আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত কণ্ঠস্বর শ্রীজাত (শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়) তাঁর কাব্যে সমকালীন ভাবনা, রূপকল্পের অভিনবতা এবং ভাষার সৃজনশীল ব্যবহার দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করে আসছেন। কবিতা ছাড়াও গান, গদ্য ও চিত্রনাট্য রচনায় তাঁর দক্ষতা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। গভীর আবেগের সঙ্গে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ততার মেলবন্ধন তাঁর লেখায় এক স্বতন্ত্র সুর এনে দেয়।
“আমার রবীন্দ্রনাথ” শিরোনামের নিবন্ধে শ্রীজাত তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি, সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা এবং কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রাপ্ত অনুপ্রেরণার কথা। নিজের সৃজনশীল যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান ও দর্শনের প্রভাব তিনি কাব্যময় ও অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। এটি কেবল একজন কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিষ্কারের এক সৃজনশীল স্বাক্ষর।

অনেক ছোটবেলায় একবার সান্তাক্লজের সঙ্গে রবি ঠাকুরকে খুব গুলিয়ে ফেলেছিলাম। সে কথা আগেও হয়তো বলেছি কোথাও। বলিনি যেটা সেটা হল এই যে, এখনও সেই গুলিয়ে ফেলা ভাবটা যায়নি। ক্যালেন্ডারে হাঁটতে গিয়ে থমকে যাওয়া গম্ভীরপানা রবিঠাকুরকে দেখে বারবার ভেবেছি, আরে মস্ত ঝোলা টুপিটা কোথায় গেল? শীতের সন্ধেবেলা রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া কেকের প্যাকেটে সান্তার ছবি দেখেও মনে হয়েছে, আলখাল্লা মিসিং।
মোট কথা, এই গুলিয়ে ফেলার তেমন কিছু মীমাংসা আমি করে উঠতে পারিনি আজও। কত কতবার চোখ বুজেই দেখতে পেয়েছি বরফের কুচি উড়িয়ে বল্গা হরিণে টানা স্লেজগাড়িতে চড়ে দাড়িবুড়ো আসছে আমাদের পাড়ায়, তার পিঠের ইয়া ঝুলিতে সে যে কত্তরকমের উপহার, তা আর বলার না। আমারও চিঠি গেছে তার কাছে, ঘুম ভেঙে বালিশের নীচে ঠিকঠাক জিনিসটা না দেখলে ঝগড়া হবে। নো ছাড়াছাড়ি। তবে হ্যাঁ, ভুল কিন্তু একবারও হয়নি। যেবার যা চেয়েছি, মোজায় ভরে দিব্যি রেখে গেছে সান্তাবুড়ো।
বন্ধুদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা করে জেনেছি, তাদেরও বালিশের তলা ভরে উঠেছে চাহিদামতো। খুব পছন্দ হয়ে গেছে দাড়িবুড়োকে। ভালো লোক। কাগজ থেকে ছবি কেটে পড়ার টেবিলের সামনের দেওয়ালে সেঁটেছি, ও পাড়ার মাসিমা বাড়িতে এসে মাকে বললেন— ও মা, ছেলে এই বয়েসেই কী বুঝদার হয়েছে দিদিভাই, দেওয়ালে কেমন রবীন্দ্রনাথের ছবি লাগিয়েছে। আমারটাকে দ্যাখো গিয়ে, ঘরভরতি কেবল আজেবাজে জিনিস। ঠাকুর দেবতায় একেবারে মন নেই।’ বুঝলাম, ব্যাপার ঝামেলার। সান্তাক্লাজই, কীভাবে কে জানে, ‘সহজ পাঠ’ লিখেছে।
আবি অবশ্য মোটেও দমে যাইনি এই ঘটনায়, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে সান্তাবুড়োর আরও সব লেখা পড়তে শুরু করেছিলাম। সান্তা কত গুণী লোক, এটা বুঝতে পেরে মনটা ভালোলাগায় ভরে উঠেছিল। আরও ভালো লাগত এটা ভেবে যে, আমি এই বয়েসেই তার কদর বুঝতে শুরু করেছি। ‘সহজ পাঠ’ এমনিতেই দারুণ পছন্দের বই ছিল আমার, বাকি বইগুলোও বেশ লাগল। লেখার হাত আছে সাম্ভার, মানতেই হয়। তারপর দেখলাম, ও মা, গানও লিখেছে প্রচুর। লিখেই ক্ষান্ত হয়নি, তাতে আবার সুর বসিয়েছে। সেই গান যখন দল বেঁধে বন্ধুরা গাইলাম স্কুলের ফাংশনে, কী যে মজা হল।
সান্তাবুড়োর লেখা বাংলা গান গাইছি, ভেবেই আনন্দ হল খুব। কী দিন ছিল সেটা? ২৫ বৈশাখ। তখনও ২৫ বৈশাখ মানে স্কুলে গিয়ে রবি ঠাকুর পুজো। স্কুলের বাইরে যে পৃথিবী, সেখানে এই দিনটার কী দাপট, বোঝার সময় আসেনি তখনও। ফিটফাট হয়ে স্টেজে উঠে হাতজোড় করে— ‘নমস্কার’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’…করেই আমাদের ২৫ বৈশাখ সারা। তারপর বড়দের হাত ধরে কলকাতাও ঘুরলাম কিছু, দেখলাম অনেক জায়গায় সাত্তার মূর্তি রয়েছে (একটাতেও টুপি রাখেনি), এমনকী তার নামে জায়গা থেকে শুরু করে গানবজানার জন্যে হল পর্যন্ত আছে। বুঝলাম, সান্তাক্লজ আসলে কবির ছদ্মবেশে ঠাকুর। অনেকে মানে
সেই একবার তারপর রবীন্দ্রজয়ন্তী দেখতে পেলাম। পাড়ায় সতরঞ্চি পেতে ছোটখাটো হত, সেসবে আবার কালবৈশাখীর ভয় থাকত। বানচালও হয়েছে কতবার, স্টেজ-টেজ নড়ে গিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। সেরকম না। আসল রবীন্দ্রজয়ন্তী। রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে। ভোর থেকে নাকি রবি ঠাকুরের গান গাইছে সকলে। রাত অবদি নাকি গাইবে। প্রথমটায় তো ভেবেছি মিথ্যে কথা। তারপর দেখি সত্যি-সত্যি। অ্যাত্তোবড় ম্যারাপ খাটিয়ে ফ্যানের ব্যবস্থা করে ঝালমুড়ি আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে এক বিশাল কাণ্ড। রবি ঠাকুরের জন্মদিন। শুধু এখানে নয়, কলকাতার কত কত জায়গায় এমনটা হচ্ছে সারাদিন। শুধু একটা দিন নয়, গোটা দু-সপ্তাহ ধরে হবে। এমনই হয়, প্রতিবার। ২৫ বৈশাখ যে আমাদের বড়দিন, বুঝেছিলাম তখনই ।

তারপর পঁচিশটারও বেশি বড়দিন পেরিয়ে গিয়েছি আমি, উপহারের ইচ্ছেগুলো এত অন্যকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বালিশের নীচে ধরতে চায় না কিছুতেই। কলকাতা চষে বুঝতে পেরে গিয়েছি, সান্তাক্লজের টুপি আসলে একটা মিথ। কিন্তু সান্তা কক্ষনও মিথ্যে নয়। এই তো, এ বছর দেড়শো বছরে পা দেবে বুড়ো। সেই নিয়ে দারুণ হইচই। আমি অবশ্য আলাদা করে বুঝে উঠতে পারছি না তেমন। কারণ আমার মনে হয়, রবি ঠাকুরের বয়েস কখনও দেড়শো হতেই পারে না। আমার রবি ঠাকুরের বয়েস এখন ৩৫। আমিতো এই ক’টা বছর ধরেই দেখছি পড়ছি শুনছি মানুষটাকে।
তার বয়েস কী করে এর বেশি হয়? এ তো সহজ হিসেব। তাই আমার রবি ঠাকুরের বয়েস এখন ৩৫। আবার সবে স্কুলে যাওয়া আমার ছোট্ট ভাগ্নির রবি ঠাকুরের বয়েস এখন সাড়ে তিন। এদিকে ও পাড়ার সেই মাসিমার রবি ঠাকুর অ্যাদ্দিনে নির্ঘাত ৬৩। রবি ঠাকুর এইরকমই। যেখানে যখন যার যত বয়েস, তার রবি ঠাকুরেরও তখন তত বয়স। রবি ঠাকুরের তাই অনেকগুলো বয়স। ১৭-র রবি ঠাকুর, ২৮-এর রবি ঠাকুর। আর দেড়শো বছরের কেউ যদি বেঁচে থাকেন কোথাও, তা হলে বলতে হবে কপাল ভালো, এ বছর রবি ঠাকুরের দেড়শোও হয়ে যাবে।

২৫ বৈশাখ সব ভালো, কেবল খুব গরম বলে কষ্ট পান মানুষজন। দরদর করে ঘেমেনেয়ে গায়ে সেঁটে যাওয়া পোশাক নিয়েই তবু তাঁরা হাজির হন এই চাঁদোয়া থেকে ওই শামিয়ানার নীচে, একের পর এক ভেজা রুমাল নিংড়ে পালন করে যান রবি ঠাকুরের জন্মদিন। কষ্ট একটু কম হতে পারে, কারণ আমার কাছে গরম না লাগার একটা ছোট্ট টোটকা আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারার পরে থেকেই এই দিনটায় কিছুতেই গরম লাগে না আমার। অনেক তর্ক ঝামেলা নিয়ম পেরিয়ে আমি শেষমেষ মেনেই নিয়েছি রবি ঠাকুরই আসলে সান্তাক্লজ। এ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বাড়াই না, কেবল গনগনে ২৫ বৈশাখে সূর্য মাথার ওপর চলে গেলে মনে মনে ভাবি, আজ তো তাঁর জন্মদিন।
দূর কোনও বরফে ঢাকা গ্রাম থেকে রাত থাকতেই পিঠে ঝুলি চাপিয়ে টুংটাং ঘণ্টা হাতে নিয়ে স্লেজে উঠছে কেউ একজন, ঘুমের মধ্যেও শোনা যাচ্ছে হরিণপায়ের থুপথুপ শব্দ, আর বরফের কুচি উড়ে এসে লাগছে গায়ে, শীত করছে খুব…তাও এই মাথার ওপর সূর্য ওঠা বরফের রাত নিয়ে আমি জেগে আছি তার জন্যে…সে আমার উপহার নিয়ে আসবে…হ্যাঁ, ২৫ তারিখই তো আজ, ডিসেম্বরের ২৫, বাংলায় যাকে বৈশাখ বলে ডাকে সবাই…আজই তো বড়দিন আমাদের সক্কলের…আমার ঠান্ডা লাগতে থাকে খুব…শান্ত একটা লেপের ভিতর গুটিসুটি হয়ে ঢুকে আমি অপেক্ষা করি সাদা দাড়িওলা সেই বুড়োর…মনে মনে যাকে আমি সান্তা ঠাকুর বলে ডাকি।
