গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গানভঙ্গ কবিতাটি [ Gaanvongo Kobita ] কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের অংশ।  এটি ১৮৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “মানসী-সোনার তরী পর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

কাব্যগ্রন্থের নামঃ সোনার তরী

কবিতার নামঃ গানভঙ্গ

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গানভঙ্গ।

গাহিছে কাশিনাথ নবীন যুবা
ধ্বনিতে সভাগৃহ ঢাকি’,
কণ্ঠে খেলিতেছে সাতটি সুর
সাতটি যেন পোষা পাখী।
শাণিত তরবারি গলাটি যেন
নাচিয়া ফিরে দশদিকে,
কখন্ কোথা যায় না পাই দিশা,
বিজুলি-হেন ঝিকিমিকে।
আপনি গড়ি’ তোলে বিপদজাল
আপনি কাটি’ দেয় তাহা।
সভার লোকে শুনে অবাক্‌ মানে
সঘনে বলে বাহা বাহা!

কেবল বুড়া রাজা প্রতাপ রায়
কাঠের মত বসি আছে।
বরজলাল ছাড়া কাহারো গান
ভাল না লাগে তার কাছে।
বালকবেলা হ’তে তাহারি গীতে
দিল সে এতকাল যাপি’,
বাদল দিনে কত মেঘের গান,
হোলির দিনে কত কাফি!

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

 

গেয়েছে আগমনী শরৎপ্রাতে,
গেয়েছে বিজয়ার গান,
হৃদয় উছসিয়া অশ্রুজলে
ভাসিয়া গেছে দুনয়ান।
যখনি মিলিয়াছে বন্ধুজনে
সভার গৃহ গেছে পূরে,
গেয়েছে গোকুলের গোয়াল-গাথা
ভূপালী মূলতানী সুরে।
ঘরেতে বারবার এসেছে কত
বিবাহ-উৎসব রাতি,
পরেছে দাসদাসী লোহিত বাস
জ্বলেছে শত শত বাতি,
বসেছে নব বর সলাজ মুখে
পরিয়া মণি-আভরণ,
করিছে পরিহাস কানের কাছে
সমবয়সী প্রিয়জন,
সামনে বসি তার বরজলাল
ধরেছে সাহানার সুর;—
সে সব দিন আর সে সব গান
হৃদয়ে আছে পরিপূর।
সে ছাড়া কারো গান শুনিলে তাই
মর্ম্মে গিয়ে নাহি লাগে,
অতীত প্রাণ যেন মন্ত্রবলে
নিমেষে প্রাণে নাহি জাগে।

 

প্রতাপ রায় তাই দেখিছে শুধু
কাশির বৃথা মাথানাড়া,
সুরের পরে সুর ফিরিয়া যায়
হৃদয়ে নাহি পায় সাড়া।

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

থামিল গান যবে, ক্ষণেক তরে
বিরাম মাগে কাশিনাথ।
বরজলাল পানে প্রতাপ রায়
হাসিয়া করে আঁখিপাত।
কানের কাছে তার রাখিয়া মুখ,
কহিল, “ওস্তাদ জি,
গানের মত গান শুনায়ে দাও,
এবে কি গান বলে, ছি!
এ যেন পাখী লয়ে বিবিধ ছলে
শিকারী বিড়ালের খেলা!
সেকালে গান ছিল একালে হায়
গানের বড় অবহেলা!”বরজলাল বুড়া শুক্লকেশ
শুভ উষ্ণীষ শিরে,
বিনতি করি’ সবে, সভার মাঝে
আসন নিল ধীরে ধীরে।
শিরা-বাহির-করা শীর্ণ করে
তুলিয়া নিল তানপুব,

 

ধরিল নতশিরে নয়ন মুদি’
ইমনকল্যাণ সুর।
কাঁপিয়া ক্ষীণ স্বর মরিয়া যায়
বৃহৎ সভাগৃহকোণে,
ক্ষুদ্র পাখী যথা ঝড়ের মাঝে
উড়িতে নারে প্রাণপণে।
বসিয়া বামপাশে প্রতাপ রায়
দিতেছে শত উৎসাহ-
“আহাহা, বাহা বাহা!”-কহিছে কানে
“গলা ছাড়িয়া গান গাহ!”

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

সভার লোকে সবে অন্যমনা,
কেহ বা কানাকানি করে।
কেহ বা তোলে হাই, কেহ বা ঢোলে,
কেহ বা চলে’ যায় ঘরে।
“ওরে রে আয় লয়ে তামাকু পান”
ভৃত্যে ডাকি কেহ কয়।
সঘনে পাখা নাড়ি’ কেহ বা বলে
“গরম আজি অতিশয়।”
করিছে আনাগোনা ব্যস্ত লোক,
ক্ষণেক নাহি রহে চুপ;
নীরব ছিল সভা, ক্রমশ সেথা
শব্দ উঠে শতরূপ।

 

বুড়ার গান তাহে ডুবিয়া যায়,
তুফান মাঝে ক্ষীণ তরি;
কেবল দেখা যায় তানপুরায়
আঙ্গুল কাঁপে থরথরি।
হৃদয়ে যেথা হ’তে গানের সুর
উছসি উঠে নিজ সুখে
হেলার কলরব শিলার মত
চাপে সে উৎসের মুখে।
কোথায় গান আর কোথায় প্রাণ,
দু’দিকে ধায় দুইজনে,
তবুও রাখিবারে প্রভুর মান
বরজ গায় প্রাণপণে।

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
গানের এক পদ মনের ভ্রমে
হারায়ে গেল কি করিয়া!
আবার তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গাহে
লইতে চাহে শুধরিয়া।
আবার ভুলে’ যায়, পড়ে না মনে,
সরমে মস্তক নাড়ি’
আবার শুরু হতে ধরিল গান
আবার ভুলি দিল ছাড়ি’।
দ্বিগুণ থরথরি কাঁপিছে হাত,
স্মরণ করে গুরুদেবে।

 

কণ্ঠ কাঁপিতেছে কাতরে, যেন
বাতাসে দীপ নেবে-নেবে।
গানের পদ তবে ছাড়িয়া দিয়া
রাখিল সুরটুকু ধরি’,
সহসা হাহা রবে উঠিল কাঁদি
গাহিতে গিয়ে হা-হা করি’!
কোথায় দূরে গেল সুরের খেলা,
কোথায় তাল গেল ভাসি’,
গানের সুতা ছিঁড়ি’ পড়িল খসি’
অশ্রু-মুকুতার রাশি।
কোলের সখী তানপুরার পরে
রাখিল লজ্জিত মাথা,
ভুলিল শেখা গান, পড়িল মনে
বাল্য ক্রন্দন-গাথা।
নয়ন ছলছল প্রতাপ রায়
কর বুলায় তার দেহে।
“আইস, হেথা হ’তে আমরা যাই,”
কহিল সকরুণ স্নেহে।
শতেক দীপজ্বালা’ নয়ন-ভরা
ছাড়ি সে উৎসব ঘর
বাহিরে গেল দু’টি প্রাচীন সখা
ধরিয়া দুঁহু দোঁহা কর।

গানভঙ্গ কবিতা । Gaanvongo Kobita । সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

 

বরজ করযোড়ে কহিল, প্রভু,
মোদের সভা হ’ল ভঙ্গ।
এখন আসিয়াছে নূতন লোক
ধরায় নব নব রঙ্গ।
জগতে আমাদের বিজন সভা
কেবল তুমি আর আমি।
সেথায় আনিয়োনা নূতন শ্রোতা,
মিনতি তব পদে স্বামি!
একাকী গায়কের নহে ত গান,
মিলিতে হবে দুইজনে!
গাহিবে এক জন খুলিয়া গলা,
আরেক জন গাবে মনে!
তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ
তবে সে কলতান উঠে,
বাতাসে বন-সভা শিহরি’ কাঁপে
তবে সে মর্ম্মর ফুটে!
জগতে যেথা যত রয়েছে ধ্বনি
যুগল মিলিয়াছে আগে।
যেথানে প্রেম নাই বোবার সভা,
সেখানে গান নাহি জাগে।

আরও পড়ুনঃ

মন্তব্য করুন