হাসির পাথেয় kasir patheyo [ কবিতা ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হাসির পাথেয়

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাব্যগ্রন্থ : পুনশ্চ [ ১৯৩২ ]

কবিতার শিরনামঃ হাসির পাথেয়

হাসির পাথেয় kasir patheyo [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

হাসির পাথেয় kasir patheyo [ কবিতা ] – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তখন আমার অল্প বয়স । পিতা আমাকে সঙ্গে করে হিমালয়ে  চলেছেন ড্যালাহৌসি পাহাড়ে । সকালবেলায় ডাণ্ডি চ’ড়ে বেরতুম, অপরাহ্নে ডাকবাংলায় বিশ্রাম হত । আজও মনে আছে এক জায়গায়  পথের ধারে ডান্ডিওয়ালারা ডান্ডি নামিয়েছিল । সেখানে শ্যাওলায় শ্যামল পাথরগুলোর উপর দিয়ে গুহার ভিতর থেকে ঝরনা নেমে উপত্যকায় কলশব্দে ঝরে পড়ছে । সেই প্রথম দেখা ঝরনার রহস্য আমার  মনকে প্রবল করে টেনেছিল । এ দিকে ডান পাশে পাহাড়ের ঢালু গায়ে স্তরে স্তরে শস্যখেত হলদে ফুলে ছাওয়া , দেখে দেখে তৃপ্তি শেষ হয় না–  কেবলই ভাবি এইগুলো ভ্রমণের লক্ষ্য কেন না হবে, কেবল ক্ষণিক উপলক্ষ কেন হয়। সেই ঝরনা কোন্‌ নদীর সঙ্গে মিলে কোথায় গেছে জানি নে কিন্তু সেই মুহুর্তকালের প্রথম পরিচয়টুকু কখনো ভুলব না ।

হিমালয় গিরিপথ চলেছিনু কবে বাল্যকালে

মনে পড়ে । ধূর্জটির তান্ডবের ডম্বরুর তালে

যেন গিরি-পিছে গিরি উঠিছে নামিছে বারেবারে

তমোঘন অরণ্যের তল হতে মেঘের মাঝারে

ধরার ইঙ্গিত যেথা স্তদ্ধ রহে শূন্যে অবলীন,

তুষারনিরুদ্ধ বাণী, বর্ণহীন বর্ণনাবিহীন

সেদিন বৈশাখমাস, খন্ড খন্ড শস্যক্ষেত্রস্তরে

রৌদ্রবর্ণ ফুল; মেঘের কোমল ছায়া তারি “পরে

যেন স্নিগ্ধ আকাশের ক্ষণে ক্ষণে নীচে নেমে এসে

ধরণীর কানে কানে প্রশংসার বাক্য ভালোবেসে ।

সেইদিন দেখেছিনু নিবিড় বিস্ময়মুগ্ধ চোখে

চঞ্চল নির্ঝরধারা গুহা হতে বাহিরি আলোকে

আপনাতে আপনি চকিত, যেন কবি বাল্মীকির

উচ্ছ্বসিত অনুষ্টুভ। স্বর্গে যেন সুরসুন্দরীর

প্রথম যৌবনোল্লাস, নূপুরের প্রথম ঝংকার,

আপনার  পরিচয়ে নিঃসীম বিস্ময় আপনার,

আপনারি রহস্যের পিছে পিছে উৎসুক চরণে

অশ্রান্ত সন্ধান। সেই ছবিখানি রহিল স্মরণে

চিরদিন মনোমাঝে।

 

স্পর্ধা spordha [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

                    সেদিনের যাত্রাপথে হতে

আসিয়াছি বহুদুরে; আজি ক্লান্ত জীবনের স্রোতে

নেমেছে সন্ধ্যার নীরবতা । মনে উঠিতেছে ভাসি

শৈলশিখরের দূর নির্মল শুভ্রতা রাশি রাশি

বিগলিত হয়ে আসে দেবতার আনন্দের মতো

প্রত্যাশী ধরণী যেথা প্রণামে ললাট অবনত।

সেই নিরন্তর হাসি অবলীল গতিছন্দে বাজে

কঠিন বাধায় কীর্ণ শঙ্কায় সংকুল পথমাঝে

দুর্গমেরে করি অবহেলা।  সে হাসি দেখেছি বসি

শস্যভরা তটচ্ছায়ে কলস্বরে চলেছে উচ্ছ্বসি

পূর্ণবেগে।  দেখেছি অম্লান তারে তীব্র রৌদ্রদাহে

শুষ্ক শীর্ণ দৈন্যদিনে বহি যায় অক্লান্ত প্রবাহে

সৈকতিনী, রক্তচক্ষু বৈশাখেরে নিঃশঙ্ক কৌতুকে

কটাক্ষিয়া– অফুরান হাস্যধারা মৃত্যুর সম্মুখে।

হে হিমাদ্রি, সুগম্ভীর, কঠিন তপস্যা তব গলি

ধরিত্রীরে করে দান যে অমৃতবাণীর অঞ্জলি

এই সে হাসির মন্ত্র, গতিপথে নিঃশেষ পাথেয়,

নিঃসীম সাহসবেগ, উল্লসিত অশ্রান্ত অজেয়।

আরও দেখুনঃ

যোগাযোগ

মন্তব্য করুন