শিশু কাব্যগ্রন্থের ঘুমচোরা কবিতা । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । Ghumchora

“ঘুমচোরা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু (১৯০৩) কাব্যগ্রন্থের একটি মায়াময় ও কল্পনাপ্রবণ কবিতা। এখানে শিশুমনের সরল ভাবনা, কৌতূহল, এবং কল্পনার জগৎ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কবি এক চোরের কাহিনি বুনেছেন, যে চোর চুরি করে শিশুদের ঘুম, আর সেই হারানো ঘুম ফিরে পেতে শিশুমন অভিযানে বেরিয়ে পড়ে। কাব্যিক ভঙ্গিতে এখানে প্রকৃতির নানা চিত্র, রূপকথার আবহ, ও রূপক অর্থে ভরপুর কল্পনার ভ্রমণ উপস্থাপিত হয়েছে।

কবিতার মৌলিক তথ্য

  • কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • কাব্যগ্রন্থ: শিশু (১৯০৩)

  • কবিতার নাম: ঘুমচোরা

  • বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: শৈশব, কল্পনা, প্রকৃতি, ফ্যান্টাসি

 

ঘুমচোরা – কবিতার পাঠ

কে নিল খোকার ঘুম হরিয়া।

মা তখন জল নিতে          ও পাড়ার দিঘিটিতে

             গিয়াছিল ঘট কাঁখে করিয়া।–

তখন রোদের বেলা           সবাই ছেড়েছে খেলা,

             ও পারে নীরব চখা-চখীরা;

শালিক থেমেছে ঝোপে,    শুধু পায়রার খোপে

             বকাবকি করে সখা-সখীরা;

তখন রাখাল ছেলে          পাঁচনি ধুলায় ফেলে

             ঘুমিয়ে পড়েছে বটতলাতে;

বাঁশ-বাগানের ছায়ে          এক-মনে এক পায়ে

             খাড়া হয়ে আছে বক জলাতে।

সেই ফাঁকে ঘুমচোর         ঘরেতে পশিয়া মোর

             ঘুম নিয়ে উড়ে গেল গগনে,

মা এসে অবাক রয়,         দেখে খোকা ঘর-ময়

             হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে সঘনে।

             আমার খোকার ঘুম নিল কে।

যেথা পাই সেই চোরে       বাঁধিয়া আনিব ধরে,

             সে লোক লুকাবে কোথা ত্রিলোকে।

যাব সে গুহার ছায়ে         কালো পাথরের গায়ে

             কুলু কুলু বহে যেথা ঝরনা।

যাব সে বকুলবনে           নিরিবিলি সে বিজনে

            ঘুঘুরা করিছে ঘর-করনা।

যেখানে সে-বুড়া বট        নামায়ে দিয়েছে জট,

             ঝিল্লি ডাকিছে দিনে দুপুরে,

যেখানে বনের কাছে        বনদেবতারা নাচে

             চাঁদিনিতে রুনুঝুনু নূপুরে,

যাব আমি ভরা সাঁঝে       সেই বেণুবন-মাঝে

          আলো যেথা রোজ জ্বালে জোনাকি–

   শুধাব মিনতি করে,       “আমাদের ঘুমচোরে

             তোমাদের আছে জানাশোনা কি।’

             কে নিল খোকার ঘুম চুরায়ে।

   কোনোমতে দেখা তার                পাই যদি একবার

             লই তবে সাধ মোর পুরায়ে।

   দেখি তার বাসা খুঁজি    কোথা ঘুম করে পুঁজি,

             চোরা ধন রাখে কোন্‌ আড়ালে।

   সব লুঠি লব তার,         ভাবিতে হবে না আর

             খোকার চোখের ঘুম হারালে

   ডানা দুটি বেঁধে তারে      নিয়ে যাব নদীপারে

             সেখানে সে ব’সে এক কোণেতে

   জলে শরকাঠি ফেলে       মিছে মাছ-ধরা খেলে

             দিন কাটাইবে কাশবনেতে।

  যখন সাঁঝের বেলা          ভাঙিবে হাটের মেলা

             ছেলেরা মায়ের কোল ভরিবে,

   সারা রাত টিটি-পাখি      টিটকারি দিবে ডাকি–

             “ঘুমচোরা কার ঘুম হরিবে।’

ভাবার্থ

এই কবিতায় কবি শিশুমনের সরল কল্পনা দিয়ে “ঘুমচোর” নামক এক অদৃশ্য চরিত্রের চিত্র আঁকেন, যে এসে খোকা বা শিশুর ঘুম চুরি করে নিয়ে যায়। ঘুম হারানো শিশুর মন যেন এক অভিযানপ্রবণ অভিযাত্রীর মতো চোরকে খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করে। কবিতায় প্রকৃতির বর্ণনা, গ্রামীণ জীবনের নিস্তব্ধতা এবং রূপকথার মতো কল্পনার জগৎ মিলেমিশে এক অসাধারণ চিত্র রচনা করেছে।

শব্দার্থ

  • ঘুমচোরা: কল্পিত চোর, যে ঘুম চুরি করে

  • চোখার চখা-চখী: এক ধরনের পাখি

  • বকুলবন: বকুল গাছের বাগান

  • টিটি-পাখি: এক ধরনের ডাকপাখি, যাকে শিশুরা গল্পে ও কবিতায় চেনে

মন্তব্য করুন