পথহারা
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ : শিশু ভোলানাথ [ ১৯২২ ]
কবিতার শিরনামঃ পথহারা
পথহারা pothohara [ কবিতা ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজকে আমি কতদূর যে
গিয়েছিলেম চলে।
যত তুমি ভাবতে পার
তার চেয়ে সে অনেক আরো,
শেষ করতে পারব না তা
তোমায় ব’লে ব’লে।
অনেক দূর সে, আরো দূর সে,
আরো অনেক দূর।
মাঝখানেতে কত যে বেত,
কত যে বাঁশ, কত যে খেত,
ছাড়িয়ে ওদের ঠাকুরবাড়ি
ছাড়িয়ে তালিমপুর।
পেরিয়ে গেলেম যেতে যেতে
সাত-কুশি সব গ্রাম,
ধানের গোলা গুনব কত
জোদ্দারদের গোলার মতো,
সেখানে যে মোড়ল কারা
জানি নে তার নাম।
একে একে মাঠ পেরোলুম
কত মাঠের পরে।
তার পরে, উঃ, বলি মা শোন্,
সামনে এল প্রকাণ্ড বন,
ভিতরে তার ঢুকতে গেলে
গা ছম-ছম করে।
জামতলাতে বুড়ী ছিল,
বললে “খবরদার”!
আমি বললেম বারণ শুনে
“ছ-পণ কড়ি এই নে গুনে,”
যতক্ষণ সে গুনতে থাকে
হয়ে গেলাম পার।
কিছুরি শেষ নেই কোত্থাও
আকাশ পাতাল জুড়ি’।
যতই চলি যতই চলি
বেড়েই চলে বনের গলি,
কালো মুখোশপরা আঁধার
সাজল জুজুবুড়ী।
খেজুরগাছের মাথায় বসে
দেখছে কারা ঝুঁকি।
কারা যে সব ঝোপের পাশে
একটুখানি মুচকে হাসে,
বেঁটে বেঁটে মানুষগুলো
কেবল মারে উঁকি।
আমায় যেন চোখ টিপছে
বুড়ো গাছের গুঁড়ি।
লম্বা লম্বা কাদের পা যে
ঝুলছে ডালের মাঝে মাঝে,
মনে হচ্ছে পিঠে আমার
কে দিল সুড়সুড়ি।
ফিসফিসিয়ে কইছে কথা
দেখতে না পাই কে সে।
অন্ধকারে দুদ্দাড়িয়ে
কে যে কারে যায় তাড়িয়ে,
কী জানি কী গা চেটে যায়
হঠাৎ কাছ এসে।
ফুরোয় না পথ ভাবছি আমি
ফিরব কেমন করে।
সামনে দেখি কিসের ছায়া,–
ডেকে বলি, “শেয়াল ভায়া,
মায়ের গাঁয়ের পথ তোরা কেউ
দেখিয়ে দে না মোরে।”
কয় না কিছুই, চুপটি করে
কেবল মাথা নাড়ে।
সিঙ্গিমামা কোথা থেকে
হঠাৎ কখন এসে ডেকে
কে জানে, মা, হালুম ক’রে
পড়ল যে কার ঘাড়ে।
বল্ দেখি তুই, কেমন করে
ফিরে পেলাম মাকে?
কেউ জানে না কেমন করে;
কানে কানে বলব তোরে?–
যেমনি স্বপন ভেঙে গেল
সিঙ্গিমামার ডাকে।
আরও দেখুনঃ
- আমার প্রিয়ার ছায়া [ Amar Priyar Chhaya ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রকৃতি)
- কিছু বলব বলে এসেছিলেম [ Kichu Bolbo Bole Eshechilam ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রকৃতি)
- আজি বরিষন মুখরিত [ Aji Borishono Mukhorito ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রকৃতি)
- মনে হল যেন [ Mone Holo Jeno ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রকৃতি)
- আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড [ Adhar Ambare Prachanda ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রকৃতি)