ভগ্নহৃদয় ত্রয়স্ত্রিংশ সর্গ bhagno hriday troyotringso sorgo [ কবিতা ]
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ : ভগ্নহৃদয়
কবিতার শিরোনামঃ ভগ্নহৃদয় ত্রয়স্ত্রিংশ সর্গ
ভগ্নহৃদয় ত্রয়স্ত্রিংশ সর্গ bhagno hriday troyotringso sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পর্ণশয্যায় শয়ান মুরলা। চপলা
চপলা। কি করিয়া এত তুই হলি রে নিষ্ঠুর,
ললিতা সে, এত ভাল বাসিতিস যারে,
কি করিয়া ফেলি তারে যাবি দূর– দূর–
এতদিনকার প্রেম ছিঁড়ি একেবারে!
কবি তোরে এত ভাল বাসে যে মুরলে,
তারেও কি তুই, সখি, ফেলে যাবি চ’লে?
[কবি ও অনিলের প্রবেশ]
কবি। কি করিলি বল্ দেখি! কি করেছি তোর?
মুরলা রে, মুরলা রে, মুরলা আমার, হা– রে,
কি করেছি এত তুই হলি যে কঠোর?
প্রাণ মোর, মন মোর, হৃদয়ের ধন মোর,
সমস্ত হৃদয় মোর, জগৎ আমার–
একবার বল্ বালা, বল্ একবার
ছাড়িয়ে যাবি নে মোরে ফেলি এ সংসার-ঘোরে,
নিতান্ত এ হৃদয়েরে রাখি অসহায়।
আয়, সখি, বুকে থাক্, এই হেথা মাথা রাখ্,
হৃদয়ের রক্ত ফেটে বাহিরিতে চায়।
মুরলা, এ বুক তুই ত্যজিস্ নে আর–
চিরদিন থাক্, সখি, হৃদয়ে আমার!
মুরলা। লও কবি, এই লও, এই মাথা তুলে লও–
অবসন্ন এ মাথা যে পারি নে তুলিতে,
একবার রাখ সখা, রাখ ও কোলেতে!
নিতান্তই স্বার্থপর হৃদয় আমার,
অতি নীচ হীন হৃদি এই মুরলার–
নির্দ্দয়– নির্দ্দয় বড়– পাষাণ হতে দড়,
ধূলি হ’তে লঘুতর হৃদয় আমার!
নহিলে কি ক’রে আমি, কবি, কবি মোর,
(হৃদয়ে ঘনায়ে ছিল কি মোহের ঘোর!)
স্নেহময় তোমারেও ত্যজি অনায়াসে
কি ক’রে আইনু চলি এ দূর প্রবাসে?
ও করুণ নয়নের অশ্রুবারিধার
একবারো মনে নাহি পড়িল আমার?
অমন স্নেহের পানে ফিরে না চাহিয়ে
পারিনু আঘাত দিতে ও কোমল হিয়ে?
মার্জ্জনা করিও এই অপরাধ তার,
কবি মোর, শেষ ভিক্ষা এই মুরলার!
এমন দুর্ব্বল হৃদি, এত নীচ, হীন,
এমন পাষাণে গড়া, এতই সে দীন,
এ যে চিরকাল ধ’রে ছিল তব কাছে
এ অপরাধের, কবি, মার্জ্জনা কি আছে?
সখা, অপরাধ সারা অস্তিত্ব তাহার–
মরণে করিবে আজি প্রায়শ্চিত্ত তার!
কেন আজ মুখখানি শীর্ণ ও মলিন–
বড় যেন শ্রান্ত দেহ, অতি বলহীন–
রাখ কবি, মাথা রাখ, এই বুকে মাথা রাখ,
একটু বিশ্রাম কর হৃদয়ে আমার!
ছি ছি সখা, কেঁদো নাকো, মুরলার কথা রাখো–
ও মুখে দেখিতে নারি অশ্রুবারিধার!
কবি। এত দিন এত কাছে ছিনু এক ঠাঁই,
মিলনের অবসর মোরা পাই নাই।
কে জানিত ভাগ্যে, সখি, ঘটিবে এমন
মরণের উপকূলে হইবে মিলন!
মুরলা। কি যে সুখ পেতেছি তা বলিব কি ক’রে–
বল সখা, এখনি কি যাব আমি ম’রে?
এই মরণের দিন না যদি ফুরায়
মরিতে মরিতে যদি বেঁচে থাকা যায়–
দিন যায়, দিন যায়, মাস চলে যায়,
তবু মরণের দিন না যদি ফুরায়!
সখা ওগো, দাও মোরে, দাও মোরে জল–
সুখেতে হয়েছি শ্রান্ত, অতি দুরবল।
কবি। বিবাহ হইবে, সখি, আজ আমাদের–
দারুণ বিরহ ওই আসিবার আগে, সই,
অনন্ত মিলন হোক এই দুজনের!
আকাশেতে শত তারা চাহিয়া নিমেষহারা,
উহারা অনন্ত সাক্ষী রবে বিবাহের!
আজি এই দুটি প্রাণ হইল অভেদ,
মরণে সে জীবনের হবে না বিচ্ছেদ।
হোক তবে, হোক, সখি, বিবাহ সুখের–
চিতায় বাসরশয্যা হোক আমাদের!
মুরলা। তবে তুলে আন ত্বরা রাশি রাশি ফুল!
চিতাশয্যা হোক আজি কুসুমে আকুল!
রজনীগন্ধার মালা গাঁথ গো ত্বরায়,
সে মালা বদল করি দিও এ গলায়–
সেই মালা প’রে আমি তোমার সমুখে, স্বামি,
কবির শয়ন সুখে সুখের চিতায়!
সেই মালা প’রে যেন দগ্ধ হয় কায়!
[ উভয়ের প্রস্থান ]
কবি গো, বড়ই সাধ ছিল মনে মনে
এক দিন কেঁদে নেব ধরি ও চরণে–
দেখি, কবি, পা-দুখানি দেখি একবার,
বড় সাধ গেছে মনে সুখে কাঁদিবার!
কই, ফুল এল না ত, আসিবে কখন?
এখনি ফুরায়ে পাছে যায় এ জীবন!
আরো কাছে এস কবি, আরো কাছে মোর–
রাখ হাত দুইখানি হাতের উপর!
কবি গো, স্বপ্নেও আমি ভাবি নাই কভু
শেষদিনে এত সুখ হবে মোর প্রভু।
এখনো এল না ফুল! সখা গো আমার,
বড় যে হতেছি শ্রান্ত, পারি নে যে আর!
[ফুল লইয়া অনিলের প্রবেশ]
[অনিলের প্রতি] ললিতা কেমন আছে বল ভাই বল!
অনিল। ললিতা কেমন আছে? সে আছে রে ভাল!
মুরলা। চিরকাল ভাল যেন থাকে আদরিণী,
চিরকাল পতিসুখে থাকে সোহাগিনী!
কথা ক’ চপলা, সখি, মাথা খা আমার–
নীরবে নীরবে বসি কাঁদিস না আর!
মরণের দিনে দুঃখ র’য়ে গেল চিতে।
হাসিখুশি মুখ তোর পেনু না দেখিতে!
সুখে থাক্– সখি, তুই চিরসুখে থাক্–
হাসিয়া খেলিয়া তোর এ জীবন যাক্!
ওই-যে এসেছে মালা– কবি গো, ত্বরায়
পরায়ে দাও গো তাহা এ মোর গলায়।
এই লও হাত মোর রাখ তব হাতে–
ছেলেবেলা হতে মোরে কত দয়া স্নেহ ক’রে
রেখেছ এ হাত ধরি তব সাথে সাথে,
আবার মোদের যবে হইবে মিলন
এ হাত আমার, কবি, করিও গ্রহণ–
যেথা যাবে সেথা রব, দুই জনে এক হব,
অনন্ত বাঁধনে রবে অনন্ত জীবন!
কবি। বিবাহ মোদের আজ হল এই তবে,
ফুল যেথা না শুকায় সদা ফুটে শোভা পায়
সেথায় আরেক দিন ফুলশয্যা হবে!
মুরলা। [কবিকে] এস কবি, বুকে এস!
[অনিলকে] এস ভাই, কাছে বস!
[চপলাকে] একটি চুম্বন, সখি,–বুঝি প্রাণ যায়,
এই শেষ দেখা এই দুখের ধরায়!
আসিছে আঁধার ঘোর– কবি, কোথা তুমি মোর!
আরো কাছে, আরো কাছে, এস গো হেথায়!
আজ তবে বিদায়, বিদায়!
স্বামি, প্রভু, কবি, সখা, আবার হইবে দেখা,
আজ তবে বিদায় বিদায়!
আরও পড়ুনঃ