প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক সুমিতা চক্রবর্তী বাংলা সাহিত্যে তাঁর গভীর ভাবনা, সূক্ষ্ম ভাষাবোধ এবং অন্তর্মুখী কাব্যধারার জন্য সুপরিচিত। সমসাময়িক কবিতায় তিনি এক স্বতন্ত্র স্বর, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক বাস্তবতা ও দার্শনিক চিন্তাধারা একসূত্রে গাঁথা। কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও সম্পাদনায়ও তিনি রেখেছেন অনন্য স্বাক্ষর।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে সুমিতা চক্রবর্তী উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর মানসিক ও সৃজনশীল সংযোগের গল্প। শৈশবের পাঠ থেকে শুরু করে পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও ভাবনা কীভাবে তাঁর লেখালেখি ও জীবনদর্শনে গভীর প্রভাব ফেলেছে, তা তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অনুভূতির সাথে মিলিয়ে তুলে ধরেছেন। এই লেখাটি পাঠককে পৌঁছে দেবে এক কবিসত্তার অন্তর্গত রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কারের অন্তরঙ্গ যাত্রায়।

লেখার বিষয়টি একটু জিজ্ঞাসা জাগাতে পারে। তাই কী বলতে চাইছি, তা প্রথমেই স্পষ্ট করে নেওয়া ভালো। প্রথমেই বলতে চাই—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও অনেকের মতোই আমারও ভাবনা, রুচি, নান্দনিকতার বোধ, জীবনযাপন, কর্তব্য নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। বিশেষ করে বাঙালির বেঁচে থাকায় তাঁর দুর্মর উপস্থিতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন মানুষ প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই আর একজন মানুষের সবটাই গ্রহণ করতে পারেন না, পার্থক্যের জায়গা থাকেই।
মানুষের মস্তিষ্কে স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণ অত্যন্ত স্পষ্ট। কোনও দুজন মানুষ একরকম হতে পারেন না। কোনও দুজন মানুষের বুদ্ধি, মেধা, কর্মদক্ষতাও একরকম নয়। কাজেই একজন মহৎ মানুষকেও যখন তাঁর অনুরাগী ব্যক্তি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন, তখনও সেই আদর্শের সবটাই গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়। সেই অ-গ্রহণ খানিকটা ক্ষমতার অভাবে; খানিকটা আদর্শ এবং ভাবনার পার্থক্যের কারণেও। এটা কোনও নতুন কথা নয়, চিরকালের কথা।
রামকৃষ্ণের আচরণের আদর্শ গ্রহণ করেননি বিবেকানন্দ। আবার বিবেকানন্দের অভিমত সর্বাংশে গ্রহণ করেননি নিবেদিতা। গান্ধিজির কোন দিকটা জওহরলাল নেহরু গ্রহণ করেছিলেন, তা আমার কাছে কোনও সময়েই বোধ্য হয় না। এইসব বিখ্যাত মানুষের উদাহরণ দেওয়া কেবল এই জন্যই যে, সকলের কাছে স্পষ্ট হবে বিষয়টি। খুব সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নেব এই জন্য—বিষয়টির খানিকটা অংশ, অবধারিতভাবে আত্মকথন হবেই।
নিজের কথাও কখনও কখনও নিজেদের লোকের কাছে বলতে ইচ্ছে করে। কেউ কেউ ভাবতেই পারেন—এ হল নিজের বিজ্ঞাপন। কিন্তু অন্যদিক থেকে ভাবা যায়, নিজের উপলব্ধিও মানুষ ব্যক্ত করতে চায়। একজন সাহিত্যিক, একজন চিত্রশিল্পী তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে নিজের মনকেই তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন অনেক অনেক কবি। সেখানে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কবিতায়, নজরুলের কবিতায়, বিষ্ণু দে-র কবিতায়, জীবনানন্দ বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক কবিতায় কবিরা নিজের নিজের কথাই বলেছেন।
সেখানে এসব পংক্তি উচ্চারিত হয়েছে—“সম্মুখে থাকুন বসি পথ রুধি রবীন্দ্র ঠাকুর/ মোর পথ আরও বহুদূর/মোর দুনয়ন হতে জ্বালিব যে তীক্ষ্ণ, তীব্র আলো/যুগসূর্য ম্লান তার কাছে।” (অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)। মনে পড়তে পারে—“পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি, যুগের হুজুগ কেটে গেলে/মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি/ রয়েছে সোনার শত ছেলে…অমর কাব্য তোমরা লিখিও / বন্ধু যাহারা আছ সুখে।” (নজরুল)। এসব কবিতা সকলেরই পঠিত। একটি অন্য কবিতা শোনাই—এটি লিখেছেন শুভ ঠাকুর।
“—পোয়েট টেগোর কে হন তোমার,
জোড়াসাঁকোতেই থাকো ?
—বাবার শুনেছি খুড়া মহাশয়,
মোর কেহ হয় না কো৷৷”
এবং এসবের পরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পংক্তি—
‘বুকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ।’
কবিরা যদি পারেন কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ বা অংশত বর্জন করতে তা হলে প্রাবন্ধিকেরা কেন পারবেন না। রবীন্দ্র-বিদূষক আছে—এমন প্রবন্ধও কম লেখা হয়নি। কিন্তু সে জাতীয় প্রবন্ধের প্রসঙ্গ আমরা আনছি না। আমার আজকের কথা প্রধানতই আমার ব্যক্তিগত অনুভব। কোথায় রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে পারি, আর কোথায় পারি না—তারই স্বীকারোক্তি। এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনও বিতর্কেই যাব না। বহুজনের সঙ্গেই মিলবে না অনুভব। সে ক্ষেত্রে পৃথক থাকার ব্যাপার সহমত হবে।
শৈশব-বাল্য-কৈশোর কেটেছে প্রধানত দুটি জায়গায়। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে বরাকর নদী পেরিয়ে বিহার, এখন ঝাড়খণ্ড, জেলা ধানবাদ—ছোট্ট আধা-শহর—কুমারডুবি। কয়লা-লোহা-ফায়ারক্লে-খনি-কারখানা। বার্ড কোম্পানির হাসপাতালে বাবা ডাক্তার। সেখানে বাংলা বই পাওয়া যেত না। নিকটতম শহর ছিল আসানসোল চোদ্দো মাইল দূরে। সেখানেও বই প্রায় পাওয়াই যেত না সেই সময়ে। ১৯৫০—১৯৬০-এর মধ্যবর্তী কাল তখন। আর একটি জায়গা ছিল পালামৌ জেলার ডাল্টনগঞ্জ। দাদামশাই নলিনবিহারী দত্ত সেখানে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ছিলেন।
আমার পিতামহ ক্ষিতীশচন্দ্র সরকারও ডাল্টনগঞ্জে থাকতেন। ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তবে তাঁর অকালমৃত্যু হওয়ায় আমার বাবার কোনও বাড়িঘর ছিল না। ভালো ছাত্র ছিলেন। অন্যের বদান্যতায় ডাক্তারি পাস করে চলে যান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে বার্ড কোম্পানির চাকরি। আমরা সর্বার্থেই প্রবাসী বাঙালি। দুই বাড়িতেই মোটামুটি বইপত্র ছিল। এবং আমি আমার প্রবেশিকা পরীক্ষার বছর ১৯৬১ পর্যন্ত—বয়স পনেরো—রবীন্দ্রনাথের কবিতাই প্রধানত পড়েছি। তার বাইরে স্কুলের পাঠসংকলনে স্থানপ্রাপ্ত কয়েকটি কবিতা। মধুসূদন, হেম-নবীনের, দ্বিজেন্দ্রলালের গ্রন্থাবলি বাড়িতে ছিল—তখন পড়িনি । পড়েছি অতুলপ্রসাদের গান ও রজনীকান্তের গান ও কবিতা, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রাধারাণি দেবীর কবিতা।
ছদ্মনামধারিণী অপরাজিতা দেবীর কবিতাও। আর ওমর খৈয়াম-এর অনুবাদ, নরেন্দ্র দেবের করা। আর বারবার, সকাল-সন্ধ্যায় পড়তাম রবীন্দ্রনাথ—সঞ্চয়িতা আর চয়নিকা। আমার মা এবং অন্য আত্মীয়রা, সময় কম পেলেও সবাই বই পড়তেন। রবীন্দ্রনাথের গল্পও পড়েছি। স্কুলে থাকতেই শুরু করেছি উপন্যাস পড়া। ছোট বয়সের পড়ার অনেক স্মৃতি আছে। একটা বলি।
বয়ন নয়-দশ। পড়েছি পতিতা কবিতাটি। “ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিরে ভুলাতে পাঠাইলে বনে যে কয়জনা/সাজায়ে যতনে ভূষণে রতনে/আমি তারি এক বারাঙ্গনা।” বারাঙ্গনায় এসে থমকে গেলাম। আমার শব্দভাণ্ডারে তখনও ‘বারাঙ্গ না’ নেই। আমি তখনই ধরে নিলাম ওটা ছাপার ভুল— হবে ‘বীরাঙ্গনা’। পড়ছি— ‘আমি তারি এক বীরাঙ্গনা। কিন্তু আমার সংশয় থেকে গেল। “আনন্দময়ী মূরতি তোমার/কোন দেব তুমি আনিলে দিবা/অমৃত সরস তোমার পরশ/তোমার নয়নে দিব্য বিভা।”—খারাপ তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মা-কে আর জিজ্ঞাসা করিনি। বুঝেছিলাম এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হয় নিজেকেই।
আর একটি দৃষ্টান্ত। নজরুল পড়ছি—কাণ্ডারি হুঁশিয়ার—‘উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’ বয়স তেরো-চোদ্দো। রবীন্দ্র-কাব্যভাষা তখন এমনই অভ্যাস হয়ে গেছে আমার যে, ‘খুন’ শব্দটি কবিতায় ভালো লাগছে না। আমি নিজেই বানিয়ে নিলাম—‘উদিবে সে রবি মোদেরি রক্তে রাঙিয়া পুনর্বার।’ ‘আমাদেরই রক্তে’ করলে ছন্দ কেটে যাচ্ছে। সেটা বুঝে নিয়েছি ততদিনে। অনেকদিন পরে জেনেছিলাম—খুন শব্দের প্রয়োগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের মধ্যে একটা বিরোধই ঘটেছিল। প্রমথ চৌধুরীকে লিখতে হয়েছিল ‘বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা’ নামে প্রবন্ধ।

এইভাবে একদিন পৌঁছোলাম কলেজে। কলেজ আসানসোলে। বাংলা অনার্স। তখন পড়ি মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব গীতিকবিতা, শাক্ত পদাবলি, মেঘনাদবধ কাব্য, বিহারীলাল, রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, সত্যেন্দ্রনাথের লেখা। তারপরে আর কেউ নেই। জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে-র নাম শুনেছি থার্ড ইয়ারে—কিছুই পড়িনি।
তখন আমাদের বি. এ. পার্ট টু ফাইনাল-এ চল্লিশ বা পঞ্চাশ নম্বরের একটি সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে হত। তার সম্ভাব্য একটি বিষয় ছিল আধুনিক বাংলা কবিতা। সেটি আমি ভাবলাম তৈরি করব। একটু জানা হবে। তখন লাইব্রেরিতে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটিমাত্র আধুনিক কবিতার রেফারেন্স বই—দীপ্তি ত্রিপাঠীর ‘আধুনিক বাংলা কাব্য’। সেই বই-এর উদ্ধৃত অংশগুলি থেকেই আধুনিক কবিতার পাঠে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। কোটেশন থেকে আমার প্রথম শক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত—
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে—
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া ।
আমার রবীন্দ্রকাব্যরস নিষিক্ত কল্প-পৃথিবী একেবারে ঘুরে গেল। এই নৈরাশ্য, এই আত্মধ্বংসের আতঙ্কিত অনুভব কোনও কবিতায় থাকতে পারে—সেই আমার প্রথম জানা হল। আমরা প্রথম ভালো লাগা সুধীন্দ্রনাথ। বিষ্ণু দে মুগ্ধ করে দিতেন বৈদগ্ধ্যে আর সুন্দরের বিচিত্র বর্ণনায়। দেওঘরের বসন্তে রাধাচূড়ার পাতার কৃষ্ণাভ ঘন সবুজের সঙ্গে ঝকঝকে ফুলের হলুদের মিশ্রণ যেন কৃষ্ণাভ ‘টিলায় টিলায় ছুটে গেল জোড়া বাঘ’। এই উপমা কি রবীন্দ্রনাথ দিতেন।
বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে যে কিছুদিন একটানা ফাঁকা সময় পাওয়া যেত তাতে আমি তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের কবিদের অনেক লেখা পড়ে ফেললাম। জীবনানন্দের পৃথিবীতে ঢুকতে পেরেছি আরও কিছুকাল পরে। রবীন্দ্রনাথ রইলেন কিন্তু একমাত্র হয়ে আর রইলেন না। জীবনের অন্ধকার রন্ধ্র পথের অভিজ্ঞতাও শিখে রাখা দরকার তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় রইল না। রবীন্দ্রনাথের সেই পংক্তি—“জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে/জীবন-বীণা ঠিক সুরে আর বাজে নারে” এই বাণীর অন্তর্গত দর্শন আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। সরু আর মোটা তারের বাজনা মিলেই জীবন-বীণার ঠিক সুর বাজে—এমনই মনে হল।
সে কথা রবীন্দ্রনাথও জানতেন। কোথাও কোথাও বলেও গেছেন। তবু সর্বত্রই তাঁর উত্তরণের প্রবণতা, প্রত্যয় খুব বেশি—“কঠিনেরে ভালোবাসিলাম— সে কখনও করে না বঞ্চনা।” দুর্ভাগ্যকেও আস্তিক্যবাদিতায় মিশিয়ে দেওয়া। তিনি পারতেন। কিন্তু সর্বদাই এই উপলব্ধি মানুষের জীবনে সত্য নয়। ‘ক্ষণিকা’য় কয়েকবার বলা হয়েছে সেই বাস্তব সত্যের কথাটি। “তোমার মাপে হয়নি সবাই/তুমিও হওনি সবার মাপে/তুমি মরো কারো ঠেলায়/কেউ বা মরে তোমার চাপে।” তবু রবীন্দ্রনাথ অপ্রিয় সত্যকে একটু সরিয়ে রাখতে চাইতেন। স্মরণ করি জীবনানন্দকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি—যেখানে শান্তি নেই তা স্থায়ী হয় না। জীবনানন্দের উত্তর ছিল হৃদয়ের সততার জন্যই স্থায়িত্ব,—Serenity বা শান্তির জন্য নয়।
আধুনিক যুগের কবিতা যে রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন না তার বহু প্রমাণ আছে। এটা বহু আলোচিত বিষয়। পোকায় খাওয়া ফুল, ক্ষয়ে যাওয়া সাবান, দাঁড়া ভাঙা চিরুনি, তলানি তেলের শিশি, মদের দোকান, ঘাড়ে ক্ষত হওয়া গরু—এই সবই তিনি দেখেছিলেন আধুনিক কবিতায় এই আধুনিক কবিরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে খুব মহিমার সঙ্গে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। আধুনিক কবিতা থেকেই পেয়েছি কবিতা পড়ার শিক্ষা। কীভাবে পড়ব কবিতা! বুঝে নিতে হবে প্রতিটি শব্দ। অনেক আধুনিক কবিতা এমন যে, কোনও একটি শব্দ না বুঝলে পংক্তিই বোঝা যাবে না।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় ভাবটা বোঝা যায়। তাই খুঁজি না মানে। অথচ কী অদ্ভুত দক্ষতায় তিনি শব্দ ও প্রসঙ্গ ব্যবহার করেন। কতবার পড়েছি রবীন্দ্রনাথের বর্ষামঙ্গল—‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে…’। সেখানে একটি পংক্তি ছিল ‘ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরসনা’। আধুনিক কবিতা পড়ার শিক্ষা থেকেই ‘বাজুক স্বর্ণরসনা’ অংশে এসে থামতে হল আবাল্য পঠিত কবিতাটির ক্ষেত্রে প্রথমবার।
সোনার জিভ? অভিধানে তখন দেখি রসনার আর একটি মানে নারীর কটিতে ভূষিত হওয়ার জন্য নির্মিত আভরণ । নাচের ছন্দে যা শব্দতরঙ্গ তোলে। এখন দেখি ‘রশনা’ বানানটি থাকে অনেক সংস্করণে। আমরা কিন্তু ‘রসনা’ই পড়েছিলাম। উর্বশী কবিতার ভাবের প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের ভাষা-শৈলীকে আজও কি কেউ অতিক্রম করতে পারেন? ‘দিকে দিকে কাঁদিছে ক্রন্দসী’র মানে যে ক্রন্দনরত নারী নয়—তা জানলাম এম.এ. পড়বার সময়ে, সুকুমার সেন মশাইয়ের ভাষাতত্ত্বের বই থেকে। শেষের কবিতা-য় আমার প্রিয় কবিতা— ‘সুন্দরী ওগো শুকতারা/রাত্রি না যেতে এসো তূর্ণ’। ‘তূর্ণ’ শব্দের অর্থ যে ‘দ্রুত’ তা খুঁজেছি কবিতাটি প্রথম পড়ার অনেকদিন পরে।
আধুনিক কবিতা পড়বার সময়ে শব্দে শব্দে ঠেকতে ঠেকতে এবং তার মানে খুঁজতে খুঁজতেই রবীন্দ্রনাথের অসামান্য, অপরূপ, অমোঘ শব্দশিল্প আমার কাছে নতুন করে ধরা দিয়েছিল। আধুনিক কবিতার ভাষা অনেকটা বদলে গেলেও রাবীন্দ্রিক কাঠামোটা খুব বেশি বদলেছে কি? আর স্নিগ্ধ, করুণ, মধুর, মহান ভাবের প্রকাশে রবীন্দ্রনাথের ভাষাশৈলীকে আজও কি কেউ অতিক্রম করতে পারেন ? অন্য প্রসঙ্গে আসি। রবীন্দ্রনাথের নিবিড় ও নির্দ্বিধ অধ্যাত্মভাবনা, গভীর ঈশ্বর-বিশ্বাস আমাকে টানে না। ধর্ম ও ঈশ্বর খুব স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ। আমার পৃথিবী ঈশ্বর-বর্জিত। ঈশ্বর নামক কোনও পিতৃপ্রতিম বা মাতৃপ্রতিম শক্তি বা আশ্রয়ের কল্পনা নিরর্থক মনে হয়।

মানুষের মনের মধ্যে ভক্তিভাব থাকা সম্ভব তা অস্বীকার করি না। মীরা, কবির, নানক, খ্রিস্ট, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ তা হলে তো হতেনই না। যদিও আমি জানি না ঈশ্বর নামক কোনও শক্তিতে আস্থা থাকা কী করে সম্ভব যখন মাতৃগর্ভে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে; মানুষ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করতে পারে। চার-পাঁচ-ছয় বছরের মেয়েদের ওপর শারীরিক অত্যাচার করে ছাড়া পেয়ে যেতে পারে বিকৃতকাম লোকেরা। তবু ঈশ্বর নাকি আছে ! তাই রবীন্দ্রনাথের ভক্তিগীতি বা পূজার গান আমি গ্রহণ করতে পারি না। তার ভাববস্তু আমি বর্জন করি। উপলব্ধির প্রকাশশৈলী অবশ্যই মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনার দিকটা খুবই জটিল ছিল। নারী সম্পর্কে পুরুষ- প্রধান সমাজের ভাবনাটাই খুব জটিল।
যে যুগে নারীকে মনস্বিতাবিহীন পরিচর্যাকারিণী আর গর্ভধারণের যন্ত্র বলে মনে করা হত সে যুগে ঠাকুরবাড়ি ব্যতিক্রম। এ বিষয়ে প্রাথমিক কৃতিত্ব কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। যেভাবে কন্যা ও পুত্রবধূদের শিক্ষা এবং মনন-চর্চা ও সংস্কৃতি-চর্চার অবকাশ তিনি করে দিয়েছিলেন তা সেকালে অন্য কেউ ভাবতেই পারেননি। যাঁরা ভেবেছেন তাঁরা ঠাকুরবাড়িকেই অনুসরণ করেছেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা লেখাপড়া, সাহিত্য-চর্চা, পত্রিকা সম্পাদনা, প্রতিষ্ঠান-পরিচালনা; সঙ্গীত-শিক্ষা তো করেছেনই, অভিনয়ও করেছেন—বাইরের পুরুষ দর্শকের সামনে।
যদিও অভিনয়-মঞ্চটি স্থাপিত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই। তবু আমন্ত্রিত হতেন বাইরের অনেকেই। এ কাজ সেকালে থিয়েটারের মেয়েরাই করতেন। কিন্তু এভাবে অভিনয় করা সত্ত্বেও ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অভিজাত ঘরের গৃহবধূ পরিচয়েই মহিমাদীপ্ত থেকে গিয়েছিলেন। এসবই ঘটেছিল দেবেন্দ্রনাথের সমর্থনে। রবীন্দ্রনাথের নারী-ভাবনায় অনেক স্তর ছিল, অনেক বাঁক ও ঘুর্নি। তার কোনও কোনও দিকের প্রগতিশীলতা আজও আমাদের স্তম্ভিত করে রাখে, আবার কোথাও কোথাও মনের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠে আপত্তি। এসবই নিজের মতো করে ভেবেছি এবং লিখেছি এই বই-এ৷
রবীন্দ্রনাথের জীবন বহুদিন থেকে আমাদের কাছে এমন এক আদর্শ হয়ে থাকে যে আদর্শের বাস্তবায়নে আমরা পৌঁছোতে পারব না কোনওদিন। এই একজন মানুষ—যদি মনে করতেন কোনও কাজ হওয়ার দরকার তা হলে অন্য কেউ করবে বলে কেবল উপদেশ বর্ষণ করে ক্ষান্ত হতেন না। নিজেই করে দেখাতেন সেই কাজ। বাংলার প্রথম সক্রিয় পরিবেশবিদ তিনি। দেখিয়ে দিয়েছেন পরিবেশ রক্ষা করতে হয় কীভাবে। বাংলার পল্লি-উন্নয়নে সমবায় ভাবনাকে কাজে পরিণত করবার প্রয়াস এগিয়ে এসেছিলেন জমিদারের উচ্চাসন ছেড়ে।
বাঙালির লোকসাহিত্য-চৰ্চা তাঁর ভালোবাসায় ও আগ্রহেই গবেষণার বিষয় হয়ে উঠল। শিক্ষার সঙ্গে বহুমাত্রিক নান্দনিকতাকে সমন্বয়িত করবার ভাবনা এবং তাকে কাজে পরিণত করবার দুরূহ পরিকল্পনার রূপায়ণে এখনও তিনিই একতম শিক্ষাবিদ। বাংলার ভাস্কর্য ও চিত্রকলা, তিনি না থাকলে আজ যেখানে পৌঁছেছে তা পৌঁছোতে পারত না। কোথায় কাজ করতেন নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদ বিহারী? কোথায় পেতেন রবীন্দ্রনাথের গানের মতো গান? আবার তাঁর জীবন-কথায় এমন কিছু কিছু তথ্য পাই যা মনকে একটু দূরে সরিয়ে দেয়।
একটু যেন বেশি আনুগত্য ভালোবাসতেন, স্তাবকদের কথায় কান দিতেন একটু বেশি। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের বসবার চেয়ারটি তাঁর সঙ্গে জাহাজে দিয়ে দেবেন বলে মনস্থ করলেন। জাহাজের কেবিনের দরজা দিয়ে চেয়ার ঢুকছে না দেখে সেই দরজা কেটে বড় করতে হল। এই রকম ভক্তির অভিপ্রকাশ যাঁদের, তাঁদের কাছ থেকে দূরে থাকাই যেন নিরাপদ মনে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বেশ উপভোগই করতেন। এই রকম ভাবনা জমে ওঠে, ঘোরাফেরা করে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। তাঁর ভাবনার কিছু গ্রহণ করি, কিছুটা আজ আর গ্রহণ করতে পারি না।