“উপহার” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু (১৯০৩) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটিতে কবি এক বিশেষ উপহারের কথা বলেছেন, যা বস্তুগত নয় বরং হৃদয়ের গভীর স্নেহ, আশীর্বাদ ও শুভকামনা দিয়ে গঠিত। কবি এখানে জীবনের পথে নবীন প্রজন্মের প্রতি এক অমূল্য মানসিক উপহার তুলে ধরেছেন, যা চিরকাল স্মৃতিতে থেকে যাবে।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ: শিশু (১৯০৩)
কবিতার নাম: উপহার
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: স্নেহ, আশীর্বাদ, জীবনদর্শন
উপহার – কবিতার পাঠ
স্নেহ-উপহার এনে দিতে চাই,
কী যে দেব তাই ভাবনা —
যত দিতে সাধ করি মনে মনে
খুঁজে-পেতে সে তো পাব না।
আমার যা ছিল ফাঁকি দিয়ে নিতে
সবাই করেছে একতা,
বাকি যে এখন আছে কত ধন
না তোলাই ভালো সে কথা।
সোনা রুপো আর হীরে জহরত
পোঁতা ছিল সব মাটিতে,
জহরি যে যত সন্ধান পেয়ে
নে গেছে যে যার বাটীতে।
টাকাকড়ি মেলা আছে টাকশালে,
নিতে গেলে পড়ি বিপদে।
বসনভূষণ আছে সিন্দুকে,
পাহারাও আছে ফি পদে।
এ যে সংসারে আছি মোরা সবে
এ বড়ো বিষম দেশ রে।
ফাঁকিফুঁকি দিয়ে দূরে চ’লে গিয়ে
ভুলে গিয়ে সব শেষ রে।
ভয়ে ভয়ে তাই স্মরণচিহ্ন
যে যাহারে পারে দেয় যে।
তাও কত থাকে, কত ভেঙে যায়,
কত মিছে হয় ব্যয় যে।
স্নেহ যদি কাছে রেখে যাওয়া যেত,
চোখে যদি দেখা যেত রে,
কতগুলো তবে জিনিস-পত্র
বল্ দেখি দিত কে তোরে।
তাই ভাবি মনে কী ধন আমার
দিয়ে যাব তোরে নুকিয়ে,
খুশি হবি তুই, খুশি হব আমি,
বাস্, সব যাবে চুকিয়ে।
কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে
কিনে রেখে দেব মন তোর —
এমন আমার মন্ত্রণা নেই,
জানি নে ও হেন মন্তর।
নবীন জীবন, বহুদূর পথ
পড়ে আছে তোর সুমুখে;
স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই
পিয়ে নিস এক চুমুকে।
সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে
নব আশে নব পিয়াসে,
যদি ভুলে যাস, সময় না পাস,
কী যায় তাহাতে কী আসে।
মনে রাখিবার চির-অবকাশ
থাকে আমাদেরই বয়সে,
বাহিরেতে যার না পাই নাগাল
অন্তরে জেগে রয় সে।
পাষাণের বাধা ঠেলেঠুলে নদী
আপনার মনে সিধে সে
কলগান গেয়ে দুই তীর বেয়ে
যায় চলে দেশ-বিদেশে —
যার কোল হতে ঝরনার স্রোতে
এসেছে আদরে গলিয়া
তারে ছেড়ে দূরে যায় দিনে দিনে
অজানা সাগরে চলিয়া।
অচল শিখর ছোটো নদীটিরে
চিরদিন রাখে স্মরণে —
যতদূর যায় স্নেহধারা তার
সাথে যায় দ্রুতচরণে।
তেমনি তুমিও থাক না’ই থাক,
মনে কর মনে কর না,
পিছে পিছে তব চলিবে ঝরিয়া
আমার আশিস-ঝরনা॥
ভাবার্থ
কবি এখানে প্রিয়জনের জন্য এমন এক উপহারের কথা বলেছেন, যা টাকা-পয়সা, সোনা-রুপো কিংবা বস্তুগত সম্পদ নয়; বরং অন্তরের স্নেহ, ভালোবাসা এবং আশীর্বাদ। এই উপহার সময়ের সঙ্গে নষ্ট হয় না, হারায় না, বরং জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় সবসময় সঙ্গী হয়ে থাকে। কবিতায় নদী ও ঝরনার প্রতীক দিয়ে চিরন্তন স্নেহধারার উপস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
শব্দার্থ
স্মরণচিহ্ন: স্মৃতি রাখার বস্তু বা প্রতীক
টাকশাল: সরকারি মুদ্রা তৈরির স্থান
বিষম দেশ: বিপদসংকুল পৃথিবী
পাষাণ: পাথর
আশিস-ঝরনা: আশীর্বাদের ধারাবাহিক স্রোত