আমি কবিতাটি [Ami Kobita] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের অংশ। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটি গদ্যছন্দে রচিত এবং কবিগুরুর “অন্ত্যপর্ব”-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। শ্যামলী গ্রন্থে মোট ২১টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা ব্যক্তিসত্তা, প্রকৃতি, দর্শন ও মানবমনের গভীর উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে রচিত। ‘আমি’ কবিতায় কবি মানবসত্তার সৃষ্টিশীল অহংকার, বিশ্বসৌন্দর্যের সাথে মানুষের আত্মপরিচয়ের মিলন এবং মহাজাগতিক সত্যের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে গভীর দার্শনিক ও নান্দনিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন।
কবিতার মৌলিক তথ্য
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ: শ্যামলী
কবিতার নাম: আমি
প্রকাশকাল: ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: দর্শনমূলক ও সত্তাবাদী কবিতা
আমি – কবিতার পাঠ
আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আ-মি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,
সুন্দর হল সে।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
এ কবির বাণী নয়।
আ-মি বলব, এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।
তত্ত্বজ্ঞানী জপ করছেন নিশ্বাসে প্রশ্বাসে,
না, না, না–
না-পান্না, না-চুনি, না-আলো, না-গোলাপ,
না-আ-মি, না-তুমি।
ও দিকে, অসীম যিনি তিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা
মানুষের সীমানায়,
তাকেই বলে “আ-মি’।
সেই আ-মির গহনে আলো-আঁধারের ঘটল সংগম,
দেখা দিল রূপ, জেগে উঠল রস।
“না’ কখন ফুটে উঠে হল “হাঁ’ মায়ার মন্ত্রে,
রেখায় রঙে সুখে দুঃখে।
একে বোলো না তত্ত্ব;
আমার মন হয়েছে পুলকিত
বিশ্ব-আ-মির রচনার আসরে
হাতে নিয়ে তুলি, পাত্রে নিয়ে রঙ।
পণ্ডিত বলছেন–
বুড়ো চন্দ্রটা, নিষ্ঠুর চতুর হাসি তার,
মৃত্যুদূতের মতো গুঁড়ি মেরে আসছে সে
পৃথিবীর পাঁজরের কাছে।
একদিন দেবে চরম টান তার সাগরে পর্বতে;
মর্তলোকে মহাকালের নূতন খাতায়
পাতা জুড়ে নামবে একটা শূন্য,
গিলে ফেলবে দিনরাতের জমাখরচ;
মানুষের কীর্তি হারাবে অমরতার ভান,
তার ইতিহাসে লেপে দেবে
অনন্ত রাত্রির কালি।
মানুষের যাবার দিনের চোখ
বিশ্ব থেকে নিকিয়ে নেবে রঙ,
মানুষের যাবার দিনের মন
ছানিয়ে নেবে রস!
শক্তির কম্পন চলবে আকাশে আকাশে,
জ্বলবে না কোথাও আলো।
বীণাহীন সভায় যন্ত্রীর আঙুল নাচবে,
বাজবে না সুর।
সেদিন কবিত্বহীন বিধাতা একা রবেন বসে
নীলিমাহীন আকাশে
ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত্ব নিয়ে।
তখন বিরাট বিশ্বভুবনে
দূরে দূরান্তে অনন্ত অসংখ্য লোকে লোকান্তরে
এ বাণী ধ্বনিত হবে না কোনোখানেই–
“তুমি সুন্দর’,
“আ-মি ভালোবাসি’।
বিধাতা কি আবার বসবেন সাধনা করতে
যুগযুগান্তর ধ’রে।
প্রলয়সন্ধ্যায় জপ করবেন–
“কথা কও, কথা কও’,
বলবেন “বলো, তুমি সুন্দর’,
বলবেন “বলো, আ-মি ভালোবাসি’?