“ছুটির দিনে” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু (১৯০৩) কাব্যগ্রন্থের একটি জনপ্রিয় কবিতা, যেখানে শৈশবের ছুটির দিনের আবহ, প্রকৃতির বর্ণনা এবং শিশুমনের কল্পনার উড়ান অপূর্বভাবে ফুটে উঠেছে। কবি এখানে এক শিশুর দৃষ্টিতে বর্ষার দিন, আকাশের মেঘ, বৃষ্টি, রাজপুত্তুর ও তেপান্তরের মাঠের স্বপ্নিল জগৎকে কাব্যিক রূপে এঁকেছেন। কবিতাটি প্রকৃতি ও রূপকথার মিশেলে এক অনন্য কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছে।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ: শিশু (১৯০৩)
কবিতার নাম: ছুটির দিনে
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: শৈশব, কল্পনা, প্রকৃতি, বর্ষা, রূপকথা
ছুটির দিনে – কবিতার পাঠ
ওই দেখো মা, আকাশ ছেয়ে
মিলিয়ে এল আলো,
আজকে আমার ছুটোছুটি
লাগল না আর ভালো।
ঘণ্টা বেজে গেল কখন,
অনেক হল বেলা।
তোমায় মনে পড়ে গেল,
ফেলে এলেম খেলা।
আজকে আমার ছুটি, আমার
শনিবারের ছুটি।
কাজ যা আছে সব রেখে আয়
মা তোর পায়ে লুটি।
দ্বারের কাছে এইখানে বোস,
এই হেথা চোকাঠ —
বল্ আমারে কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
ওই দেখো মা, বর্ষা এল
ঘনঘটায় ঘিরে,
বিজুলি ধায় এঁকেবেঁকে
আকাশ চিরে চিরে।
দেব্তা যখন ডেকে ওঠে
থর্থরিয়ে কেঁপে
ভয় করতেই ভালোবাসি
তোমায় বুকে চেপে।
ঝুপ্ঝুপিয়ে বৃষ্টি যখন
বাঁশের বনে পড়ে
কথা শুনতে ভালোবাসি
বসে কোণের ঘরে।
ওই দেখো মা, জানলা দিয়ে
আসে জলের ছাট —
বল্ গো আমায় কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
কোন্ সাগরের তীরে মা গো,
কোন্ পাহাড়ের পারে,
কোন্ রাজাদের দেশে মা গো,
কোন্ নদীটির ধারে।
কোনোখানে আল বাঁধা তার
নাই ডাইনে বাঁয়ে?
পথ দিয়ে তার সন্ধেবেলায়
পৌঁছে না কেউ গাঁয়ে?
সারা দিন কি ধূ ধূ করে
শুকনো ঘাসের জমি?
একটি গাছে থাকে শুধু
ব্যাঙ্গমা-বেঙ্গমী?
সেখান দিয়ে কাঠকুড়ুনি
যায় না নিয়ে কাঠ?
বল্ গো আমায় কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
এমনিতরো মেঘ করেছে
সারা আকাশ ব্যেপে,
রাজপুত্তুর যাচ্ছে মাঠে
একলা ঘোড়ায় চেপে।
গজমোতির মালাটি তার
বুকের ‘পরে নাচে–
রাজকন্যা কোথায় আছে
খোঁজ পেলে কার কাছে।
মেঘে যখন ঝিলিক মারে
আকাশের এক কোণে
দুয়োরানী-মায়ের কথা
পড়ে না তার মনে?
দুখিনা মা গোয়াল-ঘরে
দিচ্ছে এখন ঝাঁট,
রাজপুত্তুর চলে যে কোন্
তেপান্তরের মাঠ।
ওই দেখো মা, গাঁয়ের পথে
লোক নেইকো মোটে,
রাখাল-ছেলে সকাল করে
ফিরেছে আজ গোঠে।
আজকে দেখো রাত হয়েছে
দিস না যেতে যেতে,
কৃষাণেরা বসে আছে
দাওয়ায় মাদুর পেতে।
আজকে আমি নুকিয়েছি মা,
পুঁথিপত্তর যত–
পড়ার কথা আজ বোলো না।
যখন বাবার মতো।
বড়ো হব তখন আমি
পড়ব প্রথম পাঠ —
আজ বলো মা, কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
ভাবার্থ
এই কবিতায় একটি শিশু তার মায়ের কাছে বর্ষার দিনের ছুটিতে কল্পনার জগৎ নিয়ে প্রশ্ন করে। তেপান্তরের মাঠ, রাজপুত্তুর, রাজকন্যা, পাহাড়, সাগর, বৃষ্টি—এসবই শিশুমনের রূপকথা আর প্রকৃতির মিলিত ক্যানভাস। কবি শিশুর দৃষ্টিতে বর্ষার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অজানার প্রতি কৌতূহলকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
শব্দার্থ
তেপান্তরের মাঠ: অসীম, দূরবর্তী, কল্পিত বিরান জমি
ব্যাঙ্গমা-বেঙ্গমী: রূপকথার চরিত্র, এক জোড়া ব্যাঙরাজ ও ব্যাঙরানি
গজমোতি: হাতির দাঁত ও মুক্তার মালা
দুখিনা: গৃহস্থালির কাজকর্মে ব্যস্ত নারী, এখানে স্নেহময়ী মা বা সৎমা বোঝানো হয়েছে