আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

আমার রবীন্দ্রনাথ [ চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ] : রবীন্দ্রনাথের মতো যারা দানবিক বিরাটর নিয়ে জন্মান, তারা অনেক কম বয়স পারেন। উপলব্ধি করেন, অন্য সকলের চেয়ে আমি বুঝছি বেশি, অনুভব করছি বেশি, আমার কল্পনা যাচ্ছে বহুদূর, আমার বুদ্ধি অনেক কিছু পড়ে ফেলছে এক্স রে রশ্মির অলীক দক্ষতায়, আমার মন অনেক রূপ রস বর্ণ ঘ্রাণের নিশ্চিত আভাস পাচ্ছে অন্যেরা যে-সব ব্যাপারে একদম কানা। এক একটা নির্জন দুপুর আমার বুকে খুঁড়ে দিয়ে যাচ্ছে হাঁ করা গর্ত, বাচ্চারা ঘিরে ধরে শামুক খুন করছে দেখে আমার কলজেময় রক্ত চুইয়ে পড়ছে দিনরাত্তির, আকাশভরতি আলোর চেয়ে আমার শরীর ও চৈতন্য জুড়ে জেগে উঠছে এমন থরথর শিরশির হু-হু, বালিশে মুখ গুঁজড়ে আড়াল রাখতে হচ্ছে সে আনন্দ কাঁপন।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
চন্দ্রীল ভট্টাচার্য

[ আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ]

কিছুদিন পর থেকেই অলৌকিক শক্তিধর মানুষরা নিজেদের আর একটি ক্ষমতার পরিচয় পান : তাঁরা অনুবাদ করে ফেলতে পারছেন এই আশ্চর্য আনন্দ-বিষাদকে, উদাস খাঁ-খাঁ চেয়ে থাকাকে, সারা শরীরের মধ্যে রিনরিন ঘুরে বেড়ানো অপূর্ব তরঙ্গকে। কেউ অনুবাদ করছেন বাক্যে, কেউ সুরে, কেউ রঙিন পেন্সিলের আঁচড়ে। তাতে তাঁরা বাহাদুরি তো পাচ্ছেনই, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় কথা : সেই সব কাণ্ড সম্পন্ন করার সময় একটা অবিশ্বাস্য ভালোলাগা ঘটছে, এমন একটা অতুলনীয় তুলকালাম আনন্দ, তার ধারেকাছে তৃপ্তিদায়ক কোনও অনুভূতি বিশ্বে আছে বলে মনেই হচ্ছে না।

এই নিজের মধ্যে অলৌকিক ডানার কুঁড়ি স্পষ্ট অনুভব করার পর সেই সব প্রতিভাবানরা কী করেন? অধিকাংশই, মানে আটানব্বই শতাংশই, চুপ করে শুয়ে শুয়ে পা দোলান ও মৃদু মৃদু হাসেন, অসামান্য আশীর্বাদের তাপ পোয়ান, এবং মনে করেন, নির্ঘাত বারেবারে আকাশ থেকে তাঁদের ঘাড়ে খসে পড়বে দৈববিদ্যুৎ, আর আপনা-আপনিই আঙুল বেয়ে বয়ে যাবে তার পরমতম প্রকাশ। এই এখন ঠিক যেমন অনায়াসে, যেন না চাইতেই কেউ জুগিয়ে দিচ্ছে অমোঘতম শব্দটি বা মোক্ষমতম রেখাটি, তেমনই ঘটে চলবে অনন্তকাল, এবং আজ্ঞাবহ প্রতিভা চির-নতজানু থাকবে তক্তপোশের সামনেটিতে। তাঁর তরফ থেকে কর্তব্য বলতে শুধু এই মহিমাময় অস্তিত্বটি রক্ষা করে যাওয়া, আর বিশ্বকে করতে করতে আলগোছে পদচারণ।

জীবন জুড়ে তাঁরা শেষ অবধি কী করেন? অবশ্যই সৃষ্টি করেন কিছু অভাবনীয় শিল্প। আর, অধিকাংশ মুহূর্তেই, অজস্র প্রতিকূলতার ছোঁচামির, অপমানের এবং সর্বোপরি অনুপ্রেরণাহৃত বাঁজা খরা সময়ের প্রবল নির্মম প্রহারে হয়ে পড়েন বিরক্ত ও বিষণ্ণ, নিষ্ফলা ও ধূসর, কোণঠাসা বেড়ালের মতো ফ্যাসফ্যাসে ও রাগি, কিছুতেই বুঝতে পারেন না গত বসন্তে যে ছন্দ ছিল ক্রীতদাসের মতো হুকুমবরদার ও হারেম-দাসীর মতো সোহাগী, সে আজ অকস্মাৎ ঠ্যাটা ও ঘাউড়া হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে কোন আক্কেলে।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ বয়সে এঁরা ক্রমাগত অ্যালবাম ওলটান, কয়েকটা ম্যান অফ দ্য ম্যাচ-এর পুরস্কারকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখেন ও পালিশ চড়ান, এবং শেষ অবধি চ্যালাদের ও আত্মীয়দের শোনান সেই সত্যি কিন্তু ঘ্যানঘ্যানে অভিমান : তাঁরা আসলে কত বৃহৎ ছিলেন এবং কীভাবে এই অকৃতজ্ঞ বসুন্ধরা তার দর দিল না। যিনি লিখতে পারতেন সত্তরটা অকল্পনীয় কবিতা, তিনি এইভাবে বাইশটা অপূর্ব কবিতা লিখেই ফৌত হয়ে যান, যিনি ভাস্কর্যে আনতে পারতেন চূড়ান্ত বিপ্লব, তিনি বদলের ইঙ্গিতটুকু দিয়েই নিষ্প্রভ হয়ে যান।

অবিশ্বাস্য কার্তুজ কব্জিতে দপদপ করা সত্ত্বেও, নিজেদের অভাবনীয় সম্ভাবনা পূর্ণতা লাভ করার আগেই নিজের বিরল ও একতম ফুলটির চূড়ান্ত বিকাশের আগেই আকাশ-ট্রাপিজের তুঙ্গ-উড়ানে পৌঁছনোর আগেই, এঁরা হেরে যান, পড়ে যান, পিছলে যান, পাশ ফিরে শুয়ে যান, এবং তাতে তাঁর কাছ থেকে তিনি নিজে ও সারা বিশ্ব যা লাভ করতে পারতেন বা পারত, সব ভাগেই অনেকটা কম পড়ে। সম্ভার শীর্ণ হয়ে যায়।

আর বাকি দুই শতাংশ প্রতিভাবান, যাঁরা হইচই করে জেগে ওঠেন লাবণ্যরৌদ্রে? তাঁরা দ্রুত বুঝতে পারেন, যে পতাকা কাঁধে ন্যস্ত করা হয়েছে, তা বহন করা, উড়িয়ে নিয়ে চলা ও আকাশের গায়ে চিহ্ন এঁকে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন যে অসম্ভব অপরিমিত শক্তি, ভালো ভাষায় বলতে গেলে ‘শকতি’, তা মিনিমাগনা মিলবে না। যেহেতু এই উপহার সাধারণ নয়, একে রক্ষা করার, লালন করার উপায়ও সাধারণ নয়, সহজ নয়। তার জন্য নিজেকে প্রতি মুহূর্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। মহৎ শিল্পীর তাই একটু আলগা দেওয়ার অবকাশ নেই। পাথুরে মাটির চাষার মতো লাগাতার নিজেকে নিংড়ে দিতে হবে।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

দিনমজুরের মতো, নাগাড়ে খাটতে হবে। অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে প্রেরণা আসামাত্র তা একদম উচ্চতম ভাষায় যথাযথতম সুরে অব্যর্থতম রেখায় প্রবাহিত হয়ে যায়। এক লহমাও থমকাতে না হয়, অস্ত্র খুঁজে পেতে যেন ক্ষণমাত্র দেরি না হয়। ভিতরবাইরের একগাদা দৈত্যের সঙ্গে লড়তে হবে। শুধু তো অপমান আসবে না, শুধু আসবে না কটুকাটব্য, একদম বুকের মধ্যিখান থেকে ফোয়ারার বেগে ছশ উঠে আসবে আত্মতুষ্টি। নিজের প্রতিটি বাক্যকে মনে হবে কোটেশন, প্রতিটি নড়নকে মনে হবে মুদ্রা, প্রতিটি উপবেশনকে মনে হবে সিংহাসনপীড়ন।

তখনও নিজেকে রক্ষা করতে হবে সমান কর্কশ ঢাল দিয়ে। যেমন ইতরের ঈর্ষা থেকে অক্ষমের ঝাল থেকে নীচের খিস্তি থেকে বাঁচাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজেকে আদর করতে হবে সান্ত্বনা দিতে হবে বোঝাতে হবে এ সমস্তই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে যদি তুমি তোমার কাজ ঠিকমতো করে যাও, তেমনি গাড়লের এঁটো হাসি হাত কচলানি দেখে নিজের ভেতরে যে বাষ্প ফেঁপে উঠছে, তাকে সবেগে পদাঘাত করতে শিখতে হবে। বারবার নিজেকে বলতে হবে এসব দু’পয়সার সিদ্ধাই ছাড়াই কিচ্ছু নয় এখনও অনেকে অনেক বাকি। সম্পূর্ণ আমার ঐশ্বর্য পেতে গেলে এখনও বহু জাগরণ প্রয়োজন।

যত প্রাইজ যত সাক্ষাৎকার যত বারফট্টাই চলুক না কেন, সাদা কাগজের সামনে যেন শিশুর মতোই নিঃস্ব ও সন্ধানী হয়ে ফের শুরু করতে পারি, সেই অমলিনতা টেনে আনতে হবে। নিজেকে ঈশ্বরের এক প্রিয় আধার হিসেবে গড়ে তোলা তো সোজা কথা নয়। শিল্পীকে এমন আধার দেওয়া হয়েছে, যা বিরল, অতলস্পর্শী, ধকধকে তেজিয়ান। সে ধারণ করতে পারে অগ্নিগর্ভ সত্য, ছলাৎছল আবেগ, তরবারির মতো যুক্তি, ক্ষারের মতো বোধ।

দিনযাপনের পাকের মধ্যে দিয়ে টেনে নিয়ে চলার সময়েও, গুঁড়ো কাচভরতি কাদার মধ্যে দিয়ে ঘষটে নিয়ে চলার সময়েও, সেই আধারের গভীরতাকে সমান রেখে দেওয়া, তার ডৌলকে অক্ষুণ্ণ রেখে দেওয়া, তার ভিতরকে তকতকে শুচি রেখে দেওয়া, জাগ্রত রেখে দেওয়া, প্রায় অলীক জিমন্যাস্টিকস। অপার্থিব কসরত। যাতে অনুভূতিরা এসে তার মধ্যে দিয়ে চিরকাল নবীর্ন বাঁশির মতোই সহজপথ পেয়ে বয়ে যেতে পারে, একটি পোড়খাওয়া ঘা-সওয়া টোবলানো থ্যাতা হৃদয়কে তেমনই সতেজ নলেন রাখব কীভাবে? কী করে মানুষিক লোভগুলি মানুষিক বিলাপগুলি মানুষিক প্রতিশোধস্পৃহাগুলি থেকে দূরে থাকব?

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

আর তা যদি থাকতে নাও পারি, তা হলেও শিল্পরচনাসময়ে তারা যেন কিছুতে কাছ ঘেঁষতে না পারে সেই মন্ত্রপূত বেড়া তৈরি করব কী করে? অকস্মাৎ টেবিলের সামনে ইজেলের সামনে ক্যামেরার সামনে কাঁটদষ্ট ফতুয়া পরিহার করে কীভাবে হয়ে পড়ব ফের এক তপতপে নিটোল উন্মোচিত পবিত্র আলোপাখি? বাইরে ট্যাক্সিওলার সঙ্গে সাংঘাতিক নোংরামো, কলিগের সঙ্গে মারাত্মক ধাস্টামো, বউয়ের সঙ্গে আন্তরিক শয়তানি করার পরে ভেতরঘরে এসেই কীভাবে নিজেকে জাদু-রূপান্তরিত করব এক নগ্ন মোমের পাতে, যেখানে শ্বাস ফেললেও দাগ পড়ে যায়, গাছ থেকে একটি চিকন পাতা খসলেও তার বেদনা আঁকা হয়ে যায় গভীর ও চারু সংকেতে?

এ সব প্রশ্ন আদ্ধেক প্রতিভাবানের মনেও আসে না। নিজের মতো লিখব থাকব আর খুব খানিক আশা করব আমার কাজে যেন কোনও প্রতিকূলতা না আসে, সবাই যেন আমায় ভালোবাসে, পুঁজিপতিরা যেন আমায় বিনিপয়সায় ফ্ল্যাট দেয়, আর এইসব না পেলেই স্তম্ভিত ও হতচকিত হয়ে প্রাণপণ বিলাপ করব ঠোট ফোলাব খেউড় গাইব ডিপ্রেশনে ভুগবঃ এই তো সরল জীবনচর্যা। এর মধ্যে আবার চব্বিশ ঘণ্টা মিলিটারির মতো জীবনব্যায়াম আসছে কোত্থেকে, আর আশ্চর্য প্রতিভাবান হয়েই যে আমি সব্বার মাথা কিনে নিয়েছি এই সাদা কথাটাকে ঘুলিয়ে আমাকেই বাধা না পেরোতে পারার জন্য দায়ী করা হচ্ছে কোনদেশি ফরমানে? কিন্তু কিছু প্রতিভাবান, খুব বিরল ও অল্পসংখ্যক প্রতিভাবান এই সাদাসাপটা স্ব-আরোপিত হাঁদামির বৃত্তে প্রবেশ করেননি।

রবীন্দ্রনাথের মতো লোক, যাঁরা ভাবতে শুরু করেছেন অনেক আগে থেকে, আর ভাবনার আওতায় নিজেকে রেখেছেন সমান ধারালো অনুবীক্ষণের তলায়, যাঁরা বুঝেছেন সচেতনের জীবনযাপন একটি পুরো সময়ের জাগ্রত চাকরি, জীবন মানে পড়ে-পাওয়া শ্বাসসমষ্টি মাত্র নয়, জীবন একটি ফুলটাইম জব এবং প্রতিভাবানের প্রতিভা যদি অর্ধেক হয় তা হলে আত্মপ্রয়োগ বাকি অর্ধেক এবং এই দুই না মিললে বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে না। হয় না হতে পারে না— তাঁরা পুরো সময়টাই পরীক্ষা দিয়ে গেছেন, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

একজন গাছ যেমন তার মর্মে আলোধর্ম অনুভব করে এবং ইট-পাথর-ধূলোরাশি সব বাধাকে প্রাণপণ শক্তি দিয়ে সরিয়ে ঠিক আকাশের দিকে মুখ তোলার সাধনায় আত্মপ্রয়োগ করে, তেমনি রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন, বহু আগে থেকে, তাঁর নিজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার (প্রতি মুহুর্তের রবীন্দ্রনাথের চেয়ে রবীন্দ্রনাথতর হয়ে ওঠার) অসীম সম্ভাবনা এবং সমস্ত মনপ্রাণ নিয়ে তিনি সেইদিকে চলেছেন। ধেয়েছেন জীবনধারা বেয়ে। না, পুষ্প যেমন আলোর লাগি না-জেনে রাত কাটায় জাগি, তেমন নয়। রীতিমতো জেনে, লক্ষ্য স্থির রেখে, ধ্যানবিন্দু সমুখে রেখে, রবীন্দ্রনাথ সূর্যোদয়ের আগে উঠে পুবদিকে তাকিয়ে বসে থাকতেন। নিজেকে গুছিয়ে নিতেন। পথ নির্ণয় করতেন। আত্মপ্রশ্রয় তাঁর অভিধানে ছিল না। নিজেকে নিয়ে ন্যাকামি তিনি করতেন না।

নিজের চোখ উছলে উঠল এবং নয়নজলে নিজের দায়গুলি ভাসিয়ে তিনি দুশমন অ-সমঝদার বিশ্বকে ভিলেন ঠাওরাতে বসলেন, সে আরাম, সে সহজতার আত্মফাঁকি তিনি নিজের জন্য নির্বাচন করেননি। উলটে, নিজের চেষ্টাকে তিনি করে তুলতে চেয়েছেন পবিত্র স্তবের মতো, বা উঁচুতে চলে যাওয়া গানের সুরের মতো, যা নিজের চ্যুতিকে এতটুকু প্রশ্রয় দেয় না বরং সংহার করে, নিজের উদ্যমকে তিনি করতে চেয়েছেন একটি টানটান জ্যা-র মতো একটি টনকো রথের ঘঘরে চাকার মতো, যা নিজ নিপুণতার সুস্থিত বিশ্বাসে বেজে ওঠে। নিজের সাধনাকে তিনি করতে চেয়েছেন চিত্রিত আংরাখার মতো, যা অঙ্গের তাবৎ জড়ুল মেচেতা কান্তি সৌষ্ঠব আবৃত করে জেগে থাকে রাজচক্রবর্তীর অভিজ্ঞানের দীপ্তিতে।

ডানহাতে দৈবকলম প্রদত্ত, জানার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বাঁ হাতে আয়ত্ত করেছিলেন এক নির্দয় চাবুক, যা শুধু নিজের প্রতি হানা যায়। শিল্পী সাধারণত শ্রমকে বাঁকা চোখে দেখেন। নিজের খামখেয়ালকে, পাশবালিশকে অনন্ত প্রশ্রয় দেন। মনে করেন, প্রতিভার চলন ঠিক শ্রমের বিপরীতে। অন্য লোকে শ্রম করেও যা পারে না, আমি বিনাশ্রমেই তা পারি, ফলে আমার ধর্মই তো অনায়াস চয়ন, আমি আবার গাধার খাটনি খাটতে যার কেন, এই হয় তাঁদের মনোভাব। আর রবীন্দ্রনাথ কী করলেন? খাটান দিলেন খাদান-শ্রমিকের চেয়েও বেশি। এমন কোনও সংস্কার ওঁর ছিল না যে ঘাম ঝরালে শিল্পীর মহিমা কমে যায়। বরং উনি নিখুঁত বুঝেছিলেন, প্রতিভার পুরোটা নিংড়ে নিতে গেলে, পূর্ণ বিকাশে পৌঁছতে গেলে, বহু কাণ্ড প্রয়োজন, যার একটি হল নীচের ঠোঁট দাঁতে চেপ্পে মারো জোয়ান হেইয়ো। নাগাড়, নাছোড় উদ্যোগ।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

এই কথাটা, এই গ্ল্যামারহীন ঘেমো সত্যটা, ভেবে পাওয়াই একটা জিনিয়াসের পরিচয়। তার ওপর, সামনে যখন আর কোনও এইরকম উদাহরণ নেই, এবং যাঁরা সঙ্গে চলছেন তাঁদের যখন অতি সহজে অল্প উদ্যমেই বহু ক্রোশ পিছনে ফেলে আসা গেছে, সন্দেহাতীত জিতে যাওয়া গেছে, তখনও অমন আকুল কামড়ে পড়ে থাকাটা আরও বড় জিনিয়াসের কাজ। একবার ভাবুন, একজন ঘাড়ে নিয়েছেন অতিমানব হওয়ার প্রোজেক্ট; বিশ্বের যতগুলো অনুভূতি থাকা সম্ভব, সবগুলো, সমস্তগুলো, আগাপাশতলা সমুদয়গুলো, যথাসম্ভব তীব্রতায় অনুভব করা ও তাদের বাংলা নামক একটি ভাষায় তাবৎ কারুকাজ সহ প্রকাশ করার প্রোজেক্ট; একটি গোটা ভাষাকে ও সংস্কৃতিকে একা হাতে গড়ে তোলার, সংজ্ঞায়িত করার প্রোজেক্ট। ভেবে সহস্রবার থমকাতে হয়।

এ জিনিস আবার শুধু খাটুনি দিয়ে হয় না, রোজ ভোর ভোের ঘুম থেকে উঠে পড়া দিয়েও হয় না। শুধু অলৌকিক প্রতিভা দিয়েও হয় না। অনেক, অনেকগুলো উপাদান একসঙ্গে মিশলে হয়। সেগুলো আপনাআপনি এক সুন্দর ও মঙ্গলময় সকালে মিশ খেয়ে যায় না। নিজের ক্ষমতার চরমে গিয়ে, প্রতিটি শিরা প্রতিটি তত্ত্ব প্রতিটি কোষ টাটিয়ে চিন্তা করে, পরিকল্পনা করে, ওজন করে, অনুপাত বুঝে, ঝুঁকি নিয়ে, সেগুলোকে মেশাতে হয়, তার পরিণাম ও অনভিপ্রেত অভিঘাত আন্দাজ করতে হয়, তা সহ্য করার জন্য আবার নিজেকে বহু দফা তৈরি করতে হয়। এই গোটা অতিমানুষিক আত্ম-ম্যানেজমেন্টটা রবীন্দ্রনাথ নিজে ভেবে পেয়েছিলেন ও সম্ভব করেছিলেন।

বাঙালির একটা ধারণা আছে, প্রতিভার সঙ্গে হিসেব জিনিসটা মেলে না। রুটিন বা শৃঙ্খলা কথাগুলো যেন প্রতিভাকে কিঞ্চিৎ অপমান করে, ওর দৈব মহিমায় ভেজাল মেশায়। রবীন্দ্রনাথ এই ভেবে বসে থাকার মতো ক্যালাস ছিলেন না। বরং বুঝেছিলেন, নিক্তি মেপে গোটা ভ্রমণপথটার, রুট-টার, তন্নতন্ন পরিকল্পনা করে না নিলে তাঁর এমন সোনার তরী কূলে ভিড়বে না।

বহু সময় ব্যেপে ধারাবাহিক ভাবে নিজের ক্ষমতার তুঙ্গে থেকে ফসল উৎপন্ন করে যাওয়া, এ কখনও স্বতঃই ঘটতে পারে না। সারাজীবন জুড়ে তাঁর মন্ত্র ছিল মূলত একটাহ ঃ নিজেকে প্রয়োগ করো, নিজেকে প্রয়োগ করো, নিজেকে প্রয়োগ করো। প্রয়োগ করা মানে শুধু লেখা নয়, চিন্তা করা, জাগ্রত থেকে পৃথিবীর সবটা শুষে নেওয়া, চারপাশে প্রবহমান সব কিছুতে অংশ নেওয়া, সর্বগ্রাসী হয়ে সাহিত্যের প্রতিটি শাখা শাসন করা। এবং এইসব কিছুর জন্য, এই অভাবনীয় নেবুলা-কাণ্ড মরজগতে ঘটাবার জন্য, এমন তুঙ্গস্পর্শী মনীষা নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য একটি হৃদয়ধাঁচ প্রয়োজন।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শাণিত বুদ্ধি, গভীর সমঝদারি ও হাড়ভাঙা রেওয়াজ, এর সম্মিলনে সে ভিত্তি হয়তো লাভ করা যায়। আবার ওই হৃদয়ধাঁচাটিকে শুধু আয়ত্ত করাই যথেষ্ট নয়, তার অনুকূল আবহাওয়া তৈরি রাখতে হয় অনুক্ষণ। আর তা করতে হয় দক্ষ, নিষ্ঠুর ও বেপরোয়া ভাবে।

প্রতিভা রক্ষার জন্য সব কিছুকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকব, কোনও কিছুর জন্যই প্রতিভায় এতটুকু আঁচড়ও সহ্য করতে প্রস্তুত থাকব না—এই মনোভঙ্গির আশ্রমে যাঁরাই ভরতি হয়েছেন, তাঁরা অবিলম্বে রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করেছেন এক আশ্চর্য প্যারাডক্স : প্রতিভা রক্ষার জন্য সবচেয়ে সিরিয়াস ভাবে যা অনুসরণ ও আত্মীকরণ করতে হবে, তা হল খেলাচ্ছল। বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামার আগে সব অধিনায়ক তাঁর দলকে কী উপদেশ দেন? যাও এবং খেলাটা উপভোগ করো। মানে কী? আজকে তো মরণ-বাঁচন লড়াই। সবচেয়ে টেনশনের দিন। তা হলে উপভোগ করব কী করে?

ওইখানেই সবচেয়ে দামি ও জরুরি জাগলিং। আশ্চর্য আত্মনিয়ন্ত্রণের ম্যাজিক। নিজেকে চেষ্টা করে রাখতে হবে ফুরফুরে, আনন্দময়, খেলার প্রতিটি কণায় আগ্রহী ও উৎফুল্ল, তবেই বেরিয়ে আসবে সেরা কৌশল ও নৈপুণ্য। পৃথিবীর ভার বা দেশোদ্ধারের বাটখারা ঘাড়ে চাপিয়ে নিলে স্ট্রোকগুলো আড়ষ্ট হয়ে যাবে, দৌড় হয়ে পড়বে অস্বচ্ছন্দ। ফলে, চেষ্টা করে নিজেকে রাখতে হবে টানা স্বতঃস্ফূর্ত। নিজের ওপর আরোপ করতে হবে এক দায়হীন স্বাধীনতা। এই প্যারাডক্সের প্রভু হতে পারলে, তবে সর্বোচ্চ সাফল্য করায়ত্ত হবে।

শিল্পে সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজন : নিজের মধ্যে সর্বক্ষণ এক প্রসন্নতা লালন করা। কারণ প্রতিভাকে যদি কেউ কুপিয়ে খুন করতে পারে সে হল বিষাদ। এবং এই তুমুল অভিযানে বুঝেশুনে যে বেরিয়েছে, সে বিষাদকে জিততে দিতে পারে না। প্রসন্নতা মানে আমরা যে আড্ডা-আসরে হাসিখুশি ভাব বুঝি তা ঠিক নয়। এর মানে হল স্রেফ বেঁচে থাকা থেকে উৎসারিত যে মাদকতা, আর আস্বাদনের জন্য নিজেকে সতত প্রস্তুত রাখা। তার রস আষ্টেপৃষ্টে পান করা। প্রাণ আমাতে প্রদত্ত হয়েছে, এই পুলকেই টায়েটায়ে পূর্ণ থাকা।

যা-ই আসুক না কেন, যা-ই ঘটে যাক, সেই উল্লাস, সেই জীবন-আনন্দ, সেই স্ফূর্তি, শুধু বেঁচে থাকার, শুধু রৌদ্র দেখার, শুধু নিশীথ রাতের বাদল ধারার অবিশ্রান্ত ধ্বনি শোনার, শুধু নিজের মধ্যে নিজে মগ্ন থাকার, গন্ধভরে তন্দ্রাহারা থাকার যে প্রফুল্লতা, তা নিজের মধ্যে ঠায় অব্যয় ধ্রুব রেখে যেতেই হবে। হবেই। এ হল যে কোনও শিল্পীর আত্মবিকাশ-প্রকল্পের ভিত্তি। কিন্তু আঘাতে আঘাতে নুয়ে যেতে যেতেও ঠিক খাড়া হয়ে এ জিনিস অক্ষুণ্ণ রাখা জগতে সবচেয়ে কঠিন কর্ম।Rabindranath Tagore 51 আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

সমগ্র জীবন ধরে রাজছত্রের মতো নিজের মাথার ওপরে এ গভীর অন্তরহরষের সামিয়ানা বিরাজমান রাখা অসম্ভব বললেই চলে। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু, জীবনের অস্ত্রগুলি এসে তোমাকে ছেদ করবেই। পোড়াবেই। টুটি ধরে স্রোতের তলায় ডুবিয়ে দেবেই। পৃথিবীর যে কোনও প্রকৃত গ্রেট তাই সম্ভাব্য এই আক্রমণের বিরুদ্ধে দুর্গ রচনা করে রাখেন। কিছু স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথও তা-ই করেছিলেন।

এই রক্ষণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হল, ‘আমার যখনই ইচ্ছে করবে তখনই সম্পূর্ণ একলা থাকতে পারব’ এমন বাতাবরণ সৃষ্টি করা। কেন এক শিল্পীর একা থাকা প্রয়োজন, তা সহজ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। যাতে কেউ তাঁর কাজে ব্যাঘাত না ঘটায়। এ-কথা শিল্পীমাত্রেই বোঝেন, একবার সুতো কেটে গেলে বিশ্বের সেরা কবিতাটি চিরকালের জন্য অনস্তিত্বের গর্ভে চলে যেতে পারে। ভাবনাটি অঙ্কুরিত হচ্ছিল, ঠিক তক্ষুনি বন্ধু এসে বলল ‘ক্র্যা, কেমন আছিস’ কিংবা বউদি এসে বলল, ‘পঞ্চাশ পোস্ত, জলদি’, আর চিরকালের মতো একটি মোক্ষম লাইন তার সাতাশ লাইনের মাস্টারপিসে স্ফীত হওয়ার সকল সম্ভাবনা নিয়ে ভেসে গেল আওতার বাইরে, এ খুব বিরল ঘটনা নয়।

একজন রবীন্দ্রনাথের মাপের সাধনাব্রতী, যিনি বাতিল লাইন কাটার হিজিবিজিকেও লাবণ্যরূপ দেন, তিনি সে ন্যূনতম সম্ভাবনাও অ্যালাউ করবেন না। কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ : জনমানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে শিল্পীর আধার ক্ষয়ে যায়। কারণ, অধিকাংশ মানুষ নির্বোধ ও অগভীর। ঠুনকো, ফঙ্গবেনে, মল ছাড়া ভেতরে কিছু না থাক এইসব প্রাণী আমাদের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। এইসব জনপিণ্ডের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে আমাদের চারপাশে চলতে ফিরতে হচ্ছে, টক্কর নিতে হচ্ছে, গল্পগুজব করতে হচ্ছে, ব্যাপার চুমোচুমি অবধিও গড়াচ্ছে। এতে, উঁচু তারে বাঁধা মন নিমেষে শিথিল হয়ে আসে।Rabindranath Tagore 59 আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

বড় টেবিল টেনিস প্লেয়াররা খারাপ টেবিল টেনিস প্লেয়ারদের সঙ্গে খ্যালেন না। বলেন, ওতে আমার ফর্ম পড়ে যাবে। আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন, মহৎ শিল্পী হতে গেলে পরিবার থেকে প্রায়ই পালাও। নিজেকে নিজের মতো করে গড়ে নেওয়ার জন্য, নিজের সাধনা বিষয়ে বারে বারে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, ফসলের উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য, শিল্পীকে বারে বারে একা থাকতে হয়। একমাত্র এই একলাসময়েই শিল্পী নিজেকে পান অখণ্ডিত, স্বৰ্গখেলনা ও পাতালক্বাথ, পুণ্যের জোনাকি ও পাপের আরক, এবং এ সব মিলিয়েই তৈরি হয় মৌলিক জল, যা আঁজলা করে ঢালা হয় শিল্পে শিল্পে। রবীন্দ্রনাথ তা জানতেন।

এবার বীণা তোমায় আমায় আমরা একা হতে গেলে, নিজের মুখোমুখি সন্ধেবেলা বসে নিজের কড়াক্রান্তি হিসেব নিতে গেলে, নিজের গন্ধে আকুল হয়ে পায়চারি করতে গেলে, একটি আকাট প্রাণীকেও কাছ ঘেঁষতে দেওয়া যায় না। যেমন ধ্যানের সময়, পূজার সময় সাধক কাউকে সাধনাগৃহে ঢোকার অধিকার দেন না। রবীন্দ্রনাথকে এ কাজে সাহায্য করেছিল তাঁর টাকা, তার পরিবারের ঐতিহ্য, যেখানে পুরুষমানুষ যদ্দিন ইচ্ছে বেরিয়ে পড়তে পারেন, জবাবদিহির প্রশ্ন নেই, এবং তাঁর খাজনা আদায়ের কাজ।

অবশ্য ও-কাজ না থাকলে তিনি এমনিই বেরিয়ে পড়তেন, হলফ করে বলা যায়। ওঁর একটা বড় প্রিয় অভ্যাস ছিল, সন্ধের দিকটায় আস্তে আস্তে বেড়াতেন। আমরা অনুমান করতে পারি, নিবিষ্ট মনে নীচের দিকে চেয়ে, কখনও চকিতে মুখ তুলে আকাশের আঁধার ও নক্ষত্র দেখে নিয়ে, ফের হাত দুটি পিছনে রেখে, একলা, নিজের সঙ্গে। ওই চারপাশ থেকে ঘনিয়ে আসা আঁধার তাঁকে আরও নিবিষ্ট হয়ে নিজের মধ্যে প্রবেশ করতে সাহায্য করত। প্রাণ সৃষ্টি করতে গেলে একজনকে আরেকজনের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়।

মহাপ্রাণসম্পন্ন শিল্প সৃষ্টি করতে গেলে নিজেকে নিজের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। এই ক্রিয়া কারও সামনে ঘটতে পারে না, এতই নিভৃত, সঙ্গোপন। চলতি স্রোত থেকে বহু দূরে এই পায়চারিটি করে, খ্যাতি-বিদ্রুপ গেরস্থপনা-কলতলার কলহ থেকে বহু দূরে এসে, শুধু নিজের কাজকে নিজের উদ্দেশ্যকে নিজের প্রেরণাকে ছুয়েছেনে দেখেশুনে, নিজেকে ধুয়ে নিতেন। অসীম দিয়ে ধুয়ে নিতেন। শিল্পীর এটাই স্নান। এই একাকিত্বের অবগাহন। শিল্পীর এটাই নিরাময়। মানুষের নীচতা মানুষের ক্ষুদ্রতা মানুষের লঘুতা তাঁর বুকে যে ফুটোগুলো করে দেয়, সেগুলোকে ফের বুজিয়ে নেওয়ার জন্যেই এই নির্জনতা।

এখানে না আছে তাঁর স্মার্ট হওয়ার দায়, না আছে বৈঠকখানা-সই হয়ে ওঠার তাড়না, না আছে অন্যকে সহন করার ভণিতার প্রয়োজন, না আছে নগ্ন নিজেকে এতটুকু লুকিয়ে ফেলার গরজ। একলা শিল্পী করেন কী, আত্মময় রাজ্যে, নিজের প্রিয় অংশগুলোকে, সম্পদগুলোকে একটা ভাঙা লাইনকে, একটা কখনও-না-বলতে পারা আকাঙ্ক্ষাকে, তিনটে আলগোেছ চিন্তাকে, একটা হবু গানকে, চারটে ধারণাভ্রুণকে, দুটো অন্য শিল্পের আহরণযোগ্য কণাকে, আসবাবের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে রাখেন। আর, বড় আদরের সঙ্গে সেগুলোকে স্পর্শ করে করে, ঘুরে ঘুরে বেড়ান।Rabindranath Tagore 56 আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

নিজেকে আবিষ্কার ও আলিঙ্গন করার এই রিচুয়াল, এই নিজেকে চুমু খেয়ে খেয়ে পুনতৈরি করে নেওয়ার রুটিন, তাঁকে দেয় এই সহজাত প্রসন্নতা রক্ষা করার কবচ। এই আত্মস্নান এত নিবিড়, এত আপন, এত পবিত্র, এ সময়ে কেউ পাশে পাশে চলতে লাগলে অসহ্য বোধ হয়, কেউ গায়ে নিশ্বাস ফেললে মনে হয় দিই দু’ঘা কষিয়ে। ‘এমনি আমি স্বভাবতঃ অসভ্য মানুষের ঘনিষ্ঠতা আমার পক্ষে নিতান্ত দুঃসহ।

অনেকখানি ফাঁকা চতুর্দিকে না পেলে আমি আমার মনটিকে সম্পূর্ণ unpack করে বেশ হাত-পা ছড়িয়ে গুছিয়ে নিতে পারি নে। আশীর্বাদ করি মনুষ্যজাতির কল্যাণ হোক, কিন্তু আমাকে তাঁরা ঠেসে না ধরুন।’ এবং অবশ্যই: ‘জগৎসংসারে অনেকগুলো প্যারাডক্স আছে, তার মধ্যে এও একটি যে, যেখানে বৃহৎ দৃশ্য, অসীম আকাশ, নিবিড় মেঘ, গভীর ভাব, অর্থাৎ যেখানে অনন্তের আবির্ভাব সেখানে তার উপযুক্ত সঙ্গী একজন মানুষ—অনেকগুলো মানুষ ভারী ক্ষুদ্র এবং খিজিবিজি। অসীমতা এবং একটি মানুষ উভয়ে পরস্পরের সমকক্ষ—আপন আপন সিংহাসনে পরস্পর মুখোমুখি বসে থাকার যোগ্য।

আর, কতকগুলো মানুষে একত্রে থাকলে তারা পরস্পরকে ছেঁটেছুটে অত্যন্ত খাটো করে রেখে দেয়। একজন মানুষ যদি আপনার সমস্ত অন্তরাত্মাকে বিস্তৃত করতে চায় তা হলে এত বেশি জায়গার আবশ্যক করে যে কাছাকাছি পাঁচ-ছ’জনের স্থান থাকে না।’ অর্থাৎ ওই মাইল মাইল চষা মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে, নদীর শুকনো চরের ওপর দাঁড়িয়ে, জনমানবশূন্য খাঁ খাঁ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে চাদের দিকে তাকিয়ে, মনে হয়, আমি একা শুধু জন্মেছি, আর কেউ কোথাও নেই, কিচ্ছুটি নেই, কোনও সভ্যতা তৈরি হয়নি, কোনও সমাজ কোনও ব্যাকরণ কোনও প্রথা দায় আমার হাত-পা’য় বেড়ি দিতে পারেনি, শুধু এই মুহূর্তে আমার ভাবনাগুলি রয়েছে, আর আমার ভাষা। আমার ভাব আর আমার কলম। ব্যস।

এইখানে নিজেকে নিয়ে না-ফেললে শিল্পীর মন থেকে প্রায়ই ফসকে যায় যে তিনি একজন রাজরাজেশ্বর, স্বরাট, অঘটনঘটনপটীয়ান, পূর্ণ নির্দায়, স্বৈরাচারী। এই বোধ, স্পর্ধা ও প্রত্যয় না থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিল্পীদের একজন হওয়া অসম্ভব। এই প্রস্তুতি তপস্যার অপরিহার্যতা জেনে, যাপনের একটি প্রধান স্ট্র্যাটেজি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একলা হয়ে যাওয়ার ক্রমাগত ব্যবস্থা অত্যন্ত সচেতন ভাবে করেছিলেন।Rabindranath Tagore 50 আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শিল্পীর আরেক আবশ্যক কর্তব্য : অব্যর্থ চিনে নেওয়া, নির্ধারণ করা, কী তাঁকে সবচয়ে উদ্দীপিত করছে। কী তাঁকে সর্বোচ্চ ‘কিক’ দেয়। ওই নেশাদ্রব্যটিকে প্রায়ই ব্যবহার না করলে তিনিই নিজেকে বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না বেশিদিন, নিজের প্রাণশক্তির প্রাবল্য বজায় রাখতে পারবেন না এত লম্বা রেসে। বহু শিল্পীকে সবচয়ে উসকে রাখে : যৌনতা। কাউকে যৌন ক্রিয়া, কাউকে শিরায় শিরায় যৌন উত্তেজনার অনুভবটুকু। পিকাসো একটি নির্দিষ্ট সিরিজের প্রতিটি ছবি আঁকার আগে (সম্মত) প্রেমিকাকে অতি নিষ্ঠুর ভাবে ভোগ করতেন।

কাউকে প্রাণিত করে ড্রাগ, মদ। তাই বহু শিল্পী শরীরে ঢুকিয়ে নেন অল্প বিষ, ঘোর, তারপর আকাশচারী হওয়ার সুবিধে ঘটে। কেউ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন নিজের সাফল্যচিহ্ন। ভিড রিচার্ডস মোটিভেশন হারিয়ে ফেলার পর তাঁকে দেখানো হত নিজের অসামান্য ইনিংসগুলির ভিডিও ক্লিপিংস। রবীন্দ্রনাথের এই চির-উদ্দীপক ছিল : প্রকৃতি। এই নেশাবস্তুটি তাঁর স্বভাবের বিরাটতার সঙ্গে মানানসই বটে, আর তাঁর ভাগ্যের পক্ষেও প্রবল অনুকূল। বঙ্গদেশে আর যাই হোক প্রকৃতির অবাধ সম্ভারের অপ্রতুলতা তখন ঘটেনি।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথের ডানা যেই না ক্লান্ত হয়ে আসত, উনি দৌড়ে চলে যেতেন তাঁর চিরসখী, চিরধাত্রীর কাছে।। ব্যস, অমনি তাঁর বিস্ময়ের ও পুলকের আর অবধি থাকত না। মাথাটা জানলার উপর রেখে দিই—বাতাস প্রকৃতির স্নেহহস্তের মতো আস্তে আস্তে আমার চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে দেয়, জল ছল ছল শব্দ করে বয়ে যায়, জ্যোৎস্না ঝিক ঝিক করতে থাকে এবং অনেক সময় ‘জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়’।’ এই সত্তার দেখে দেখে, কোনও প্রয়াস ছাড়াই, তিনি নিমেষে মোহিত, আবিষ্ট হয়ে যেতেন, উপচে উঠতেন। এই অনিঃশেষ উৎস ফের তাঁর জীবনপাত্র পূর্ণ করে দিত।

ভালোবাসতে পারার ক্ষমতা সবার থাকে না, জ্যোৎস্না দেখে হৃদয়ের দু ভেসে যাওয়ার ক্ষমতাও নিয়ে জন্মাতে হয়। প্রকৃতির শোভা আমাদের অল্পবিস্তর সবারই ভালো লাগে, টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখতে আমরা আগেভাগে কর করে রেডি থাকি। এটা কিন্তু সেই সাধারণ স্তরের ভালো লাগা নয়। এটা হচ্ছে। একটা সর্বোচ্চ নেশা, একটা মাতলামি। একটা অকারণ উতরোল আনন্দঢেউ, একটা উন্মাদ সুখ ভেতরে অনুভব করা, বারবার, প্রতিবার। প্রেমের এত অ-পুরোনো থাকার ক্ষমতা নেই, হয়তো ছোবলের নেশাও তীব্রতা হারায়, কিন্তু একই নদী, একই পাতাঝরা, একই সন্ধ্যামেঘ, একই ঝাঁ ঝাঁ দুপুর দেখে এই কবি প্রতিদিন সমান তরঙ্গিত হয়ে উঠতেন।

আজকাল আমি বিকেল সন্ধের দিকে ডাঙায় উঠে অনেকক্ষণ বেড়াতে থাকি-পূর্ব দিকে যখন ফিরি একরকম দৃশ্য দেখতে পাই, পশ্চিমে যখন ফিরি আর একরকম দেখতে পাই—আকাশ থেকে আমার মাথার উপরে যেন সান্ত্বনা বৃষ্টি হতে থাকে, আমার দুই মুগ্ধ চোখের ভিতর দিয়ে যেন একটি স্বর্ণময় মঙ্গলের ধারা আমার অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। এই বাতাসে আকাশে এবং আলোকে প্রতিক্ষণে আমার মন ছেয়ে যেন নতুন পাতা গজিয়ে উঠছে—আমি নতুন প্রাণ এবং বলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছি।’ এবং: ‘সৌন্দর্য আমার পক্ষে সত্যিকার নেশা! আমাকে সত্যি সত্যি ক্ষেপিয়ে তোলে।

ছেলেবেলায় বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে যখন ছাদে পড়ে থাকতুম তখন জ্যোৎস্না যেন মদের শুভ্র ফেনার মতো একেবারে উপচে পড়ে নেহায় আমাকে ডুবিয়ে দিত।’ আর এই কবির সুরটা যেহেতু বাঁধা ছিল জীবনের চিরন্তন অনুভূতিগুলির সঙ্গে, তাঁর ভাবনার মূল উৎসমুখগুলো সকল সেলাই অস্বীকার করে পটপট করে খুলে যেত, যেই না প্রকৃতি—যে সনাতন, আদিম, চিরবিরাজমান ও অবিনাশ – তার অফুরান ইন্দ্রজাল কবির সামনে মেলে দিত।

এই ব্যাপার তাঁকে পাঠও দিত, কারণ চারিদিকে এমন সব জিনিস দেখা যায় যা আজ তৈরি করে কাল মেরামত করে পরশু দিন বিক্রি করে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্মমৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে—প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াত করছে এবং চিরকাল অবিশ্রান্ত ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে।’ উনি ওঁর রচনাকে করতে চাইতেন সমর্ধমা। যা স্থানের গণ্ডিতে বাঁধা পড়বে না, কালের গণ্ডিতে বাঁধা পড়বে না, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের মতো চিরায়মান ও কল্যাণতম হয়ে মহাবিশ্বে মহাকালে খচিত থাকবে। কিন্তু সে-কথা থাক।আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

আজ বলছি, আকাশের আর নদীর দিগন্তের কোল ঘেঁষটে যেই না এই শিল্পী দাঁড়াতেন, অমনি বুঝতেন, এ-জীবনে অন্তত অক্সিজেনের খোঁজে তাঁপে হাঁপ টানতে হবে না। হৃদয়ধাঁচ যখনই এতটুকু অবসন্ন হবে, ওই প্রসন্নতা যেই নুয়ে পড়বে কিছুটা, তাকে শুধু চলে আসতে হবে মাইল মাইল অপেক্ষারত প্রকৃতির কাছে। এবার, এ তো এক প্রবল সৌভাগ্যের আসা-কে মিলিয়ে দিতে পারবেন একই বিন্দুতে। ফলে তাঁর কম্বো-আত্মনির্মাণ প্রক্রিয়া দাঁড়াবে : প্রকৃতির কোলে একলা থাকা।

তৃতীয় রক্ষণ-কৌশল, যা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ ও আয়ত্ত করেছিলেন, তা ভাবতে বসলে ভোঁ হয়ে যেতে হয়। কিছু ব্যক্তিগত আঘাত তো থাকবেই, যা প্রসন্নতায় নিশ্চিত টোল ফেলে দেবে। দুমড়ে, তছনছ করে দেবে বর্ম। অন্তত দিনকয়েকের জন্যে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে মানুষটা। আমাকে ব্যঙ্গ করে একখানা গোটা নাটক তৈরি হলে বা আমার তরতাজা ছেলে ধড়ফড় করতে করতে মারা গেলে তো আর আমি শান্তভাবে টেবিলের সামনে বসে ছন্দ মেলাতে পারব না। না কি, এমন একটি আশ্চর্য নির্লিপ্তির সাঁজোয়া রচনা করা সম্ভব, যা আমাকে এই সংকটেও অক্ষত রাখবে এবং উপন্যাসের কিস্তি ঠিক সময়ে পৌঁছবে পত্রিকা দপ্তরে?

কয়েকটা ঘটনা বলি। স্ত্রী মারা গেছেন ক’মাস আগেই। এবার অসুস্থ হলেন মেজোমেয়ে রানি। হাওয়া বদলের জন্য মেয়েকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আলমোড়ায় গেলেন। কিন্তু রানির অসুখ বেড়ে চলেছে, কলকাতায় ফিরিয়ে আনা ঠিক হল। কয়েকজন কুলি খাটসুদ্ধু রানিকে পাহাড়ের ওপর থেকে নামিয়ে আনবে, পাশে পাশে রবীন্দ্রনাথ পায়ে হেঁটে আসবেন ওই বত্রিশ মাইল রাস্তা। সন্ধেয় স্টেশনে পৌঁছে জানা গেল, ট্রেন চলে গেছে। আবার কাল আসবে।

রাত কাটানোর জন্য ডাকবাংলোয় গেলে, সেখানে যে ইংরেজরা আছে, তারা নেটিভদের ঢুকতে দিল না। কোনওমতে একটা ধর্মশালা খুঁজে বার করে, মেয়ের শিয়রে সারারাত জেগে থাকলেন রবীন্দ্রনাথ। পরের দিন ট্রেনে যেতে যেতে লখনৌ স্টেশনে মেয়ের জন্য একটু দুধ জোগাড় করতে নেমেছেন, ফিরে এসে দেখেন, টাকার বটুয়া, যেটা সিটের ওপর রেখেছিলেন, নেই। কেউ চুরি করে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মাথায় আগুন ধরে গেল। এ যেন, ঈশ্বর ইচ্ছে করে শয়তানি করে একের পর এক দুর্দশায় ফেলছেন।

কবি হোন আর দার্শনিক হোন, যাঁর মেয়ে মারা যাচ্ছে, অমানুষিক পরিশ্রম হয়েছে, সাহেবরা অপমান করেছে, এই সম্বলটুকু চুরি হয়ে যাওয়া তাঁকে হাকুশ তেতো করে দিতে তো বাধ্য। ডাক ছেড়ে কেঁদে, অভিসম্পাত দিয়ে, ভাগ্যকে ফালাফালা করে, আক্রোশে গলা চিরে তো চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কী করলেন? নিজেকে জপের মতো বলতে লাগলেন, ‘তার চেয়ে মনে করলেই তো পারি টাকাটা যে নিয়েছে সে চুরি করে নেয়নি, আমি নিজে ইচ্ছেপূর্বক তাকে ওটা দান করলুম। হয়তো আমার চেয়েও ওটা তার বেশি প্রয়োজন। তাই আমি দানই করেছি। ভালো করে এ-কথা মনকে বারে বারে বলালে, আস্তে আস্তে ভেতরটা শান্ত হয়ে এল।Rabindranath Tagore 38 আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

কল্পনা করা যায়, একজন রক্তমাংসের মানুষ এই সিদ্ধান্তটা নিচ্ছেন এই পরিস্থিতিতে? এটা তো ওঁর কোনও তত্ত্বভরা উপন্যাস নয়। এটা তো ঈশপের গল্প নয়। এটা তো একটা তপ্ত ট্রেন, যেখানে বিশ্বাসঘাতকতার ভাগ উঠছে, সপ্তানবিয়োগের সম্ভাবনার দগ্ধানি, খারাপ মানুষে ভরতি পৃথিবীতে বেঁচে থাকার গ্লানি, ক্রোধে ও দুঃখে চোখ ঝাপসা করে দিচ্ছে। সেখানে বসে শ্বাসের তলায় তীব্র গালি না উচ্চারণ করে, এই বিশ্ব বেঁচে থাকার অযোগ্য এই ধিক্কারবাক্য না শানিয়ে, একজন মানুষ একটি অকলুষ ক্ষমা অনুশীলন করছেন, যাতে এই ঘটনা তাঁর মনের স্বাভাবিক স্থৈর্যকে ব্যাহত না করে।

এটি একটি মানুষিক জীবনপ্রণালী মনে হয়? কিছুদিন পরেই রানি মারা গেলেন। সেইদিন সন্ধেয় রবীন্দ্রনাথের বৈঠকখানায় বঙ্গভঙ্গের আশঙ্কা নিয়ে কথা বলতে বড় বড় নেতারা এসেছেন। রাত সাড়ে দশটা অবধি সভা চলল। অতিথিদের এগিয়ে দিতে দরজা অবধি এসেছেন কবি, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে জিগ্যেস করলেন, ‘রবিবাবু, আজ আপনার মেয়ে কেমন আছে? একটু ভালো তো? রবীন্দ্রনাথ শান্ত গলায় বললেন, ‘সে আজ দুপুরবেলা মারা গেছে। এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শমীন্দ্রনাথ মুঙ্গেরে কলেরায় মারা গেলেন, তাঁকে দাহ করার পর রবীন্দ্রনাথ ও দুই সঙ্গী-অধ্যাপক ট্রেনে বোলপুর ফিরছেন।

সাহেবগঞ্জে দেখা করতে এলেন এক অধ্যাপকের মামা। রবীন্দ্রনাথ হাসিমুখে তাঁর কুশলসংবাদ নিলেন, গল্প করলেন, তাঁর প্রচুর প্রশ্নের উত্তর ধৈর্য ধরে দিতে লাগলেন। শেষে ভদ্রলোককে কিছু দূরে ডেকে নিয়ে ভাগ্নে বললেন, ‘কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের ছোট ছেলেকে সৎকার করে ফিরছেন উনি!’ এ জিনিস সম্ভব কোন রসায়নে। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ যদি বঙ্গভঙ্গের সভা সেদিন ক্যানসেল করতেন বা ওই মামাটিকে বলতেন ‘আজ আর বলতে পারব না’, তাতে তাঁর ইমেজ এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হত না, বরং উলটোটা।Rabindranath Tagore 40 আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

সেটাকেই লোকে স্বাভাবিক এবং কাম্য বলে ধরে নিত। যে লোকের দরদ ও অনুভূতি, স্পর্শকাতরতা ও সংবেদন পৃথিবীর সকলের চেয়ে থরোথরো, সে সম্ভানশোকে বিহ্বল হয়ে পড়লে সেটাই তো বেশি মানানসই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজেকে এটুকু ছাড় দেওয়ারও অবকাশ ছিল না। ওঁর যে প্রকল্পনা, তাতে শোক পালনের জন্যও ছুটি নেওয়ার নিয়ম নেই। নিজের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট আন্দাজ, নিজের মিশন সম্পর্কে স্ফটিকস্বচ্ছ ধারণা, এবং সেই অনুযায়ী নিজের প্রতিজ্ঞাগুলি গণিত-নির্ভুলতায় নির্ধারণ ও পালন, এ তাঁর প্রতি মুহূর্তের কাজ ছিল।

বাইরের কোনও ঘটনাকেই তিনি ভেতরের তিলে তিলে নির্মিত মহাবিশ্বটিকে বিঘ্নিত করতে দেবেন না। তাঁর মূল কোরকের মাধুর্য অবধি পৌঁছতে দেবেন না। দিলে, একবার সেই সিংহদরজা শিথিল করলে, একটি স্খলনকেও আশ্রয় দিলে, তাঁর যে অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা, তা পূর্ণ বিকাশের বিন্দুতে পৌঁছতে পারবে না। তিনি এক একটি বিরাট-কে গিলে নিতে, নিজের অণু অণুতে চারিয়ে নিতে, এক বিরাটের প্রতি অঙ্গে অঙ্গে লেপে ওতপ্রোত সংলগ্ন হতে বেরিয়েছেন। তিনি অমৃতের সন্ধানে বেরিয়েছেন। বুকের পাজর জ্বালিয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন। যে কোনও মূল্যেই তা তাঁকে পেতে হবে। এ জন্য সব ত্যাগ করতে তৈরি থাকতে হবে। সব। এমনকী মানুষিক আবেগ।

আবার খেয়াল করুন, তা করতে গিয়ে তাঁর তপতপে কোমলতা এতটুকু খোয়ালে চলবে না। কারণ ওই তো তাঁর পুঁজি। প্রকৃতির প্রেরণা পান করার সময়, নিজেকে আমূল নগ্ন করে দিতে হবে, রচিত প্রতিটি অক্ষরে অঝোর প্রস্রবণ বিলিয়ে দেওয়ার সময় মুখভঙ্গি আকুল আতুর হয়ে উঠলে তা সংবরণ করা চলবে না। কী অসম্ভব ও প্রায় ধারণা-অতীত এই যজ্ঞ! আবেগগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি কোনও নির্দয় দাসব্যবসায় নামছেন না। তিনি করছেন আবেগেরই বেসাতি। শুধু, ঘটনা-নির্ভর আবেগগুলি তাঁর লেখার স্রোত থেকে তাঁকে দূরে রাখলে, তাদের মুহূর্তে কেটে বাদ দিতে হবে। বা, নিমেষে তাদের চালান করে দিতে হবে ব্যক্তিগত বোধ থেকে শিল্প-কাঁচামালের, শিল্প-জ্বালানির ডাইঘরে। এ প্রোজেক্ট কার্যকর করতে তো পৌরাণিক ধক দরকার, দশখানা জীবন রিহার্সাল!

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

এ তো সেমিনারের আইডিয়া-আস্ফালন নয়, একে তো প্রোথিত করতে হবে নিজের আত্মায়, ব্যবহারে অভ্যাসে, একে তো লেপে দিতে হবে এই শ্বাস রক্ত-থুতু-পুঁজ-প্রস্রাবময় বাস্তবের জমিনে! রবীন্দ্রনাথ বহু অনুশীলনে, চোয়ালে চোয়াল চেপে, অমানুষিক ক্ষমতায়, নিজের শিল্পীসত্তাকে ব্যক্তিসত্তা থেকে টেনে ছিঁড়ে বিযুক্ত করেছেন। বাইরের তাবৎ আফসানো ঝাপটার আড়ালে নিজের এক অচঞ্চল নিভৃত ধ্যানকুঠুরি নির্মাণ করে নিয়েছেন। এই চূড়ান্ত ঔদাসীন্যের বর্ম তাঁকে ভালো করে কোনও মানুষের সঙ্গে লিপ্ত হতে দেয়নি, আলিঙ্গন করতে গেলেই কবচের ইস্পাত অস্বস্তিকর ফুটেছে।

অনায়াসে স্বল্প আলগা করা যেত এই নিজের প্রতি অতলান্ত নিষ্ঠুরতার রাশ। নিজের অতন্দ্র প্রহরায় নিজে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার নিংড়নো ডিউটি থেকে স্বল্প বিশ্রাম নেওয়া যেত। কিন্তু প্রতিভাকে যত্ন করা জেদ তাঁর অনশ্বর। অকল্পনীয় অপমান চতুর্দিক থেকে সহ্য করেছেন, মেয়ের যক্ষ্মা হয়েছে বলে দেখা করতে গেছেন, জামাই টেবিলের ওপর পা তুলে সিগারেট খেয়েছে। শান্তিনিকেতন তিনি খুলেছেন পারভার্ট কাণ্ডকারখানা করার জন্য, শুনতে হয়েছে। কোনও আঘাতে, কোনও মুহূর্তে, এককণা কাজও থেমে থাকেনি।

হৃদয় থেকে কোমল মরমী লতাগুলি একে একে উপড়ে ফেলতে কী প্রাণান্ত কষ্ট হয়েছে তাঁর। এক উন্মাদ আত্মকেন্দ্রিকতায়, আত্মনিষ্ঠায়, নিজেরই বুকে হাঁটু চেপে শ্বাস রুখে দিতে কী হাঁকপাঁক, কী তাড়স জেগেছে। তবু থামেননি, কিছুতেই ভ্রষ্ট হবেন না। কিছুতেই ক্লান্তিকে, দুর্বলতাকে জিততে দেবেন না। অন্য কোনও মানুষ কখনও যা পারেনি, তিনি তা-ই পারবেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ হবেন। মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছেন, যাকে তোমরা ভালোবাসা বল সেরকম করে আমি কাউকে কোনওদিন ভালোবাসিনি।…বন্ধুবান্ধব, সংসার, স্ত্রী-পুত্র কোনও কিছুই কোনওদিনই আমি তেমন আঁকড়ে ধরিনি।

ভিতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম—তাই আজ যে জায়গায় এসেছি সেখানে আসা আমার সম্ভব হয়েছে। তা যদি না হত, যদি জড়িয়ে পড়তুম তা হলে আমার সব নষ্ট হয়ে যেত।’ প্রসন্নতা রক্ষার জন্য এই নির্দয় ঔদাসীন্য বপন ও লালনের স্ট্র্যাটেজি, এ ব্যাপার বুঝতেই এক জীবন লাগে কারও কারও, প্রায় কৈশোর থেকে এর সার্থক সাধনা আয়ত্ত করার কথা তো ছেড়ে দিলাম। নিজের শিল্পকে, নিজের প্রতিভাকে কতটা আছাড়িপিছাড়ি ভালোবাসলে এভাবে নিজের আদর সম্ভব, ভাবলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

কিছুটা রবীন্দ্রনাথ হয়ে জন্মানো যায়, কিন্তু পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ তিলে তিলে পলে পলে হয়ে উঠতে হয়, তার কঠিন পরিকল্পনা ও অসহ্য শ্রম প্রতিটি, প্রতিটি, প্রতিটি ক্ষণ-খণ্ডে জারি থাকে, এই ধারণার বোধ ও স্বীকৃতি এবং তুলকালাম আত্মপ্রয়োগ, শুধু এই জন্যই আরও দেড়শো বছর তাঁর সূর্যবিভার পানে হাঁ করে থাকতে হবে মনে হয়।

লেখক : বিশিষ্ট গীতিকার ও সাংবাদিক

আরও দেখুন:

 

মন্তব্য করুন