প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের কন্যা ও ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের পরিচিত মুখ সুনেত্রা ঘটক কেবল অভিনয় জগতে নয়, লেখালেখিতেও নিজের স্বতন্ত্র স্বর প্রতিষ্ঠা করেছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়, শিল্পভাবনা এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে গভীরভাবে অনুভব করেন।
সম্প্রতি তিনি লিখেছেন “আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের একটি নিবন্ধ, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি, অনুরাগ এবং জীবনের নানা পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সঙ্গীত ও দর্শনের প্রভাব নিয়ে আত্মমগ্ন ও সংবেদনশীল আলোচনায় তিনি পাঠককে যুক্ত করেছেন।
আমার রবীন্দ্রনাথ- সুনেত্রা ঘটক

সাবানের ঠান্ডা গন্ধ, অবিরাম জল পড়ার শব্দ আর স্নান করতে করতে আমার মায়ের খোলা গলায় নিজের মনে গেয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে এইস…ব। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ মানে পঁচিশে বৈশাখের আনন্দ উৎসব নয়, বাইশে শ্রাবণের ব্যথা নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কিংবা বোলপুরের বিশ্বভারতী, আমি কোথাও তাঁকে তেমন করে পাই না যেমন পাই আমার মায়ের খোলা গলার গানে। তবে তাও যেমন তেমন কিংবা যখন তখন নয়। সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসা শেষ বিকেলে মা যখন অফিস থেকে ফিরে স্নানঘরে শুদ্ধ হতে যায়, তখন ।
আমার মা কখনও গান শেখেনি। কেন শেখেনি! এমন গলা! মা বলেন রবি ঠাকুরের গান তো তানের নয় প্রাণের, তাই। আসলে তাঁর মুখেই এমন কথা মানায়। কারণ বাড়ির পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষাই মাকে তৈরি করে দিয়েছিল। আর শেখার দরকার কি? এ কথা বলেন আমার বাবা । মা যখন কলঘরে তার প্রাণের গান গাইতে থাকে তখন জলের ঝিরঝিরে শব্দগুলো যেন সহস্র বীণা হয়ে গানের কথাগুলোকে সুরের সঙ্গে একাকার করে দিয়ে আমার শরীরে ঢুকে যায়। আমি বুঝতে পারি এখন আমার আর রক্ষা নেই।
আমি এখন কিছুই করতে পারব না শুধুই শুনে যাওয়া ছাড়া। তাই মা স্নানঘরে দরজা বন্ধ করলেই আমি বাইরে কান পাতি । আমি কিন্তু সব শব্দের অর্থ বুঝি না। সেদিন মা গাইছিল, ‘যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর/আর পারিনে রাত জাগতে, হে নাথ, ভাবতে অনিবার’। ‘অনিবার’ শব্দের অর্থে এসে আমি হোঁচট খেয়েছিলাম। আর মা-ও বোধহয় সব কথাগুলো জানা না থাকায় ঘুরে ফিরে ওই দুটো লাইনই গাইছিল। ফলে অর্থ না বুঝতে পারার যন্ত্রণায় আমি ছটফট করছিলাম। মাকে জিগ্যেস করতেই মা বলল, এবার তোমার ক্লাস সিক্স হল। সব কথার অর্থ জানতে চাইবে না। নিজে আবিষ্কার করার চেষ্টা কর। ভাবো, আরও ভাবো।
আমি ভাবতে থাকি, ভাবতেই থাকি। কুলকিনারা পাই না। মা বলে তুমি সত্যি ভাবছ! একটুও না থেমে। আমি বলি, সত্যিই ভাবছি, ননস্টপ। মা বলল, ননস্টপ ভাবতে পারছ আর ভাবতে অনিবার’ এত কঠিন হল বোঝার পক্ষে! ইশকুলে আমরা অনেক উঁচু ক্লাসে এসে বাংলা পড়তে শুরু করি। তাই শক্ত কথায় এসে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হয়। কিন্তু আমার মায়ের গান আর রবীন্দ্রনাথ এই দুইয়ে মিলে আমার স্টকে এখন অনেক বাংলা শব্দ।
সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আমার মাস্টারমশাই; এমনকি আমার ডিকশনারিও । কিন্তু শুধুই তা নয়। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে অনেক কিছু। আমার মায়ের একটা প্রিয় গান ‘কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে।’ দু-একদিন পরে পরেই মার মুখে গানটা শুনতে শুনতে এ গানটা আমার এমন আপনার হয়ে গেছে যে এর যে আলাদা কোনও মানে থাকতে পারে তাই আমার মাথায় আসেনি কখনও। মার কাছে জানতেও চাইনি। কিন্তু হঠাৎ যেদিন বিকেল হতে না হতেই অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আমাদের একরত্তি বাগানের কচি কচি গাছগুলো ভেজা ভেজা বাতাসে উথাল-পাথাল হতে থাকল, আমার হঠাৎই মনে এল ‘নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে’ এই কলিটি।

হঠাৎ মনে হল প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাসে গাছগুলো তো এখনই ছিঁড়ে ছুটে যাবে তবু যেন ওরা দারুণ আনন্দে আছে। সেই প্রথম বুঝলাম কান্নার সঙ্গে ভালোবাসার একট নিকট সম্পর্ক আছে, গভীর দুঃখের সঙ্গে আনন্দের। গাছেদের ভালো লাগা, চারপাশের প্রাকৃতিক উল্লাস আর আমার বুঝতে পারার ভালোলাগায় আমি কতক্ষণ বুঁদ হয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ চমক ফিরল যখন প্রথম বুঝতে পারলাম আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভী-ষ-ণ। ভী-ষ-ণ। কী একটা ব্যথা আমার গলার কাছটা চেপে ধরেছে। এরই মধ্যে ঝমাঝম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমার কষ্ট আমার ভালো লাগা সব কিছুকে ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা আমার সারা শরীর ঝাপটায় ভিজিয়ে দিল।
জলের ছাঁট থেকে ঘরদোর বাঁচাতে কখন যে মা জানলা বন্ধ করতে শুরু করেছে টের পাইনি। টের পেতেই জানতে চাইলাম ‘অভিসার’ মানে কি মা? মা বলল, অভিসার আবার কোথায় পেলে ? কেন তোমার গানে। আমার গানে অভিসার। ও, তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে। হ্যাঁ, ওখান থেকেই অভিসার মানে যাওয়া, কিন্তু যাওয়া ততটা নয়—যতটা যেতে চাওয়া। বলেই মা তার ঘর গেরস্থালি গুছোতে কোথায় যে উধাও হল…!
গমন মানে যদি যাওয়া হয় তাহলে অগম মানে যেখানে যাওয়া যায় না। অগম শব্দটার মানে বুঝতেই অভিসার-এর যেতে চাওয়া আর যেতে পারা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝলাম কেন ‘পরানে বাজে বাঁশি’ আর কেনই বা ‘নয়নে বহে ধারা’। বুঝলাম দুঃখের মাধুরী মানে ভালো লাগা দুঃখ। আরও বুঝলাম সব কেড়ে নিয়েও কেউ কিছুতেই ছাড়ে না। আবার যার কেড়ে নেওয়া হল তার মনও সরে না যেতে। দরজার ছিটকিনি খুলে বাগানে নামতেই গাছেদের মতোই অবস্থা হল আমার। ‘সকলই নিবে কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে—মন সরে না যেতে ফেলিলে এ কি দায়ে’ ভিজতে ভিজতেই বুঝতে পারলাম এ কথার আসল মানেটুকু। ঝরঝর বৃষ্টির অবিরাম ধারায় ভিজতে ভিজতে আমি মার মতোই খোলা গলায় গাইতে লাগলাম ।
কাঁদালে তুমি মোরে ভালাবাসারই ঘায়ে
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে
তোমার অভিসারে যাব অগমপারে
চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে।
পরাণে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা—
দুঃখের মাধুরীরে করিলে দিশেহারা,
সকলই নিবে কেড়ে, দিবে না তবু ছেড়ে—
মন সরে না যেতে ফেলিলে একি দায়ে ।
জানলায় চোখ পড়তেই দেখি আমার মতো করেই মা আমার গান শুনছে। চোখাচোখি হতেই বলল, ঢের হয়েছে। উঠে এস এবার। সপসপে ভেজা জামায় ঘরে ঢুকেই দেখি বাবা ফিরে এসেছেন কখন। বললেন, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বর্ষার গান এল না মনে। বাবাকে কী করে বোঝাই ‘অভিসার’ শব্দের মানেটুকু এখন আমি জানি। আজই জেনেছি। জেনেছি ভালোবাসার আঘাতে কেমন করে কাঁদা যায়।
এইসব নিয়ে আমার রবীন্দ্রনাথ। আমার রবীন্দ্রনাথকে আমি এইভাবেই মেঘলা আকাশে, বাদল বাতাসে, মা-র স্নানের শব্দে, সাবানের গন্ধে, বিকেলের মরে যাওয়া আলো অন্ধকারে বারবার পেতে চাই। বছরের পর বছর। প্রতি বছর। যত দিন যাবে।” কমলিকার খাতাটা বন্ধ করে শান্ত দিদিমণি এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। টিচার্স রুমে অন্য দিদিমণিরা। এতক্ষণ সকলেই চুপ করে শুনছিলেন। শান্তাদি নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, ‘এবার আপনারা আমায় বলুন আমি কী করব। প্রথাগত লেখা নয় বলে সাল তারিখ মাসের ঘ্যাঁট নয় বলে আস্ত একটা শূন্য বসিয়ে দেব, না লেখাটার উপযুক্ত মর্যাদার ব্যবস্থা করব।’
তরুলতা দিদিমণি বয়সে সবার বড়। আগামী বছরই বোধহয় ওঁর অবসর নেওয়ার বছর। বললেন, ‘এ তো দেওয়াল পত্রিকার লেখা। ইস্কুলের খাতায় এ ধরনের রচনা, আমার মতে অ্যালাউ না করাই উচিত।’ শান্তা দিদিমণি দৃঢ়স্বরে জানতে চাইলেন, ‘একশো পঁচিশতম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথকে জীবনমুখী করে তোলার প্রসঙ্গটা গতকাল আপনিই বলছিলেন না!’ তরুলতাদি তবুও হার মানেন না। বলেন, ‘বলেছিলাম। কিন্তু এখানে জীবনমুখী করে তোলার চেষ্টা কোথায়। এ তো অহেতুক কাব্য! এভাবেই দুই দিদিমণিতে কিছুক্ষণ তর্ক চলে। শেষকালে মেজরিটির রায়ে সিদ্ধান্ত হয় কমলিকার রচনাটা ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ হয়েছে ‘আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ হয়নি।

সব বন্ধুরা কিছু না কিছু মার্কস পেয়েছে, কমলিকা কেবল লাল কালির একটি মন্তব্য। ‘আবার লেখ। আমার চোখে রবীন্দ্রনাথ। আমার রবীন্দ্রনাথ নয়’। কমলিকা বুঝতে পারে না আমার চোখে আর আমার রবীন্দ্রনাথ-এ তফাতটা কোথায়? তার দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে খাতার মলাট ভিজে যায়। বড় লজ্জা করে তার, যা তার একান্ত নিজের অনুভূতি তাকে সকলের সামনে এসে অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ার ব্যথায় সে নীরবে কাঁদতে থাকে।
শান্তা দিদিমণি সবই লক্ষ করেন। ক্লাস শেষে কমলিকাকে বাইরে ডেকে পিঠে হাত রেখে বলেন, ‘তুমি যেমন করে ‘অভিসার’ শব্দের অর্থ খুঁজে পেয়েছ আর কেউ কি তা পেয়েছে? তুমি জানো, তুমি এখন কত ধনী। কাঁদছ কেন? সকলের জন্য সালতামামি হিসেবনিকেশ নামের তালিকা রাখবে, আর নিজের জন্য রাখবে কেবল তোমার নিজের বোঝাটুকু। ও কি সকলকে জানাবার বা বোঝাবার।”
কমলিকা আরও একবার বুঝতে পারে কাকে বলে কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে।’ ঝেপে আসা চোখের জলকে সে দুচোখের পাতা দিয়ে শক্ত করে তাড়াতাড়ি বন্দি করে রাখতে যায়। তারা তবু গাল গাড়য়ে ঝরে পড়ে। শাস্তা দিদিমণি বলেন, ‘বোকা মেয়ে।’