আমার রবীন্দ্রনাথ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

বাংলা চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অভিনয়শিল্পী, আবৃত্তিকার, নাট্যকার, পরিচালক ও লেখক হিসেবে সমানভাবে সমাদৃত। সত্যজিৎ রায়ের একাধিক চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, আর মঞ্চনাটকে তাঁর উপস্থিতি ছিল এক স্বতন্ত্র শক্তি। সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগী সৌমিত্র কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিচারণাতেও রেখেছেন অনন্য স্বাক্ষর।

আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির বন্ধন, শৈশব-কৈশোর থেকে শিল্পীজীবনের নানা পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সঙ্গীত ও ভাবনা থেকে পাওয়া প্রেরণা। একজন অভিনেতা ও আবৃত্তিকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের শব্দ, ছন্দ ও চরিত্রের ব্যঞ্জনা তাঁর শিল্পীসত্তাকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে, তা তিনি আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। পাঠকের কাছে এটি হয়ে উঠবে এক শিল্পীর অন্তর্মুখী রবীন্দ্রনাথ অন্বেষণের মূল্যবান দলিল।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
আমার রবীন্দ্রনাথ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 

আমাদের প্রত্যেকেরই মনের ভেতর, একান্ত নিজের, কোথাও না কোথাও আমাদের প্রত্যেকেরই মনের কনেরা কে কি সে নিজের নামের সঙ্গে আমাদের দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলতে থাকে নিরন্তর। দুখের দোলায় হঠাৎ মোরে দোলায় সে যে কাজের মাঝে লুকিয়ে থেকে, আমারই কাজ ভুলায়।’ এমন কথা আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের সেই অন্তরবাসী রবিঠাকুর সম্পর্কে বলতে পারি।

সেই নিজের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলতে গিয়ে দেখি, সে আসলে একজন মাত্র রবীন্দ্রনাথ নয়, অনেকগুলি রবীন্দ্রনাথ। তিনি নিজেই তো বলেছেন, ‘নানা রবীন্দ্রনাথ গাঁথা একখানা মালা।’ জীবনের নানা পর্বে, নানা অভিজ্ঞতায় সেই রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে পেয়েছি, সে কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার শুরু কিন্তু শেষ থেকে, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ থেকে।

আমি কোনওদিন রবীন্দ্র-নাথকে দেখিনি। তাঁর প্রয়াণের পর কলকাতায় যে বিহ্বল ও বল্গাছাড়া শোকযাত্রা হয়েছিল, সেখানে যাওয়ার কোনও সুযোগও আমার ছিল না। কৃষ্ণনগরে তখন আমি ক্লাস ওয়ানের ছাত্র। তাঁর প্রয়াণের স্মৃতিতে তাই রবীন্দ্র-নাথের প্রত্যক্ষ কোনও ছবিও আমার স্মৃতিপটে নেই। ছ’বছর বয়স, রবীন্দ্রনাথের কী মহিমা, তা বোঝারও বয়সও তখন আমার হয়নি। তবু শিশু মনে তাঁর প্রয়াণের প্রথম অভিজ্ঞতা আজীবনের মতো দাগ রেখে গিয়েছে। সেদিন ছিল ২৩ শ্রাবণ, আমার জ্বর হয়েছিল, স্কুলে যাইনি। দাদা স্কুল থেকে ফিরে এল। দাদা বলল, স্কুল হবে না, ছুটি হয়ে গেছে।

মা বললেন, কেন কী হয়েছে? দাদা বলল, রবীন্দ্র-নাথ ঠাকুর মারা গিয়েছেন। হেডমাস্টারমশাই তাই ইস্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন। শুনে মনে হল, রবীন্দ্র-নাথ নিশ্চয়ই বিরাট কিছু, না-হলে ইস্কুল ছুটি হবে কেন? তা ছাড়া সেই শিশু বয়সে রবীন্দ্র-নাথের মৃত্যুকে ঘিরে আমার তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, আমার মায়ের পৃথিবীটা কেমন দুলে উঠল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, রেলিং ধরে আসতে আসতে বসে পড়ল।

মায়ের এমন দশা কেন হল, তা সেদিন তার দুই ছেলে বুঝতে পারেনি। রবীন্দ্র-নাথের নাম বাবার মুখে শুনেছি কখনও সখনও। বাবা যখন কবিতা বলতেন, মা আবৃত্তি করতেন। তবে তিনি যে কে তা কখনও চিন্তাই করিনি। এই প্রথম মায়ের সেই বেদনার মধ্যে দিয়ে কী যেন একটা বড় পরিচয় শুরু হল। তিনি যদি নিতান্তই আপনজন না হবেন, তা হলে অনাত্মীয়, অপরিচিত একজন কবির মৃত্যুতে একজন গৃহবধূ কেন একটা শোকার্ত হয়ে পড়বে। সেই দিন থেকে তিনি পরিচিত আত্মীয় হতে শুরু করলেন।

আমার মায়ের গলায় গান ছিল না। আমরা যখন তার কোলে আসতে শুরু করলাম তখন ঘুম পাড়ানোর জন্য গান গাইতে পারত না বলেই কবিতা বলত, শিশু থেকে, শিশু ভোলানাথ থেকে। স্মৃতি থেকেই বলত। এই সব কবিতা ঘুম জাগরণের সন্ধ্যাদেশ পেরিয়ে আমার জাগ্রত স্মৃতিতেও চিরজীবী হয়ে রয়ে গেছে। মায়ের কাছে শিশুর কবিতা শুনতে শুনতে কবিতা ভালো লাগার ভিতটা গাঁথা শুরু হচ্ছিল বটে, কিন্তু তখন তা বুঝিনি। নিজের অগোচরে তা ঘটে গিয়েছিল। তবে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ শুনতে শুনতে এখনও স্পষ্ট মনে আছে, মনে হত সেই মানুষটির ছেলেবেলার কথা যখন তিনি মায়ের মুখে ঘুম পাড়ানোর সময় এই ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ শুনেছিলেন।

তা যেন আমার ছেলেবেলার সঙ্গে লুপ্ত হয়ে গেছে। ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠে আমি কবিতা লিখতে আরম্ভ করি। কিন্তু সেই আরম্ভের আগে কবিতাকে ভালোবাসার আরম্ভ তো একটা ছিল। কবিতার শ্রুতিপাঠই আমার চেতনায় এসে প্রথম কাঁপন তুলেছিল। বাবার কাছেও কবিতা শুনেছি, আশৈশব। সে সবই রবীন্দ্র-নাথের কবিতা। বাবা খাটো ডেস্কে চয়নিকা রেখে পড়ত, অনেক সময় স্মৃতি থেকেও আবৃত্তি করত। একন বুঝতে পারি বাবা যখন রবিঠাকুরের কবিতা নিয়ে আলোচনা করত, তখন তার মধ্যে কতটা সাহিত্যবোধ সিঞ্চিত থাকত । একদিন বাড়ির ওই আবৃত্তির আসরে বাবা স্মৃতি থেকেই বলেছিল ‘দেবতার গ্রাস’। আবৃত্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ওই কাহিনি-কবিতার করুণ পরিণাম আমার মনকে কীরকম আর্দ্র করে রেখেছিল।

আমাদের দেশের মানুষের মন, তার স্নেহ-প্রীতি-সংস্কার, তার মানব সম্পর্কে বন্ধন এইসব নিয়ে অনেক চিন্তার সূত্রপাত হয়েছিল তখন। এতসব ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমই আসছিল না। মনে হচ্ছিল, নখ, তিনি কেমন করে কোনও যাদুবলে এসব জানলেন, এসব বুঝ? বাবার কন্ঠের সম্মোহনীতে জীবিত হয়ে ওঠা মৈত্র মহাশয়, মোক্ষদা, দাঁড়ি মাঝিরা এবং অবশ্যই রাখাল আমার বিনিদ্র অন্ধকারকে মুখর করে তুলেছিল তো বটেই, সেই অন্ধকারে তাদের সৃষ্টিকর্তাও যেন আমার মনের মধ্যে এসে এক চির আসনের অধিকার গ্রহণ করেছিলেন। আমার মনের মধ্যে সেই থেকে নানা রবীন্দ্রনাথের নিরন্তর যাওয়া- আসার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুরু হল।

সেই সময় টকিতে গান দিত। কৃষ্ণনগরে তখন একটিমাত্র সিনেমা হল ছিল, চিত্রমন্দির। সন্ধ্যার শোয়ের ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই লাউডস্পিকারে গান বাজানো শুরু হত, সেটা আসলে ছিল একটা সময় সংকেত। সবাই বলত টকিতে গান দিচ্ছে, তা হলে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবং কী আশ্চর্য, সেই সব গানের অধিকাংশই ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। আবার এই রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগই ছিল বাংলা সিনেমায় সংযোজিত। সিনেমায় অভিনয়ের ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা বলে, এখন বাংলা সিনেমা রবীন্দ্রনাথের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না। আমার ছেলেবেলায় অবশ্য অনেক রবীন্দ্র গানের ব্যবহার হত সিনেমায়।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল
আমার রবীন্দ্রনাথ- রবিশংকর বল

 

বাড়িতে আমাদের নাটক হত। তখন সেই চল ছিল, তক্তপোষ জোড়া দিয়ে মঞ্চ, চাদর দিয়ে যবনিকা, মায়ের শাড়ি দিয়ে উইংস তৈরি করে আমরা যখন নাটক করতাম তখন দর্শক থাকত বাড়ির লোক, দু-একজন প্রতিবেশী এবং বাড়ির কাজের লোকেরা। বাবা একবার বলল, রবিঠাকুরের ‘মুকুট’ করতে। সিগারেটের প্যাকেটের রাংতা কেটে কেটে মুকুট তৈরি করে দিল মা। ‘মুকুট’ করার পর হঠাৎ যেন নাট্যকারের কথা ভাবতে বসলাম। একটা বিস্ময়বোধ এসে পড়ল।

যিনি ‘বীরপুরুষ’ লিখেছেন, তিনিই ‘মুকুট’ লিখেছেন। তাঁরই গান টকিতে বাজে। ‘তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই’— শরৎচন্দ্র যাঁকে দেখে লিখেছিলেন তাঁর পরিচয়ের বিপুলতা সম্পর্কে সেই প্রথম একটা বিস্ময়বোধ জেগে উঠল সেদিনের সন্ধ্যায়। সেই বিস্মিত মুগ্ধতার মধ্যে সম্ভবত একটা অস্ফুট প্রণতিও ছিল।

১৯৪৫ সালে আমাদের কৃষ্ণনগর ছেড়ে দিয়ে নানা জায়গায় যাওয়া শুরু হল বাবার চাকরির সূত্রে। তবে কলেজে পড়তে শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথের শহর এই কলকাতায়। বিজ্ঞানের সঙ্গে সামান্য গা ঘেঁঘাঘেষি করে শেষ পর্যন্ত স্নাতক হলাম বাংলা সাহিত্যে। ততদিনে রবীন্দ্রনাথের গানই শুধু নয়, অন্যান্য সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পেতে আরম্ভ করেছি। দিনে দিনে তাঁর সৃজনধারার কলিতে আমারও মনোভূমি গঠন হয়েছে।

নিজে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম কৈশোরেই, স্কুলের শেষের দিকে, রবীন্দ্রনাথ কীভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন তা সবার মতো আমিও জেনেছিলাম। এবং তাই দেখেই যেন এক ধরনের সাহস পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম শুরুটা হলই বা খারাপ, লিখতে লিখতে পরে ভালো হয়ে যাবে। লিখতে লিখতে ক্রমে বুঝতে পেরেছিলাম, রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কবিতার বাকি দিকটি ধরতে গেলে কী করে রবীন্দ্রনাথের মতো করে লিখব না, তার অনুসন্ধান করতে হবে। সেই অনুসন্ধানের প্রয়াসে আমার কবিতা লেখার অনেকটাই কেটেছে। অথচ আমি কেন লিখি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে নিজের অন্তঃস্থলের অনুভব বলতে থাকে, আমি লিখি কেন না তার আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। সেই উত্তরাধিকার তো ছাড়তে পারি না।

কলেজে পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম আমারও যা কিছু, তার অনেকটাই জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই যে ছয়টি ঋতুর ফুলে ফলে জীবন ভরে উঠছে, তা হয়তো জানতেই পারতাম না যদি না চিনিয়ে দিতে তিনি থাকতেন। কিন্তু প্রকৃতির এই দানকে চিনতে গিয়ে তো রবীন্দ্রনাথকেই নতুন করে চিনেছি। বর্ষার রাতে যখন মনে পড়েছে তাঁর গান ঝর ঝর বরিষে বারিধারা…’ তখন পরের বাক্যটা বারবার ধুয়োর মতো ফিরে এসে বিশ্বস্ত করে দিয়েছে। হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা।’ জোড়াসাঁকোর প্রাসাদোপম বাড়িতে তাঁর জন্ম, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বাঁকে পিঠ সোজা করে পরিশ্রম করতে হয়নি, তিনি কেমন করে জেনেছিলেন পথবাসী গৃহহীনদের দুঃখ?

কলেজে থাকতেই আমার মামার ক্যান্সার হয়েছিল। অবধারিত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলল, আমার খুব গান শুনতে ইচ্ছে করছে, শোনাতে পারিস। আমি যেরকম পারি, সেভাবেই গাইলাম। দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। গান শুনতে শুনতে মামার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমি বললাম, তোমার যদি কষ্ট হয় তবে গাইব না। মামা বলল, না রে গান কর। গান শুনে মনে বল পাচ্ছি। তখন আমি গাইলাম, “শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে।’ চোখ বুজে গান গাইতে গাইতে আমি যেন দেখলাম, রবিঠাকুর রোগীর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছেন।

সত্যি কথা বলতে, কৈশোর থেকে আজ অবধি বৃদ্ধ বয়সে আমি যতবার মৃত্যুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, শোকে-তাপে- বেদনায়, মন যখন নুইয়ে পড়েছে, তখনই দেখেছি আমার অন্তরবাসী রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেরই এইসব অভিজ্ঞতা আছে। তবে সেখানে নিজস্ব রবীন্দ্রনাথের কথা কেন বলি? যে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন, যিনি গল্প-উপন্যাসের কথাকার, চিন্তানায়ক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, দিশারী চিত্রকর, তিনি আবার কর্মী, কর্মযজ্ঞে ঋদ্ধি, সমাজ সচেতক, সংগঠক, দেশের বন্ধনমুক্তির ভগীরথ, সেই নানা রবীন্দ্রনাথ শতাধিককাল বাঙালির মনকে আচ্ছন্ন করে আছে। আমারও মনের অনেকটাই তিনিই তো পরোক্ষে ভরে দিয়েছেন।

আমার নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে কিন্তু গড়ে নিয়েছি আমিই। সেখানে তিনি আমার অনাত্মীয় অপরিচিত কেউ নন, তিনি একজন ব্যক্তি। এবং জীবন্ত, জীবিত। তাঁকে শুধু আমি গড়ে তুলিনি, তাঁকে আমি বাঙ্ময় করেছি। তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলি, তিনি আমাকে নির্দেশ দেন, তিরস্কার করেন, এমনকী দু-এক সময় প্রশ্রয়ও দেন। শত সূর্যের থেকে ভাস্বর, তাঁর সৃজন ক্ষমতার মধ্যে সব সময় তাঁকে আমি খুঁজি না। আমি কখনও বা মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে ব্যক্তিগত শোকের মুহূর্তে তাকে চিনে নিতে চাই। তাঁর পরম আদরের পুত্র শমীর মৃত্যু হয় ৭ অগ্রহায়ণ, ১৩১৪ সাল।

৭ অগ্রহায়ণ কবি-পত্নীরও মৃত্যুদিন। শমীর জীবনদীপ নির্বাপিত হওয়ার পর শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের শিক্ষক ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে তিনি বললেন, ‘এই সময় যাহা কিছু কৃত্য আমি করিয়া দিলাম, এখন অবশেষে যাহা কর্তব্য আপনি করুন। ব্রাহ্মণের মতনই শমীর শেষকৃত্য যেন হয়, আর আমার কিছু বলিবার নাই।’ শমীর উপনয়ন সংস্কার হয়নি বলেই পিতা রবীন্দ্রনাথ সেই কৃত্যটুকু করে দিলেন।

 

আমার রবীন্দ্রনাথ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
আমার রবীন্দ্রনাথ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

 

শেষকৃত্যের পরে ভূপেন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আমি ও শ্রীশবাবু তখন রবীন্দ্রনাথের গৃহে প্রবেশ করিলাম, শ্রীশবাবু অত্যন্ত ব্যাকুল হইলেন, চক্ষে তাহার ধারা আর থামে না, আমারও চক্ষে ধারা বহিতেছিল। এই সময় রবীন্দ্রনাথেরও চক্ষে ধারা বহিতে লাগিল। আমি তাহার অশ্রুপাত দেখিয়া যেন একটু আশ্বস্ত হইলাম, তাঁর সেই নিশ্চল গম্ভীর ভাব ও শোকপূর্ণ অবস্থা দেখিয়া মনে বড় আতঙ্ক জন্মিয়াছিল। এ কথা পড়ে আমিও আশ্বস্তবোধ করি এই জেনে যে তিনি সাধারণ একজন মানুষের মতো শোকে-দুঃখে কাতর হয়েছেন। এই ব্যক্তিকে তখন মানুষ বলে চিনতে পারি।

মুঙ্গের থেকে ফেরার সময় লিখেছেন তিনি—শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বলল কম পড়েনি। সমস্তের মধ্যে সব রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে। সমস্তের জন্য আমার কাজও বাকি রইল, যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে। কোনওখানে কোনও সূত্রে যেন ছিন্ন হয়ে না যায়। যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাকেও যেন সম্পূর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে।’ যে ব্যক্তি এ কথা লিখেছেন তিনি মানুষ বই কি।

মহামানব ছাড়া জীবন-মৃত্যু দিয়ে এমন করে একাসনে আর কে বসাতে পারে! এখানেই তিনি এক এবং দ্বিতীয়রহিত। কিন্তু একলা। সেই একলা রবীন্দ্রনাথকে আমি যেন মাঝে মাঝে দেখতে পাই। তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলি। আমার নিজের একাকিত্ব সহনীয় করতে তাঁর নির্দেশ চাই। শমীর মৃত্যুর কুড়িদিন পরে যে গান লিখেছিলেন, হয়তো তা শুধু প্রার্থনা নয়, নির্দেশও বটে। আমি সেই একাকী রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারি, যাঁকে রবি বলে ডাকবার মানুষ অবশিষ্ট ছিল না। গানে যিনি বলেছিলেন, ‘কে আছে নাম ধরে মোর ডাকতে পারে।’ আমি ভাবি, হয়তো বা তা এক ব্যক্তিগত আক্ষেপ। তেমন কথা তো আমারও কথা।

ওসকরা থেকে বেশ প্রত্যন্তে নুরপুর গ্রাম। সেই গ্রামের বাসিন্দা তমাল দাস। তাকে অনেকের মতো আমিও দেখেছি শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে ট্রেনে। অনেকবারই দেখেছি। একটা হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গান গাইছে। লোকে টাকা ভিক্ষের মতোই দিচ্ছে। চা-কফি-বাদাম-ল্যাবেঞ্চুস-সিঙারা ফিরি করে কত লোক, আমার মনে হয়েছিল ও গান ফিরি করে। আমারই মতো ‘পারফরমিংস’ বেচে খায়।

খালি যারা চিনেবাদাম বা ঝালমুড়ি বিক্রি করে তাদের থেকে লোকটা আলাদা, গান ফিরি করে বলেই শুধু নয়, এমনকী যে দু-চারজন গান ফিরি করে তাদের থেকেও তফাত আছে, ও রবিঠাকুরের গানই শুধু গায়। একজন সঙ্গীতশিক্ষক সংবাদপত্রে চিঠি লিখেছেন, তিনি ভ্রমণপথে তার গান শুনে তার রবীন্দ্র গানের শিক্ষায় ভুল ধরেছিলেন। কিন্তু সেদিন সে শিক্ষার অভ্রান্ততায় স্থির ছিল। পরে বাড়ি ফিরে সঙ্গীতজ্ঞ ভদ্রলোক স্বরবিতান খুলে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তমালই ঠিক গাইছে, তিনি ভুল বলেছিলেন—এমন কথা সংবাদপত্রে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন।

আমি একটা রেডিয়ো চ্যানেল থেকে তমালের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে। সে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথের গান করে ঠিকই, সে বলে এটা তার জীবিকাও বটে। সে তার প্রিয় অনেকগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনায়। বলে, এই গান করতে গিয়ে তার বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে ট্রেনে। আমি সামান্য পরিহাসের ছলেই তাকে প্রশ্ন করি, এমনভাবেই যদি ট্রেনে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়ে যায় তা হলে সে কী করবে? সে এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বলে, আমি গাইব, ‘প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর, তুমি দেহো মোরে কথা, তুমি দেহো মোরে সুর। সমাজের প্রান্তবাসী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত এক গানের ফেরিওয়ালার মধ্যে যখন এতবড় শিল্পবোধ, এত গভীর অথচ সহজ সাধনার সন্ধান পাই, তখন বুঝি রবীন্দ্রনাথ আছেন, থাকবেন। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুত্তীর্ণ।

 

আরও পড়ুনঃ

মন্তব্য করুন