শিশু কাব্যগ্রন্থের শীত কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । Sheet Kobita

“শীত” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু (১৯০৩) কাব্যগ্রন্থের একটি প্রকৃতি-ভিত্তিক প্রতীকী কবিতা। এখানে শীত ঋতুকে এক জ্ঞানী, গম্ভীর, স্থিরচেতা চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যিনি জীবনের চলমানতা, খেলা ও রঙিনতা থেকে দূরে সরে যান। পাখি, ফুল, কিশলয় ও মলয়বাতাস—সবাই যেন তার প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। কবিতায় বসন্তের সাথে এর তীব্র বৈপরীত্য তুলে ধরা হয়েছে—যেখানে বসন্ত আসে নতুন প্রাণ, আনন্দ ও উচ্ছ্বাস নিয়ে।

কবিতার মৌলিক তথ্য

  • কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • কাব্যগ্রন্থ: শিশু

  • প্রকাশকাল: ১৯০৩

  • কবিতার নাম: শীত (Sheet)

  • বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: ঋতু-কবিতা, প্রকৃতি, প্রতীকী কাব্য

 

 

শীত – কবিতার পাঠ

পাখি বলে “আমি চলিলাম’,

          ফুল বলে “আমি ফুটিব না’,

মলয় কহিয়া গেল শুধু

          “বনে বনে আমি ছুটিব না’।

কিশলয় মাথাটি না তুলে

          মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি,

সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস

          টানি দিল মুখের উপরি।

পাখি কেন গেল গো চলিয়া,

          কেন ফুল কেন সে ফুটে না।

চপল মলয় সমীরণ

          বনে বনে কেন সে ছুটে না।

শীতের হৃদয় গেছে চলে,

          অসাড় হয়েছে তার মন,

ত্রিবলিবলিত তার ভাল

          কঠোর জ্ঞানের নিকেতন।

জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ,

          ফুলের যৌবন পরিমল,

মলয়ের বাল্যখেলা যত,

          পল্লবের বাল্য-কোলাহল–

সকলি সে মনে করে পাপ,

         মনে করে প্রকৃতির ভ্রম,

ছবির মতন বসে থাকা

         সেই জানে জ্ঞানীর ধরম।

তাই পাখি বলে “চলিলাম’,

         ফুল বলে “আমি ফুটিব না’।

মলয় কহিয়া গেল শুধু

         “বনে বনে আমি ছুটিব না’।

আশা বলে “বসন্ত আসিবে’,

         ফুল বলে “আমিও আসিব’,

পাখি বলে “আমিও গাহিব’,

         চাঁদ বলে “আমিও হাসিব’।

বসন্তের নবীন হৃদয়

         নূতন উঠেছে আঁখি মেলে–

যাহা দেখে তাই দেখে হাসে,

         যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে।

মনে তার শত আশা জাগে,

         কী যে চায় আপনি না বুঝে–

প্রাণ তার দশ দিকে ধায়

         প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে।

ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে–

         পাখি গায়, সেও গান গায়–

বাতাস বুকের কাছে এলে

         গলা ধ’রে দুজনে খেলায়।

তাই শুনি “বসন্ত আসিবে’

         ফুল বলে “আমিও আসিব’,

পাখি বলে “আমিও গাহিব’,

         চাঁদ বলে “আমিও হাসিব’।

শীত, তুমি হেথা কেন এলে।

            উত্তরে তোমার দেশ আছে–

পাখি সেথা নাহি গাহে গান,

            ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে।

সকলি তুষারমরুময়,

            সকলিআঁধার জনহীন–

সেথায় একেলা বসি বসি

            জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।

ভাবার্থ

কবিতায় শীত ঋতুকে স্থির, গম্ভীর, উদাসীন ও একাকী এক ‘জ্ঞানী’ চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার প্রভাবে প্রকৃতি থেকে প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে গেছে—পাখি উড়ে যায়, ফুল ফোটে না, কিশলয় ঝরে পড়ে, বাতাস আর খেলে না। শীত যেন জীবনের আনন্দকে ‘প্রকৃতির ভ্রম’ ভেবে তা প্রত্যাখ্যান করে। অপরদিকে বসন্ত নতুন জীবন, প্রেম, উচ্ছ্বাস ও সৃষ্টিশীলতার প্রতীক—যেখানে সবকিছুই প্রাণবন্ত ও সজীব। কবি প্রশ্ন তুলেছেন, আনন্দ ও জীবনের উৎস যেখানে, সেখানে শীত কেন এসেছিল—তার স্বাভাবিক বাসভূমি তো উত্তরাঞ্চলের তুষার-শূন্য মরুভূমি।

শব্দার্থ

  • মলয়: মৃদুমন্দ গরম হাওয়া (মলয় সমীরণ)

  • কিশলয়: নতুন জন্মানো কচি পাতা

  • ত্রিবলিবলিত: তিনবার পাকানো বা মুড়ানো (রূপক অর্থে গভীরভাবে বাঁধা)

  • নিকেতন: বসবাসের স্থান বা আবাস

  • তুষারমরুময়: তুষার-আবৃত নির্জন প্রান্তর

মন্তব্য করুন