ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ]
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ পলাতকা [ ১৯১৮ ]
কবিতার শিরোনামঃ ছিন্ন পত্র
![ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 2 ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর](https://amarrabindranath.com/wp-content/uploads/2022/04/images-40-3.jpeg)
ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কর্ম যখন দেবতা হয়ে জুড়ে বসে পূজার বেদী,
মন্দিরে তার পাষাণ-প্রাচীর অভ্রভেদী
চতুর্দিকেই থাকে ঘিরে;
তারি মধ্যে জীবন যখন শুকিয়ে আসে ধীরে ধীরে
পায় না আলো, পায় না বাতাস, পায় না ফাঁকা, পায় না কোনো রস,
কেবল টাকা, কেবল সে পায় যশ,
তখন সে কোন্ মোহের পাকে
মরণদশা ঘটেছে তার, সেই কথাটাই ভুলে থাকে।
![ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 3 ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর](https://amarrabindranath.com/wp-content/uploads/2022/04/images-40-4.jpeg)
আমি ছিলেম জড়িয়ে পড়ে সেই বিপাকের ফাঁসে;
বৃহৎ সর্বনাশে
হারিয়েছিলেম বিশ্বজগৎখানি।
নীল আকাশের সোনার বাণী
সকাল-সাঁঝের বীণার তারে
পৌঁছত না মোর বাতায়ন-দ্বারে।
ঋতুর পরে আসত ঋতু শুধু কেবল পঞ্জিকারই পাতে,
আমার আঙিনাতে
আনত না তার রঙিন পাতার ফুলের নিমন্ত্রণ।
অন্তরে মোর লুকিয়ে ছিল কী যে সে ক্রন্দন
জানব এমন পাই নি অবকাশ।
প্রাণের উপবাস
সংগোপনে বহন করে কর্মরথে
সমারোহে চলতেছিলেম নিষ্ফলতার মরুপথে।
তিনটে চারটে সভা ছিল জুড়ে আমার কাঁধ;
দৈনিকে আর সাপ্তাহিকে ছাড়তে হত নকল সিংহনাদ;
বীডন কুঞ্জে মীটিং হলে আমি হতেম বক্তা;
রিপোর্ট লিখতে হত তক্তা তক্তা;
যুদ্ধ হত সেনেট-সিন্ডিকেটে,
তার উপরে আপিস আছে, এমনি করে কেবল খেটে খেটে
দিনরাত্রি যেত কোথায় দিয়ে।
বন্ধুরা সব বলত, “করছ কী এ।
মারা যাবে শেষে!”
আমি বলতেম হেসে,
“কী করি ভাই, খাটতে কি হয় সাধে।
একটু যদি ঢিল দিয়েছি অমনি গলদ বাধে,
কাজ বেড়ে যায় আরো–
কী করি তার উপায় বলতে পার?”
বিশ্বকর্মার সদর আপিস ছিল যেন আমার ‘পরেই ন্যস্ত,
অহোরাত্রি এমনি আমার ভাবটা ব্যতিব্যস্ত।
![ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 4 ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর](https://amarrabindranath.com/wp-content/uploads/2022/04/images-40-2.jpeg)
সেদিন তখন দু-তিন রাত্রি ধরে
গত সনের রিপোর্টখানা লিখেছি খুব জোরে।
বাছাই হবে নতুন সনের সেক্রেটারি
হপ্তা তিনেক মরতে হবে ভোট কুড়োতে তারি।
শীতের দিনে যেমন পত্রভার
খসিয়ে ফেলে গাছগুলো সব কেবল শাখা-সার,
আমার হল তেমনি দশা;
সকাল হতে সন্ধ্যা-নাগাদ এক টেবিলেই বসা;
কেবল পত্র রওনা করা,
কেবল শুকিয়ে মরা।
খবর আসে “খাবার তৈরি”, নিই নে কথা কানে,
আবার যদি খবর আনে,
বলি ক্রোধের ভরে
“মরি এমন নেই অবসর, খাওয়া তো থাক পরে।”
বেলা যখন আড়াইটে প্রায়, নিঝুম হল পাড়া,
আর-সকলে স্তব্ধ কেবল গোটাপাঁচেক চড়ুই পাখি ছাড়া;
এমন সময় বেহারাটা ডাকের পত্র নিয়ে
হাতে গেল দিয়ে।
জরুরি কোন্ কাজের চিঠি ভেবে
খুলে দিখি বাঁকা লাইন, কাঁচা আখর চলছে উঠে নেবে,
নাইকো দাঁড়ি-কমা,
শেষ লাইনে নাম লেখা তার মনোরমা।
আর হল না পড়া,
মনে হল কোন্ বিধবার ভিক্ষাপত্র মিথ্যা কথায় গড়া,
চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলে আবার লাগি কাজে।
এমনি করে কোন্ অতলের মাঝে
হপ্তা তিনেক গেল ডুবে।
সূর্য ওঠে পশ্চিমে কি পুবে,
সেই কথাটাই ভুলে গেছি, চলছি এমন চোটে।
এমন সময় ভোটে
আমার হল হার,
শত্রুদলে আসন আমার করলে অধিকার;
তাহার পরে খালি
কাগজপত্রে চলল গালাগালি।
![ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 5 ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর](https://amarrabindranath.com/wp-content/uploads/2022/04/images-40-1.jpeg)
কাজের মাঝে অনেকটা ফাঁক হঠাৎ পড়ল হাতে,
সেটা নিয়ে কী করব তাই ভাবছি বসে আরামকেদারাতে;
এমন সময় হঠাৎ দখিন-পবনভরে
ছেঁড়া চিঠির টুকরো এসে পড়ল আমার কোলের ‘পরে।
অন্যমনে হাতে তুলে
এই কথাটা পড়ল চোখে, “মনুরে কি গেছ এখন ভুলে।”
মনু? আমার মনোরমা? ছেলেবেলার সেই মনু কি এই।
অমনি হঠাৎ এক নিমেষেই
সকল শূন্য ভ’রে,
হারিয়ে-যাওয়া বসন্ত মোর বন্যা হয়ে ডুবিয়ে দিল মোরে।
সেই তো আমার অনেক কালের পড়োশিনী,
পায়ে পায়ে বাজাত মল রিনিঝিনি।
সেই তো আমার এই জনমের ভোর-গগনের তারা
অসীম হতে এসেছে পথহারা;
সেই তো আমার শিশু কালের শিউলিফুলের কোলে
শুভ্রশিশির দোলে;
সেই তো আমার মুগ্ধ চোখের প্রথম আলো,
এই ভুবনের সকল ভালোর প্রথম ভালো।
মনে পড়ে, ঘুমের থেকে যেমনি জেগে ওঠা
অমনি ওদের বাড়ির পানে ছোটা।
ওরি সঙ্গে শুরু হত দিনের প্রথম খেলা;
মনে পড়ে, পিঠের ‘পরে চুলটি মেলা
সেই আনন্দমূর্তিখানি স্নিগ্ধ ডাগর আঁখি,
কণ্ঠ তাহার সুধায় মাখামাখি।
অসীম ধৈর্যে সইত সে মোর হাজার অত্যাচার,
সকল কথায় মানত মনু হার।
উঠে গাছের আগডালেতে দোলা খেতেম জোরে,
ভয় দেখাতেম পড়ি-পড়ি ক’রে,
কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে তাহার করুণ মিনতি সে,
ভুলতে পারি কি সে।
মনে পড়ে নীরব ব্যথা তার,
বাবার কাছে যখন খেতেম মার;
ফেলেছে সে কত চোখের জল,
মোর অপরাধ ঢাকা দিতে খুঁজত কত ছল।
আরো কিছু বড়ো হলে
আমার কাছে নিত সে তার বাংলা পড়া ব’লে।
নামতাটা তার কেবল যেত বেধে,
তাই নিয়ে মোর একটু হাসি সইত না সে, উঠত লাজে কেঁদে।
আমার হাতে মোটা মোটা ইংরেজি বই দেখে
ভাবত মনে, গেছে যেন কোন্ আকাশে ঠেকে
রাশীকৃত মোর বিদ্যার বোঝা।
যা-কিছু সব বিষম কঠিন, আমার কাছে যেন নেহাত সোজা।
হেনকালে হঠাৎ সেবার,
দশমীতে দ্বারিগ্রামে ঠাকুর ভাসান দেবার
রাস্তা নিয়ে দুই পক্ষের চাকর-দরোয়ানে
বকাবকি লাঠালাঠি বেধে গেল গলির মধ্যখানে।
তাই নিয়ে শেষ বাবার সঙ্গে মনুর বাবার বাধল মকদ্দমা,
কেউ কাহারে করলে না আর ক্ষমা।
দুয়ার মোদের বন্ধ হল,
আকাশ যেন কালো মেঘে অন্ধ হল,
হঠাৎ এল কোন্ দশমী সঙ্গে নিয়ে ঝঞ্ঝার গর্জন,
মোর প্রতিমার হল বিসর্জন।
![ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 6 ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর](https://amarrabindranath.com/wp-content/uploads/2022/04/images-40.jpeg)
দেখাশোনা ঘুচল যখন এলেম যখন দূরে,
তখন প্রথম শুনতে পেলেম কোন্ প্রভাতী সুরে
প্রাণের বীণা বেজেছিল কাহার হাতে।
নিবিড় বেদনাতে
মুখখানি তার উঠল ফুটে আঁধার পটে সন্ধ্যাতারার মতো;
একই সঙ্গে জানিয়ে দিলে সে যে আমার কত,
সে যে আমার কতখানিই নয়!
প্রেমের শিখা জ্বলল তখন, নিবল যখন চোখের পরিচয়।
কত বছর গেল চলে
আবার গ্রামে গিয়েছিলেম পরীক্ষা পাস হলে।
গিয়ে দেখি, ওদের বাড়ি কিনেছে কোন্ পাটের কুঠিয়াল,
হল অনেক কাল।
বিয়ে করে মনুর স্বামী
কোন্ দেশে যে নিয়ে গেছে, ঠিকানা তার খুঁজে না পাই আমি।
সেই মনু আজ এতকালের অজ্ঞাতবাস টুটে
কোন্ কথাটি পাঠাল তার পত্রপুটে।
কোন্ বেদনা দিল তারে নিষ্ঠুর সংসার–
মৃত্যু সে কি। ক্ষতি সে কি। সে কি অত্যাচার।
কেবল কি তার বাল্যসখার কাছে
হৃদয়ব্যথার সান্ত্বনা তার আছে।
ছিন্ন চিঠির বাকি
বিশ্বমাঝে কোথায় আছে খুঁজে পাব নাকি।
“মনুরে কি গেছ ভুলে।”
এ প্রশ্ন কি অনন্ত কাল রইবে দুলে
মোর জগতের চোখের পাতায় একটি ফোঁটা চোখের জলের মতো।
কত চিঠির জবাব লিখব কত,
এই কথাটির জবাব শুধু নিত্য বুকে জ্বলবে বহ্নিশিখা
অক্ষরেতে হবে না আর লিখা।
![ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 7 ছিন্ন পত্র chhinno potro [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর](https://amarrabindranath.com/wp-content/uploads/2022/04/images-40-1.jpg)
আরও পড়ুনঃ
বকুল-বনের পাখি bokul boner pakhi [ কবিতা ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর