রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাব্যগ্রন্থ সূচি

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাব্যগ্রন্থ গুলি বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জীবনে ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-১৮৯৪) অনুসারী কবি। তার কবি-কাহিনী, বনফুল ও ভগ্নহৃদয় কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট।

সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পর্বের সন্ধ্যা সঙ্গীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান ও কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী এবং তার পর প্রকাশিত সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), চৈতালি (১৮৯৬), কল্পনা (১৯০০) ও ক্ষণিকা (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা।

Rabindranath Tagore [ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
Rabindranath Tagore [ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ]
১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে নৈবেদ্য (১৯০১), খেয়া (১৯০৬), গীতাঞ্জলি (১৯১০), গীতিমাল্য (১৯১৪) ও গীতালি (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলে বলাকা (১৯১৬) কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিবর্তে আবার মর্ত্যজীবন সম্পর্কে আগ্রহ ফুটে ওঠে। পলাতকা (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন।

পূরবী (১৯২৫) ও মহুয়া (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রেমকে উপজীব্য করেন। এরপর পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), পত্রপুট (১৯৩৬) ও শ্যামলী (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়কার রোগশয্যায় (১৯৪০), আরোগ্য (১৯৪১), জন্মদিনে (১৯৪১) ও শেষ লেখা (১৯৪১, মরণোত্তর প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি। শেষ কবিতা “তোমার সৃষ্টির পথ” মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

 

Rabindranath Tagore 22 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাব্যগ্রন্থ সূচি

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাব্যগ্রন্থ:

পর্যায় অনুসারে তাঁর রচিত কাব্য গ্রন্থের তালিকা নিম্নে উল্লেখ করা হল –

সূচনা পর্যায় (১৮৭৮ – ১৮৮১) :

১। কবি কাহিনী (১৮৭৮)

কবিকাহিনী কাব্যগ্রন্থটি তাঁর ষোল বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। “বনফুল” কাব্যগ্রন্থটি পূর্ববর্তী হলেও, “কবি-কাহিনী”-ই তাঁর প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। এর কবিতাগুলি “ভারতী” সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে ৫৩-টি পৃষ্ঠা রয়েছে। এতে বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রবোধচন্দ্র ঘোষ হলেন গ্রন্থটির প্রকাশক।

বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী অচলিত সংগ্রহ প্রথম খণ্ডের (মাঘ ১৩৯২) গ্রন্থ পরিচয় অংশে লিখিত এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ :

রচনার দিক দিয়া ‘বন-ফুল’ পূর্ববর্তী হইলেও ‘কবি-কাহিনী’ই পুস্তকাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম রচনা এবং ইহা একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। সংবৎ ১৯৩৫ [৫ নভেম্বর ১৮৭৮] ইহা প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৩। ইহা পুনর্‌মুদ্রিত হয় নাই।

কবি-কাহিনী প্রথম বৎসরের ‘ভারতী’র (১২৮৪ সাল) পৌষ হইতে চৈত্র সংখ্যায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। কবির বয়স তখন ষোলো বৎসর। এই পুস্তক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখিয়াছেন–

এই কবি-কাহিনী কাব্যই আমার রচনাবলীর মধ্যে প্রথম গ্রন্থ-আকারে বাহির হয়। আমি যখন মেজদার নিকট আমেদাবাদে ছিলাম তখন আমার কোনো উৎসাহী বন্ধু এই বইখানি ছাপাইয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আমাকে বিস্মিত করিয়া দেন। –প্রথম সংস্করণ, পৃ, ১০৮

এই উক্তির মধ্যে সামান্য একটু ভুল আছে; রবীন্দ্রনাথ আমেদাবাদে থাকিতে এই পুস্তক প্রকাশিত হয় নাই। ১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি বিলাত যাত্রা করেন। ‘কবি-কাহিনী’ ৫ নবেম্বর প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত পুস্তক তিনি দেখিয়া যাইতে পারেন নাই। রবীন্দ্রনাথ-উল্লিখিত “উৎসাহী বন্ধু”ই ‘কবি-কাহিনী’র প্রকাশক প্রবোধচন্দ্র ঘোষ।

Rabindranath Tagore 44 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাব্যগ্রন্থ সূচি

২। বনফুল (১৮৮০)

বনফুল (বন-ফুুল) হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হয়। এটি আটটি সর্গে বিভক্ত। এতে বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “সূচনা পর্ব”-এর অন্তর্গত প্রথম সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। রচনার দিক থেকে এটি কবি-কাহিনীর পূর্ববর্তী। কিন্তু ১৮৭৮ সালে বনফুলের পূর্বে কবি-কাহিনী প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।

আঃ কাজ কী গোলমালে (গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য | বাল্মীকিপ্রতিভা ) [A: Kaj Ki Golmale (lyric drama-dance drama ) 1886
বাল্মীকিপ্রতিভা – ইন্দিরা
দেবী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৩। ভগ্নহৃদয় (১৮৮১)

ভগ্নহৃদয় ১৮৮১ সালে প্রকাশিত হয়। এটি ৩৪-টি সর্গে বিভক্ত। লন্ডনে ভ্রমণ কালে তিনি এটি রচনা করতে শুরু করেন।

 

উন্মেষ পর্যায় (১৮৮২ – ১৮৮৬) :

১। সন্ধ্যা সঙ্গীত (১৮৮২)

সন্ধ্যা সঙ্গীত তাঁর কাব্য রচনার “উন্মেষ পর্ব”-এর অন্তর্গত। কাব্যের প্রকাশকাল বাংলা ১২৮৮ সন (ইংরেজি ১৮৮২ সাল)। তবে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “গ্রন্থে ১২৮৮ মুদ্রিত হলেও, কার্যতঃ ১২৮৯ সালে প্রকাশিত।” প্রথমে এই কাব্যে পঁচিশটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে তিনটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। সমালোচক শিশিরকুমার দাশ এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সম্পর্কে লিখেছেন, “এদের মূল সুর বিষাদের, রোম্যান্টিক বেদনা ও শূন্যতাবোধের। এই কবিতাগুলির মধ্যে বাংলা কবিতার এক নূতনধারার সূচনা হয়েছিল।”

২। প্রভাত সঙ্গীত (১৮৮৩)

প্রভাত সংগীত ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল সন্ধ্যা সঙ্গীত (১৮৮২)। কাব্যগ্রন্থটিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবি জীবনের দ্বিতীয় ধাপের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।

৩। শৈশব সঙ্গীত (১৮৮৪)

শৈশব সঙ্গীত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লেখেন – এই গ্রন্থে আমার তেরো হইতে আঠারো বৎসর বয়সের কবিতাগুলি প্রকাশ করিলাম, সুতরাং ইহাকে ঠিক শৈশবসঙ্গীত বলা যায় কিনা সন্দেহ। কিন্তু নামের জন্য বেশী কিছু আসে যায় না। কবিতা গুলির স্থানে স্থানে অনেকটা পরিত্যাগ করিয়াছি, সাধারণের পাঠ্য হইবে না বিবেচনায় ছাপাই নাই। হয়ত বা এই গ্রন্থে এমন অনেক কবিতা ছাপা হইয়া থাকিবে যাহা ঠিক প্রকাশের যোগ্য নহে। কিন্তু লেখকের পক্ষে নিজের লেখা ঠিকটি বুঝিয়া উঠা অসম্ভব ব্যাপার—বিশেষতঃ বাল্যকালের লেখার উপর কেমন-একটু বিশেষ মায়া থাকে যাহাতে কতকটা অন্ধ করিয়া রাখে। এই পর্য্যন্ত বলিতে পারি আমি যাহার বিশেষ কিছু না-কিছু গুণ না দেখিতে পাইয়াছি তাহা ছাপাই নাই।

৪। ছবি ও গান (১৮৮৪)

ছবি ও গান হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “উন্মেষ পর্ব”-এর অন্তর্গত। মানবজীবনের হাসিকান্নার কাহিনী এই গ্রন্থের প্রধান উপজীব্য বিষয়।

৫। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী (১৮৮৪)

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ব্রজবুলি ভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ কৈশোর ও প্রথম যৌবনে “ভানুসিংহ ঠাকুর ” ছদ্মনামে বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণে কিছু পদ রচনা করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলিই ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়।

৬। কড়ি ও কোমল

কড়ি ও কোমল হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “উন্মেষ পর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

 

ঐশ্বর্য পর্ব (১৮৯০ – ১৯০০) :

১। মানসী ১৮৯০:

মানসী হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “মানসী-সোনার তরী পর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। বীন্দ্রনাথ একজন ভ্রমণকারীও ছিলেন। গাজীপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি “মানসী”-এর বেশিরভাগ কবিতা লেখেন। সেখানকার অনুপম প্রাকৃতিক পরিবেশ কবিকে ছন্দোবদ্ধ কবিতাগুলি লেখতে সহায়তা করে। এটি ছিল তাঁর প্রথম পরিপক্ব গ্রন্থ যেখানে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রকার ছন্দ নিয়ে গবেষণা করেন।

২। সোনার তরী ১৮৯৪:

সোনার তরী হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বিখ্যাত বাংলা কাব্যগ্রন্থ। সমগ্র গ্রন্থটি বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক কাব্য সংকলন। এটি ১৮৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “মানসী-সোনার তরী পর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

নদী ১৮৯৬
চিত্রা ১৮৯৬
চৈতালী ১৮৯৬
কণিকা ১৯০০
কথা ও কাহিনী ১৯০০
কল্পনা ১৯০০
ক্ষণিকা ১৯০০

 

অন্তবর্তী পর্ব (১৯০১ – ১৯২৯) :

নৈবেদ্য ১৯০১
স্মরণ ১৯০৩
শিশু ১৯০৩
উৎসর্গ ১৯০৪
খেয়া ১৯১০
গীতাঞ্জলি ১৯১০
৭ গীতিমাল্য ১৯১৪
গীতালি ১৯১৫
৯ বলাকা ১৯১৬
১০ পলাতকা ১৯১৮
১১ শিশু ভোলানাথ ১৯২২
১২ পূরবী ১৯২৫
১৩ লেখন ১৯২৭
১৪ মহুয়া ১৯২৯

 

শেষ পর্ব (১৯৩০ – ১৯৪১) :

১. বনবাণী ১৯৩১
২. পরিশেষ ১৯৩২
৩. পুনশ্চ ১৯৩২
৪. বিচিত্রতা ১৯৩৩
৫. শেষ সপ্তক ১৯৩৫
৬. বীথিকা ১৯৩৫
৭. পত্রপুট ( ১৯৩৬)
৮. শ্যামলী ১৯৩৬
৯. খাপছাড়া ১৯৩৭
১০. ছড়ার ছবি ১৯৩৭
১১ প্রান্তিক ১৯৩৮
১২ সেঁজুতি ১৯৩৮
১৩ প্রহাসিনী ১৯৩৮
১৪ আকাশ প্রদীপ ১৯৩৯
১৫ নবজাতক ১৯৪০
১৬ সানাই ১৯৪০
১৭ রোগশয্যায় ১৯৪০
১৮ আরোগ্য ১৯৪১
১৯ জন্মদিনে ১৯৪১
২০ শেষলেখা ১৯৪১

 

মন্তব্য করুন