ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “পুত্রপুট“কাব্যের অন্তর্গত। পত্রপুট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১৩৪৩ (১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট আঠারোটি কবিতা রয়েছে। পত্রপুট রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার অন্ত্যপর্বের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত।
দেবালয়ের মন্দির-দ্বারে
পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে।
ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে
সকল বেড়ার বাইরে
সহজ ভক্তির আলোকে,
নক্ষত্রখচিত আকাশে,
পুষ্পখচিত বনস্থলীতে,
দোসর-জনার মিলন বিরহের
গহন বেদনায়।
যে দেখা বানিয়ে দেখা বাঁধা ছাঁচে,
প্রাচীর ঘিরে’ দুয়ার তুলে’,
সে দেখার উপায় নেই ওদের হাতে।
কতদিন দেখেছি ওদের সাধককে
একলা প্রভাতের রৌদ্রে সেই পদ্মানদীর ধারে,
যে নদীর নেই কোনো দ্বিধা
পাকা দেউলের পুরাতন ভিত ভেঙে ফেলতে।
দেখেছি একতারা হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে
মনের মানুষকে সন্ধান করবার
গভীর নির্জন পথে।

কবি আমি ওদের দলে,—
আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন,
দেবতার বন্দীশালায়
আমার নৈবেদ্য পৌঁছল না।
পূজারী হাসিমুখে মন্দির থেকে বাহির হয়ে আসে,
আমাকে সুধায়, “দেখে এলে তোমার দেবতাকে?”
আমি বলি, “না।”
অবাক হয় শুনে’, বলে “জানা নেই পথ?”
আমি বলি,—“না।”
প্রশ্ন করে, “কোনো জাত নেই বুঝি তোমার?”
আমি বলি, “না।”

Where the mind is without fear | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

এমন ক’রে দিন গেল;
আজ আপন মনে ভাবি,—
“কে আমার দেবতা,
কার করেছি পূজা।
শুনেছি যাঁর নাম মুখে মুখে,
পড়েছি যাঁর কথা নানা ভাষায় নানা শাস্ত্রে,
কল্পনা করেছি তাঁকেই বুঝি মানি।
তিনিই আমার বরণীয় প্রমাণ করব ব’লে
পূজার প্রয়াস করেছি নিরন্তর।
আজ দেখেছি প্রমাণ হয় নি আমার জীবনে।
কেননা, আমি ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন।

মন্দিরের রুদ্ধদ্বারে এসে আমার পূজা
বেরিয়ে চলে গেল দিগন্তের দিকে,—
সকল বেড়ার বাইরে,
নক্ষত্রখচিত আকাশতলে,
পুষ্পখচিত বনস্থলীতে,
দোসর-জনার মিলন বিরহের
বেদনা-বন্ধুর পথে।

Thought that my voyage had come to its end | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

বালক ছিলেম যখন
পৃথিবীর প্রথম জন্মদিনের আদি মন্ত্রটি
পেয়েছি আপন পুলককম্পিত অন্তরে,—
আলোর মন্ত্র।
পেয়েছি নারকেল শাখার ঝালর-ঝোলা
আমার বাগানটিতে,
ভেঙে পড়া শ্যাওলা-ধরা পাঁচিলের উপর
একলা ব’সে।
প্রথম প্রাণের বহ্নি-উৎস থেকে
নেমেছে তেজোময়ী লহরী,
দিয়েছে আমার নাড়ীতে
অনির্বচনীয়ের স্পন্দন।
আমার চৈতন্যে গোপনে দিয়েছে নাড়া
অনাদিকালের কোন্ অস্পষ্ট বার্তা,
প্রাচীন সূর্যের বিরাট বাষ্পদেহে বিলীন
আমার অব্যক্ত সত্তার রশ্মিস্ফুরণ।

হেমন্তের রিক্তশস্য প্রান্তরের দিকে চেয়ে
আলোর নিঃশব্দ চরণধ্বনি
শুনেছি আমার রক্ত-চাঞ্চল্যে।
সেই ধ্বনি আমার অনুসরণ করেছে
জন্মপূর্বের কোন্ পুরাতন কালযাত্রা থেকে।
বিস্ময়ে আমার চিত্ত প্রসারিত হয়েছে অসীমকালে
যখন ভেবেছি
সৃষ্টির আলোক-তীর্থে
সেই জ্যোতিতে আজ আমি জাগ্রত
যে জ্যোতিতে অযুত নিযুত বৎসর পূর্বে
সুপ্ত ছিল আমার ভবিষ্যৎ।
আমার পূজা আপনিই সম্পূর্ণ হয়েছে প্রতিদিন
এই জাগরণের আনন্দে।
আমি ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন,
রীতিবন্ধনের বাহিরে আমার আত্মবিস্মৃত পূজা
কোথায় হোলো উৎসৃষ্ট জানতে পারিনি।

This is my prayer to thee, my lord | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

যখন বালক ছিলেম ছিল না কেউ সাথী,
দিন কেটেছে একা একা
চেয়ে চেয়ে দুরের দিকে।
জন্মেছিলেম অনাচারের অনাদৃত সংসারে,
চিহ্ন-মোছা, প্রাচীরহারা।
প্রতিবেশীর পাড়া ছিল ঘন বেড়ায় ঘেরা,
আমি ছিলেম বাইরের ছেলে, নাম-না-জানা।

ওদের ছিল তৈরি বাসা, ভিড়ের বাসা,—
ওদের বাঁধা পথের আসা-যাওয়া
দেখেছি দূরের থেকে
আমি ব্রাত্য, আমি পংক্তিহারা।
বিধান-বাঁধা মানুষ আমাকে মানুষ মানেনি,
তাই আমার বন্ধুহীন খেলা ছিল সকল পথের চৌমাথায়,
ওরা তার ও পাশ দিয়ে চলে গেছে।
বসনপ্রান্ত তুলে’ ধ’রে।
ওরা তুলে নিয়ে গেল ওদের দেবতার পূজায়
শাস্ত্র মিলিয়ে বাছা-বাছা ফুল,
রেখে দিয়ে গেল আমার দেবতার জন্যে
সকল দেশের সকল ফুল,
এক সূর্যের আলোকে চিরস্বীকৃত।
দলের উপেক্ষিত আমি,
মানুষের মিলন-ক্ষুধায় ফিরেছি,
যে মানুষের অতিথিশালায়
প্রাচীর নেই, পাহারা নেই।
লোকালয়ের বাইরে পেয়েছি আমার নির্জনের সঙ্গী
যারা এসেছে ইতিহাসের মহাযুগে
আলো নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে, মহাবাণী নিয়ে।
তার বীর, তার তপস্বী, তারা মৃত্যুঞ্জয়,
তারা আমার অন্তরঙ্গ, আমার স্ববর্ণ, আমার স্বগোত্র,
তাদের নিত্য শুচিতায় আমি শুচি।
তারা সত্যের পথিক, জ্যোতির সাধক,
অমৃতের অধিকারী।

মানুষকে গণ্ডীর মধ্যে হারিয়েছি
মিলেছে তার দেখা
দেশবিদেশের সকল সীমানা পেরিয়ে।
তাকে বলেছি হাত জোড় ক’রে,—
হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ,
পরিত্রাণ করো—
ভেদচিহ্নের তিলক-পরা
সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে।
হে মহান পুরুষ, ধন্য আমি, দেখেছি তোমাকে
তামসের পরপার হতে
আমি ব্রাত্য, আমি জাতিহারা।

Thought that my voyage had come to its end | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

একদিন বসন্তে নারী এল সঙ্গীহারা আমার বনে
প্রিয়ার মধুর রূপে।
এল সুর দিতে আমার গানে,
নাচ দিতে আমার ছন্দে,
সুধা দিতে আমার স্বপ্নে।
উদ্দাম একটা ঢেউ হৃদয়ের তট ছাপিয়ে
হঠাৎ হোলো উচ্ছ্বলিত,
ডুবিয়ে দিল সকল ভাষা,
নাম এল না মুখে।
সে দাঁড়াল গাছের তলায়,
ফিরে তাকাল আমার কুন্ঠিত বেদনাকরুণ
মুখের দিকে।
ত্বরিত পদে এসে বলল আমার পাশে।

দুই হাতের মধ্যে আমার হাত তুলে নিয়ে বললে,—
“তুমি চেনো না আমাকে, তোমাকে চিনিনে আমি,
আজ পর্যন্ত কেমন ক’রে এটা হোলো সম্ভব
আমি তাই ভাবি।”
আমি বললেম, “দুই না-চেনার মাঝখানে
চিরকাল ধ’রে আমরা দুজনে বাঁধব সেতু,
এই কৌতূহল সমস্ত বিশ্বের অন্তরে।”

ভালবেসেছি তাকে।
সেই ভালবাসার একটা ধারা
ঘিরেছে তাকে স্নিগ্ধ বেষ্টনে
গ্রামের চিরপরিচিত অগভীর নদীটুকুর মতো।
অল্পবেগের সেই প্রবাহ
বহে চলেছে প্রিয়ার সামান্য প্রতিদিনের
অনুচ্চ তটচ্ছায়ায়।
অনাবৃষ্টির কার্পণ্যে কখনো সে হয়েছে ক্ষীণ
আষাঢ়ের দাক্ষিণ্যে কখনো সে হয়েছে প্রগল্‌ভ।
তুচ্ছতার আবরণে অনুজল
অতি সাধারণ স্ত্রী-স্বরূপকে
কখনো করেছে লালন, কখনো করেছে পরিহাস,
আঘাত করেছে কখনো বা।
আমার ভালবাসার আর একটা ধারা
মহাসমুদ্রের বিরাট ইঙ্গিতবাহিনী।
মহীয়সী নারী স্নান ক’রে উঠেছে
তারি অতল থেকে।

সে এসেছে অপরিসীম ধ্যানরূপে
আমার সর্বদেহেমনে,
পূর্ণতর করেছে আমাকে, আমার বাণীকে।
জ্বেলে রেখেছে আমার চেতনার নিভৃত গভীরে
চির বিরহের প্রদীপশিখা।
সেই আলোকে দেখেছি তাকে অসীম শ্রীলোকে,
দেখেছি তাকে বসন্তের পুষ্পপল্লবের প্লাবনে,
সিসুগাছের কাঁপনলাগা পাতাগুলির থেকে
ঠিকরে পড়েছে যে রৌদ্রকণা
তার মধ্যে শুনেছি তা’র সেতারের দ্রুতঝংকৃত সুর।
দেখেছি ঋতুরঙ্গভূমিতে
নানা রঙের ওড়না-বদল-করা তার নাচ
ছায়ায় আলোয়।

ইতিহাসের সৃষ্টি-আসনে
ওকে দেখেছি বিধাতার বামপাশে;
দেখেছি সুন্দর যখন অবমানিত
কদর্য কঠোরের অশুচিস্পর্শে
তখন সেই রুদ্রাণীর তৃতীয় নেত্র থেকে
বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রলয়-অগ্নি,
ধ্বংস করেছে মহামারীর গোপন আশ্রয়।

আমার গানের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে দিনে দিনে
সৃষ্টির প্রথম রহস্য,—আলোকের প্রকাশ,
আর সৃষ্টির শেষ রহস্য,—ভালবাসার অমৃত।

আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন
সকল মন্দিরের বাহিরে
আমার পূজা আজ সমাপ্ত হোলো
দেবলোক থেকে
মানবলোকে,
আকাশে জ্যোতির্ময় পুরুষে
আর মনের মানুষে আমার অন্তরতম আনন্দে।

শান্তিনিকেতন, ১৮ বৈশাখ, ১৩৪৩।

 

Amar Rabindranath Logo

আরও দেখুন:

মন্তব্য করুন