সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুণী কবি ও প্রাবন্ধিক সিদ্ধার্থ রায় তাঁর সংবেদনশীল ভাষা, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ এবং গভীর ভাবনার জন্য পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প—সব ক্ষেত্রেই তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে মানবমনের নানা স্তর, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে সিদ্ধার্থ রায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির আলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর চোখে দেখা রূপে। শৈশবের পাঠ থেকে শুরু করে পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সঙ্গীত ও দর্শন কীভাবে তাঁর চিন্তাজগৎ ও সৃজনপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে, তা তিনি আন্তরিক ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। পাঠকের কাছে এটি হবে এক কবি-প্রাবন্ধিকের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত রবীন্দ্রনাথ অন্বেষণ।
সেদিন শো ছিল বারাকপুরে। শো’য়ের শেষে ব্যান্ড-এর সবারই গঙ্গায় নৌকা চড়ার শখ হল। হালকা মিঠে হাওয়া দিচ্ছে, আকাশজুড়ে মেঘ-চাঁদের লুকোচুরি খেলা। মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে লাগছে। দাঁড়ে টান পড়তেই আপন মনে গেয়ে উঠলাম ‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে….আমি ডুবতে রাজি আছি।’ কী অদ্ভুত! একেবারে ‘হার্ড রক’ প্রোগ্রামের পর গঙ্গায় নৌকায় বসে আমার মনে পড়ল সেই রবীন্দ্রনাথই। গলা ছেড়ে, মনের আনন্দে গাইলাম বেশ কিছুক্ষণ।
বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব সীমিত। তাঁর গান আমরা গাইও না। পুরোপুরি রক অ্যান্ড রোল’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছি, থাকবও। সেজন্য কোনওদিনই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নাড়াচাড়া করার সাহস দেখাইনি। তবে আমাদের শেষ অ্যালবাম ‘তুচ্ছ’তে স্ক্যাট হিসাবে ‘তোমারও অসীমে প্রাণ মন লয়ে…’ থেকে চারটি লাইন ব্যবহার করেছি। আপনারা যারা বাংলা ব্যান্ড শুনতে অভ্যস্ত তারা বুঝতে পারবেন, আমরা গানের মাঝে স্ক্যাট ব্যবহার করি।
সেখানেই একটি গানের মাঝে মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ, তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই’—বলেই আবার মূল গানে চলে যাই। ব্যস, এইটুকুই। রবীন্দ্রনাথের গানে আমাদের যাতায়াত বলতে এই সামান্যই। হ্যাঁ, এই অ্যালবামের ‘ক্যাচ লাইন’-এর জন্য অবশ্য আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। তাঁর বিপুল সম্ভার থেকে ধার করেছি।— ‘ক্ষুদ্র আমি, তুচ্ছ আমি, মিথ্যা যত স্বাভিমান, আকাশ ভরা সূর্য তারা, জাগাও জাগাও আমার গান।’

রবীন্দ্রনাথের গান করবার আবদার আসে। আমরা এড়িয়ে যাই। এবারই যেমন একটি টি ভি চ্যানেল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে আমাদের গান করার অনুরোধ জানায়। এমনকী কোন গান আমাদের ব্যান্ডের পক্ষে উপযুক্ত হবে, তাও জানিয়ে দিয়েছিল। সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করি। কোনওভাবেই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে ভাঙাচোরা করতে চাইনি। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আমি এর বিরোধীও । বিদেশে শো করতে গেলে যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার অনুরোধ আসে তখন স্রেফ পিয়ানো ব্যাক আপ দিয়ে বহু শ্রুত, বহু চৰ্চিত ‘পুরানো সেই দিনের কথা…’ ধরিয়ে দিই। এবার গোটা হল গাইতে শুরু করে। এর বেশি কিছু নয়।
ঘরোয়া আড্ডায় মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই। এই ‘তো পিটসবার্গে সঙ্গীত শিক্ষিতা বনানী ঘোষের কাছে গাইলাম দু-একটা গান। উনি বললেন, বেশ ভালোই গাইলি। তা হলে চর্চা করিস না কেন।
সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে একটা ‘স্পিরিচ্যুয়াল ফ্লেভার’, ঈশ্বরের মতো। ঠিক বোঝাতে পারলাম কিনা জানি না। আসলে আমার কাছে ঈশ্বর মানে প্রকৃতি। আর রবীন্দ্রনাথ তো প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতি-সাধক। তাঁর প্রকৃতির বর্ণনায় অদ্ভুত আধ্যাত্মিকতা, পবিত্রতা। যা আমাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায়। আমি নিজেও পাহাড়ের কাছে গিয়ে হারিয়ে যাই, বিশালতার কাছে প্রার্থনা জানাই মনে মনে
ক্লিশে শোনালেও বলি, রবীন্দ্রনাথ হল ধ্রুব সত্য। কোনও কিছুই যেন হারায় না। তাঁর প্রেম, অনুভূতির প্রকাশ সবই সত্যি। ১৫০ বছর ধরেই আধুনিক, সময়ের উর্ধ্বে এক মানুষ। তিনি যেন এক যাত্রাপথ। মুক্তির যাত্রা।