে আছে বুঝি চেয়ে।
আঁধার রাতে চলে গেলি তুই,
আঁধার রাতে চুপি চুপি আয়।
কেউ তো তোরে দেখতে পাবে না,
তারা শুধু তারার পানে চায়।
এ জগৎ কঠিন — কঠিন —
কঠিন, শুধু মায়ের প্রাণ ছাড়া–
সেইখানে তুই আয় মা, ফিরে আয়–
এত ডাকি, দিবি নে কি সাড়া।
ফুলের দিনে সে যে চলে গেল,
ফুল-ফোটা সে দেখে গেল না,
ফুলে ফুলে ভরে গেল বন
একটি সে তো পরতে পেল না।
ফুল সে ফোটে ফুল যে ঝরে যায়–
ফুল নিয়ে যে আর-সকলে পরে,
ফিরে এসে সে যদি দাঁড়ায়,
একটিও যে রইবে না তার তরে।
খেলত যারা তারা খেলতে গেছে,
হাসত যারা তারা আজো হাসে,
তার তরে তো কেহই বসে নেই,
মা যে কেবল রয়েছে তার আশে।
হায় রে বিধি, সব কি ব্যর্থ হবে–
ব্যর্থ হবে মায়ের ভালোবাসা।
কত জনের কত আশা পূরে,
ব্যর্থ হবে মার প্রাণেরই আশা।
ভাবার্থ
এই কবিতায় কবি মায়ের হৃদয়ের গভীর শূন্যতা ও ব্যাকুলতার ছবি এঁকেছেন। সন্তান হারিয়ে মা যেন প্রতিটি সন্ধ্যা, প্রতিটি রাত তার প্রতীক্ষায় কাটায়। প্রকৃতির দৃশ্যপট, ফুলের ঋতু, হাসিখুশি মানুষের ভিড়—সবই সেই প্রিয়জনের অনুপস্থিতিতে শূন্য মনে হয়। কবিতায় মাতৃত্বের অটল ভালোবাসা ও হারানোর যন্ত্রণার করুণ সুর ধ্বনিত হয়েছে।
শব্দার্থ
আকুল আহ্বান: ব্যাকুল ডাকে আহ্বান জানানো
শূন্য শেজ: ফাঁকা শয্যা
নেতিয়ে-পড়া: নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়া
বিধি: ভাগ্য, নিয়তি
সাঁঝের তারা: সন্ধ্যার প্রথম তারা