আমার রবীন্দ্রনাথ- সুমিত্রা সেন

বাংলা আধুনিক গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রখ্যাত শিল্পী সুমিত্রা সেন তাঁর মধুর কণ্ঠ, হৃদয়স্পর্শী উপস্থাপনা এবং অনন্য সুরভঙ্গির জন্য বিশেষভাবে শ্রদ্ধেয়। বহু দশক ধরে তিনি মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ও রেকর্ডিং জগতে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের মনে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর গায়নশৈলীতে পাওয়া যায় নিখুঁত স্বরনিয়ন্ত্রণ, গভীর অনুভব এবং গানের ভাবের সঙ্গে আত্মিক মেলবন্ধন।

আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে সুমিত্রা সেন প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও ভাবনার সঙ্গে তাঁর জীবনব্যাপী সম্পর্কের গল্প। তিনি তুলে ধরেছেন কীভাবে শৈশব থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর সঙ্গীতজীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, এবং কণ্ঠের মাধ্যমে কবির অনুভূতি পৌঁছে দেওয়াই হয়ে উঠেছে তাঁর শিল্পজীবনের প্রধান লক্ষ্য।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- সুমিত্রা সেন
আমার রবীন্দ্রনাথ- সুমিত্রা সেন

 

আমার গান শেখার হাতেখড়ি আমার মায়ের কাছেই। মা খুব সুকণ্ঠী ছিলেন। | অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথ—সকলের গানই গাইতেন এবং শুনে শুনে আমারও শেখা হয়ে যেত। বাবা ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক এবং Fine Arts- এর প্রতি তাঁর অসম্ভব আকর্ষণ ছিল। মামাবাড়িতে শিল্পচর্চার একটা আবহাওয়া প্রথম থেকেই ছিল। বাবা-মা দুজনেই চাইতেন আমি গান গাই—সব রকম গান, তার মধ্যে রবীন্দ্রসংগীতও ছিল। মনে আছে মায়ের কাছে শিখেছিলাম ‘কুল থেকে মোর গানের তরী’। ছোটবেলায় ওঁর গান শিখতাম, শুনতাম কিন্তু শিল্পী হিসেব শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত-এর মধ্যেই আশ্রয় খুঁজে পাওয়া, সেই অধ্যায় শুরু হয়েছে অনেক পরে।

আমার প্রথাগত ভাবে গান শেখার শুরু একটু বড় বয়সেই। Bengal Muscic College-এ নবীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে classical শেখা শুরু করি। তার আগে পাঁচ বছর সেতারও শিখেছি। এই সময় একটা ঘটনা আমার জীবনে নতুন পথ দেখাল। BMC-তে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-র সংবর্ধনা উপলক্ষে এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে।

একদিন কলেজের প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে জানালেন, ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইব আমি এবং সেটি অবশ্যই হবে রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি গান। খুব আনন্দ হয়েছিল। সেটি ছিল আমার জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান, তা-ও আবার ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ-র সংবর্ধনায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরও একটি নতুন মাত্রা, বিদগ্ধ শ্রোতাদের সামনে জীবনে প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া। সেদিন আমি গেয়েছিলাম, ‘মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার’। সকলেই প্রশংসা করলেন। বিশেষ করে ওস্তাদজি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন—’তোমার গলা খুব ভালো, গান শেখো ভালো করে।’

সেই সময় থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভিতর থেকে একটা টান অনুভব করতে শুরু করলাম। নবীবাবুর কাছেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেওয়া চলল। পাশাপাশি ছিল পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে শ্রী প্রদ্যোৎ নারায়ণ, শ্রী সমরেশ চৌধুরী, শ্রী সুরেশ চক্রবর্তী, শ্রী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও রাধারানি দেবীর কাছে বিভিন্ন ধরনের গান শেখা। ১৯৫০-এ রেডিয়োতে অডিশন দিলাম। ন’টি বিষয়েই পাশ করে রেডিয়োতে অনুষ্ঠান করতে শুরু করি। এই সময় আকাশবাণীর মহিষাসুরমর্দিনী- তেও গান গাইবার সুযোগ পাই। সেটাও একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এর মধ্যেই আমি গীতবিতান থেকে ডিগ্রি নিয়ে পাশ করি।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল
আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল

 

বৈতানিকে প্রসাদ সেন ও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এবং গীতবিতানের অনাদি দস্তিদারের কাছেও গান শিখি। যত শিখেছি, ততই একটা আলাদা শান্তি, তৃপ্তি এসেছে। কিন্তু রবি ঠাকুরের গান আমাকে অন্য রকম শান্তির সন্ধান দিল। প্রথম দিকে যখন ওঁর গান গাইতাম, তার ভিতরের সৌন্দর্যকে ততটা উপলব্ধি করতে পারতাম না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যত অভিজ্ঞতা বাড়ল, উপলব্ধি বাড়ল, ততই আমি রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যেই আমার জীবনের পরম আশ্রয় খুঁজে পেলাম।

আমার প্রথম রেকর্ড কিন্তু নজরুলগীতি—’গোঠের রাখাল’ ও ‘বেদনার বেদীতলে’, দুর্গা সেনের সুরে। ‘শুন বরনারী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘কাচের স্বর্গ’, ‘ছায়াসূর্য’, ‘আলো আমার আলো’—আরও অনেক ছবিতেই প্লে-ব্যাক করার সুযোগ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৭০ সালে আমি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হই। সেই থেকেই একনিষ্ঠ ভাবে আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত-এ আত্মনিবেদন। তারপর আমি আর অন্য গান গাইনি।

রবীন্দ্রনাথের গান মানুষের মনকে শুদ্ধ করে, পবিত্র করে, জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, সবাইকে আপন করে নেওয়ার শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষা, এই শুদ্ধিকরণ আমি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেব—এটাই হয়ে উঠল আমার লক্ষ্য। টানা পঁচিশ বছর আমি রবীন্দ্রভারতীতে ছিলাম। ১৯৯৫- এ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করি। এই এতগুলো বছর যে আমি শিক্ষকের ভূমিকায় থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের উপলব্ধিকে বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি, সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ।

উনি তো আরও কত কিছু রচনা করেছেন—গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে ওঁর গান। উনি নিজেও তো বলে গিয়েছেন, ওঁর লেখালেখি হয়তো সবাই ভুলে যাবে, কিন্তু ওঁর গান ফিরবে লোকের মুখে মুখে। এ গান এমন কিছু দিতে পারে যা পৃথিবীর আর কোনও সঙ্গীত পারে না। ইদানীং যে রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে বিকৃত করে অনেকে গাইছেন, আমার কাছে তা অত্যন্ত আপত্তিকর। এতে ওই গানের শুদ্ধতা নষ্ট হয়, শান্ত সমাহিত যে ভাব রবীন্দ্রসঙ্গীতে রয়েছে সেই পবিত্রতাটা আর থাকে না।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- সুমিত্রা সেন
আমার রবীন্দ্রনাথ- সুমিত্রা সেন

 

সুর, তালের উপরে রয়েছে ওঁর গানের বাণী। ঠিক কোন সুর ও তাল প্রয়োগ করলে সেই বাণীর যথার্থ পরিপূরণ হয়, তার মাত্রা ঠিক করে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তার বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। বাইরে গেলে তা কুশ্রী হয়ে ওঠে এবং অধিকাংশ শ্রোতাই তা পছন্দ করেন না। এ আমার নিজের অভিজ্ঞতা। এখন তো আমি আর তেমন গান গাই না। বাণীচক্রে বা আমার নিজস্ব সংস্থা ‘ত্রিবেণী’তে যতটুকু গান শেখানো। কিন্তু শ্রাবণী বা ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে আগেও গিয়েছি, এখনও মাঝেমধ্যে যাই।

সেখানে দেখি এই প্রজন্মের বহু ছেলেমেয়েই কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে এই গান শুনছে। মানুষকে ভালো কিছু দিলে সে ভালোটাই নেয়। চটুল সুরের যত আকর্ষণই থাকুক না কেন, যে সঙ্গীত খাঁটি এবং শুদ্ধ তা চিরদিনই মানুষের মনের মধ্যে থাকে। সুর ও অনুভূতির যে অপূর্ব মিলন রয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতে, তা আমি অন্য কোনও গানে পাইনি। এখন যত বয়স বাড়ছে, ততই আরও বেশি বেশি করে ওঁর গানকেই আঁকড়ে ধরছি। আমার সবচেয়ে প্রিয় পূজা পর্যায়ের গান। শুধু গান নয়, কবিতা, গল্প, ছবি—সব কিছু মিলেই আমার রবীন্দ্রনাথ—আমার চলার পথের পাথেয়।

মন্তব্য করুন