আমার রবীন্দ্রনাথ – বাণী বসু

আমার রবীন্দ্রনাথ [ বাণী বসু ] : জীবন গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে দেখেছি, আবার অনেককে সালেখিনি। শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেছি, কিন্তু বিবেকানন্দকে কখনও না। অথচ বিবেকানন্দ তাঁর গুরুর চেয়ে আমার মনের অনেক কাছাকাছি। আমি রবীন্দ্রনাথের বংশে জন্মেও, তাঁর কাছ থেকে প্রকৃত বাংলার পাঠ নেওয়ার পরেও কোনওদিন তাঁকে স্বপ্নে দেখিনি। এদিকে সাহিত্যিকরা সব একাধিকবার ওঁকে দেখে ফেলেছেন, আমার কেমন একটা হীনম্মন্যতা জন্মে গিয়েছিল। কেউ যখন বলছেন কীভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন (স্বপ্নে), আমি তখন মরমে মরে যাচ্ছি। যাই হোক, সেই শবরীর প্রতীক্ষার শেষ হল, এই গতকাল আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্বপ্নে দেখতে পেয়েছি।

বাণী বসু [ Bani Basu ], আমার রবীন্দ্রনাথ - বাণী বসু
বাণী বসু [ Bani Basu ]

[ আমার রবীন্দ্রনাথ – বাণী বসু ]

কী দেখিলাম! কী দেখিলাম! প্রতিভা বসুর সঙ্গে যখন ওঁর শেষ দিনগুলোতে আমার শেষ দেখা হয়, উনি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ জন্মবুড়ো। ওঁর তাই-ই ইমপ্রেশন। যখন কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথের কাছে গান শিখতে গিয়েছেন, পরে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে শান্তিনিকেতন গিয়েছেন, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ ঋষিতুল্য একজন দাদু গোছের কবি এই ছাপ্পা তাঁর মনে বসে গিয়েছিল। আমরাও ছবিতে তাঁকে সেই রকমই দেখেছি বরাবর। তবে আমরা ওঁর সংস্পর্শে কোনওদিন এলাম না, তাই ই হয়তো মানুষটা বুড়ো এই চেতনা হয়ইনি। আমাদের ছোটবেলায় বৃদ্ধদের অবশ্য এরকম হ্যাক থু করা হতও না। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ ওইরকম। ওঁর বহির্মুখের রেখাচিত্র আঁকতে হলে লম্বা দাড়ি, চুলসুদ্ধু ফট করে এঁকে ফেলা যায়। ওঁর ছবি দেখলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই হয়। কারণ? এ বুড়ো যে-সে বুড়ো নয় কথাটা নিশ্চয় ফুটে উঠত।

স্বপ্নে দেখলাম একজন দীর্ঘকায় সোনার বরণ তরুণ, মাথায় ঢেউ খেলানো কালো চুল, একটু একটু পাতলা দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে, ক্ষুরের উপযুক্ত হয়নি এখনও, খয়েরি রঙের ট্রাউজার্সের ওপর লম্বা একটি গুরু-কলার বাটিকের পাঞ্জাবি পরে এসে দাঁড়ালেন, হাতে বই, একটু লক্ষ করতে বুঝলাম ওটা বাঁধানো তিনখণ্ড গীতবিতান। চোখ দুটি দীর্ঘায়ত, পুরুষদের এমন চোখ হয় না, চোখের দৃষ্টি দূরসঞ্চারী, কেমন যেন বাদল মেঘের ছায়া তাতে। আমি চিত্রাপিতবৎ।

বললেন,—পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? আমি কোনওমতে মাথা নেড়ে সায় জানাই।

উনি বললেন, — আমিই রবীন্দ্রনাথ।

—আপনার পরনে তা হলে ট্রাউজার্স কেন?

আমার রবীন্দ্রনাথ - বাণী বসু
আমার রবীন্দ্রনাথ – বাণী বসু

—সব দেশে পরবার উপযুক্ত পোশাকের খোঁজ করতে করতে আমিই প্রথম জোব্বার তলায় পায়জামা পরে তাকে সহজ করে দিই বাঙালি মহলে, তারই এক রূপ তোমাদের এ যুগের ট্রাউজার্স। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বসুদ্ধু লোক এখন অফিস ছাড়া সর্বত্র একে পায়জামার মতোই পরে। আমি জিনসের কথা বলছি। —বাটিকের পাঞ্জাবিটা কিন্তু বড্ড আধুনিক লাগছে।

ঊনি মৃদু হেসে বললেন,—বালি থেকে বাটিক আমিই আমদানি করি। কোনও ব্যবসাদার নয়। আর যদি বলি, তোমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের ওই লম্বা লম্বা পাঞ্জাবি।

আমার জোব্বারই অপভ্রংশ? —শুধুমাত্র গীতবিতান হাতে নিয়েছেন কেন কবি?

উনি নিশ্বাস ফেলে বললেন, — এই সহজ প্রশ্নটা তুমি আমাকে করলে? —আমি আপনার উত্তরটা পুরোপুরি বিশ্বাস করি না যে, আমি বলি— ওটা আপনার অভিমানের কথা। আপনার গানটা অন্তত বাঙালি মনে রাখবে এ কথা নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়। আমি মানতে পারি না। দেখুন, মানুষ শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা অর্থাৎ স্বার্থ ছাড়া কিছুই মনে রাখে না। এবং আত্মপরিচয়ও যে আত্মরক্ষার একটা বড় অস্ত্র সেটা বুদ্ধি কমে গেলে মানুষ ভুলে যায়।

আমার রবীন্দ্রনাথ - বাণী বসু
আমার রবীন্দ্রনাথ – বাণী বসু

ইতিমধ্যে এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আপনাকে নিয়ে দীর্ঘদিনের এক সফল সাংস্কৃতিক বাণিজ্য আমরা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি। আপনার উপন্যাস, আপনার ছোটগল্প, আপনার নাটক এ সবই লগ্নি করছি। লাভ ভালোই। বেশি কথা কী, আপনি কি জানেন পাঁচের দশকের বোম্বাই ছবি ‘ওয়ারিশ’-এ আপনার ‘খোল দ্বার খোল’-এর সুর পুরো তুলে নিয়ে একটি হিট গান হয়—রাহি মাতোয়ালি? জানেন ‘অতিথি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ তো বটেই, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ পর্যন্ত সার্থক ফিল্ম করেছেন তপন সিংহ। আপনার ছোটগল্প থেকে ছোটগাল্পিক সিনেমা প্রথম এদেশে করলেন সত্যজিৎ রায়। ‘নষ্টনীড়’ কে কী রূপ দিয়েছেন ভদ্রলোক দেখলে আপনার ভালো লাগত। করে একজন গিরিশ কারনাড বলেছেন, আপনার নাটক ধর্তব্যের মধ্যে নয়, তাই আমাদেরও সে কথা মানতে হবে? শম্ভু মিত্রের প্রোডাকশনগুলির পরেও? ছিঃ!

চোখ দুটি কি একটু চিকচিক করে উঠল? বললেন,— গীতবিতান হাতে নেওয়ার আরও কারণ আছে। এই গীতিচয় আমার সমস্ত বোধ ও বোধির নির্যাস, এ কথা মিথ্যা নয়। এদের ব্যবহার করার বহু পথ এখনও খোলা। কপিরাইট উঠে গিয়েছে। মুক্ত মনে আমায় পড়ো। অনেক নতুন কথা পাবে। মুক্ত মনে আমায় গাও, অনেক নতুন ভাব পাবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, আপন আত্মার সঙ্গীত গাও। মুক্তমনে আমায় অভিনয় করো, বোধির দুয়ার খুলে যাবে। —তুমি মোর পাও নাই, পাও নাই পরিচয়—উনি গন্ধবম্বরে, গেয়ে উঠলেন।

মুগ্ধ হয়ে থাকি, উনি গান আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি/হায় বুঝি

তার খবর পেলে না। তার পরের গান—

চিনিলে না আমাকে কি চিনিলে না/দ্বারে এসে গেলে ভুলে/পরশনে দ্বার যেত খুলে/ মোর ভাগ্যবতী এটুকু বাধায় গেল ঠেকি, চিনিলে না।

উনি চুপ করে গেলেন। বললাম, বুঝেছি। —কী বুঝলে?

—আপনি অভিমানের কবি। এত পেয়েছেন, তবু আপনার অভিমান গেল

না। আসলে অভিমান না বুঝলে অপ্রাপ্তির যাতনা সওয়া মানুষকে তো চেনা যায় না, তাই আপনি অভিমানী। আপনি চিরবিরহীও। কোনওদিন তাকে পেলেন না। – পেলে তো সে থাকত না, উনি ছোট্ট গলায় বললেন।

চমকে যাই। কিছুক্ষণ ভেবে বলি— তাই না? আপনি এইভাবে ভেবেছেন, বরাবর? ‘শেষের কবিতা’ আপনার প্রেমের হ্যান্ডবুক। মোটেই হেলাফেলা করার বই নয়।

—তোমরা ওটিকে হেলাফেলা করো না কি?

আমার রবীন্দ্রনাথ - বাণী বসু
আমার রবীন্দ্রনাথ – বাণী বসু

একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলি,— আসলে প্রথম পড়ি তখন স্কুলের শেষ ধাপে। আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। পরে পড়ে একটু কাব্যি কাব্যি ছেলেমানুষির মতো লাগে। আনরিয়াল। তবে ওর মধ্যেও সেই অভিমান, এবার তার অন্য অর্থ নিয়ে জেগে উঠেছে। আপনি আধুনিক নন, কবি হিসেবে আপনি যুগের সঙ্গে বদলাচ্ছেন না এই অভিযোগ আপনার অহংকে বড্ড কষ্ট দিয়েছে আর তাতেই আপনি এক জাল নিবারণ চক্রবর্তীকে আমদানি করেছেন, যে নাকি এক মেকি রবীন্দ্রনাথ। একটু ছেলেমানুষি করে ফেলেছেন, যা-ই বলুন। লোকের কথায় অত কান দিতেন কেন?

অপূর্ব চন্দ-র আদলে গড়া আপনার অমিত রে আর চারু দত্তর কন্যা, অপূর্ব চন্দর অকালমৃত স্ত্রী লোপামুদ্রার আদলে লাবণ্য কিন্তু অতি চমৎকার উতরেছে। ওঁরা, যাকে বলে, আইকনিক (iconic) হয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। আমরা আপনার ওই দীপক-মানসী কনসেপ্টটাকে আসলে নিতে পারিনি। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী দিঘির এপার-ওপার থাকবে, মাঝে মাঝে আকাশপ্রদীপে মিলনসঙ্কেত জানাবে, পত্নী আর পতি ডিঙা বাইবে দিঘিতে— এটাকে ছেলেমানুষি মনে হয়েছিল।

—দীপক-মানসী ছেলেমানুষি? তরুণ রবি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন, হতে পারে আইডিয়ালিজম। কিন্তু প্রেম সম্পর্কে যা সত্য বলে জেনেছি তাই-ই…

—এখন বুঝেছি। আসলে কবি প্রত্যেকেরই গোটা একটা জীবন লেগে যায় বুঝতে। আপনার উক্তিগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নিলেই কি আপনি খুশি হতেন? উপলব্ধি চাই। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা পথে ব্যক্তিগত ভোগ দিয়ে উপলব্ধি। আর এ-ও বলি জীবনে জীবন যোগ করা না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় প্রাণের পসরা। তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা— আমার সুরের অপূর্ণতা। আমার কবিতা জানি আমি গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।

আমার রবীন্দ্রনাথ - বাণী বসু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এ সব গাদ্যিক কৈফিয়ত আপনাকে কে দিতে বলেছিল ভাই? কবিকে খুবই তরুণ দেখে ভাইটা আমার বেরিয়ে এল। আপনার মতো মানুষের বিনয় বা অহঙ্কারহীনতা অবধি ঠিক আছে। কিন্তু এ তো হীনম্মন্যতা! আপনি যখন ‘সভ্যতার সঙ্কট’ লিখছেন, তখন কল্লোলরা কুয়োয় নেমে কাদা ঘাঁটছেন। আপনি যখন জালিয়ানাওয়ালাবাগের প্রতিবাদ করতে নিজের নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তখন কী করছিলেন সে যুগের কৃষাণের জীবনের শরিক রাজনীতিক কবি, সাহিত্যিক এমনকী জাতির জনক-রা? কে সর্বপ্রথম বুঝেছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের গলতি আছে? কে তাকে চূড়ান্ত অপবাদ মাথায় করে রূপ দিল ‘ঘরে বাইরে তে? কে স্বাধীনতা সংগ্রামের গরগরে চেহারাটাকে একটা বিপদযাত্রা বলে চিনতে পেরে সেটা ধরিয়ে দিয়েছিল ‘চার অধ্যায়’তে?

Rabindranath Tagore 35 আমার রবীন্দ্রনাথ - বাণী বসু

এবার তরুণ হাসলেন।

-তা হলে একবিংশের পাঠক, আর আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না তো কেন বাটিক কেন ট্রাউজার্স?

—না কবি, আমি বুঝেছি, আপনি চির আধুনিক, কারণ আধুনিকতার উৎসগুলো আপনার হাতের মুঠোয়। এমন তরুণ বেশে আমাকে দেখা দিলেন আপনার ভেতরের ওই চির-পদার্থকে একটা বাইরের রূপ দিতে—এও বুঝেছি। এবার তরুণ ভালো করে হাসলেন, হাসিতে অভিমানী বিরহীর চিহ্ন নেই। কৌতুকের হাসি।

বললেন, না, বোঝোনি।

—তা হলে?

-শোনো, আমাদের সময়ে ফোটোগ্রাফি খুব খারাপ, রেকর্ডিং-এর কথা তো কহতব্য নয়। আমার সে তারুণ্য সে যৌবন অধরা রয়ে গেছে। নেই সে কণ্ঠও। তুমি তো বরাবর সেই রবিকে দেখতে চেয়েছিলে, শুনতে চেয়েছিলে—চাওনি?

আমি চুপ করে থাকি। তিনি বলেন, — কোনও প্রেমকে আমি কোনওদিন অবজ্ঞা করিনি। তোমার প্রেমও আমি গ্রহণ করছি।

স্বপ্নের আমি শশব্যস্তে বলে উঠি,— আমি কোনও অর্থেও আপনার যোগ্য নই। যোগ্য ছিলেন না বলে মৃণালিনীর কঠিন ভাগ্য আমি ভুলি না। যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আনা তড়খড়কে ঠাকুরবাড়ির প্রত্যাখ্যান (?) আমি ভুলতে পারি না। কবি, তোমার বউঠান হয়ে জেনেশুনে বিষ পান করতে আমি পারব না। আর বৃদ্ধ তোমার ঘরের বাইরে পাপোষপ্রতিম ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো হতেও আমি নারাজ। ও আমার দ্বারা হবে না। যদি কিছু সত্যিই দিতে চাও তা হলে প্রেম নয়, তোমার ওই অলৌকিক ত্রিকালদর্শী আবেশ আমাকে দিও।

যে ঘুমকে ঘুম বলে বোঝা যায়নি, সে ঘুম ভাঙার অনুভূতি কী, যার হয়নি তাকে তো বোঝানো যাবে না! হুহু করে হাওয়ারা ঘরে ঢুকছে। গভীর হাওয়ার রাত। নক্ষত্রের রাত। এখনও ভোর স্পষ্ট নয়। বাতায়নবর্তী ও কে? ছায়া? ছলনা? কুয়াশামুখ ফিরে একবার তাকায় নির্নিমেষ, তারপর শূন্যোদ্ভব সেই দেব না দানব আবার শূন্যে মিশে যায়।

দেড়শো বছরের রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীর ভোর হয়।

বাণী বসু- বিশিষ্ট সাহিত্যিক

আরও পড়ুন:

মন্তব্য করুন