আমার রবীন্দ্রনাথ – চন্দন সেন

আমার রবীন্দ্রনাথ [ চন্দন সেন ] ৯২০ সালে লেনিনের ও বলশেভিক পার্টির পরোক্ষ প্রেরণায় ভারতে কমিউনিস্ট ১৯২০ সালে লেনিনের ওঅবলাশেভিক পার্টির পরাবো ধারণের গতরিতে কমিউনিতর সর্বপ্রথম সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস। ১৯২১ ২২ সালে ভারতের প্রায় ৪০০ শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত হয়। আন্দোলন চলছে বাংলায় চটকলে শ্রমিকদের, আসামে চা বাগানে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিকদল এই আন্দোলনকে সমর্থন করছে। ১৮০০০ শ্রমিক আড়াই মাস সংগ্রাম চালায়। প্রায় ৩০০ ধর্মঘট সফল। ১৯২১-এ বিহারে কয়লাখনি শ্রমিকেরা পূর্ণ স্বাধীনতা চান। ১ মে, ১৯২৩–ভারতে প্রথম মে দিবস পালন করলেন মাদ্রাজে মৎস্যজীবীরা— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতে বসলেন— ‘রক্তকরবী’।

আমার রবীন্দ্রনাথ - বিশিষ্ট নাট্যকার চন্দন সেন
বিশিষ্ট নাট্যকার চন্দন সেন

লেখক চন্দন সেন বিশিষ্ট নাট্যকার ]

ইতিহাসের কাঁধে হাত রেখে এগোচ্ছেন আমাদের চিরায়ত কবি। ইদানীং বাংলা তথা ভারতের বুকে প্রতিনিয়ত ইতিহাসের অভিমুখ পালটানোর প্রয়াস চলছে। ফলে অনিবার্য সংঘাত সূচিত হচ্ছে। কেন্দ্রবিন্দু কখনও ওয়াশিংটন, কখনও জি-৯-এর নানা ছলাকলা। নিজেদের মরণোন্মুখ অসহায়তা থেকে বাঁচবার কৌশল, যাতে যোগ দিয়েছে ভারতীয় তল্পিবাহকের দল। সেই মুহূর্তে বারেবারে উচ্চারিত হচ্ছে রক্তকরবীর মোড়লের আতঙ্কিত সংলাপ :

“শিকল দিয়ে তো কষে বাঁধা গেল। খানিক বাদে দেখি কেমন করে পিছলে বেরিয়ে এসেছে ওর গায়ে কিছু চেপে ধরে না। আর ও কথায় কথায় সাজ বদল করে, চেহারা বদল করে। আশ্চর্য ওর ক্ষমতা। কিছুদিন ও এখানে থাকলে খোদাইকরগুলো পর্যন্ত বাঁধন মানবে না।”

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দন সেন
আমার রবীন্দ্রনাথ

মানবে না-ই তো! যতবার গম্বুকে ছিবড়ে করে ফেলা হচ্ছে, ততবারই গচ্ছু পালোয়ানের ঘুরে দাঁড়ানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা… জীবনে যেন একবার জোর পাই আর এক দিনের জন্যেও।…কেবল এই সর্দারটার ঘাড় মটকে দেওয়ার জন্য। সর্দারের বুকে যদি একবার দাঁত বসাতে পারি।… পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে অভুক্ত শ্রমিক, ঋণের জালে আত্মহত্যার মুখে পড়া কৃষকের দলে গন্জুর সংলাপ ফেরে বারবার।

রবীন্দ্র নাটক আমাদের বারবার টেনে আনে সমসাময়িকতার আয়নার সামনে। প্রতি ঘরে ঘরে যখন বিশুর স্ত্রীরা শুধুই “সর্দারের সোনার চূড়া” দেখে, আর প্রতিদিনে ১২-১৬ ঘণ্টা অতি পরিশ্রমে ধুঁকতে থাকা ক্লান্ত ফাগুলালের দল বারো ঘণ্টার পরে আরও চার ঘণ্টা যোগ করে খেটে মরে, তার কারণটা ফাগুও জানে না…। সোনার স্বপ্ন ভিতরে ভিতরে ওকে চাবুক মারে, সে চাবুক সর্দারের চাবুকের চেয়েও কড়া। চন্দ্রার এ অবস্থা থেকে মুক্তির আকুল আর্তির পরে অনিবার্য ফল ঘোষিত হয়— সর্দার কেবল যে ফেরার পথ বন্ধ করেছে তা নয়, ইচ্ছেটা শুদ্ধ আটকেছে। আজ যদি বা দেশে যাও টিকতে পারবে না, কালই সোনার নেশায় ছুটে ফিরে আসবে, আফিমখোর পাখি যেমন ছাড়া পেলেও খাঁচায় ফেরে।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দন সেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী

মননে দখল না নিয়ে শরীরের দখল নেওয়া যায় না। বাজার সভ্যতার অন্যতম প্রধান শর্ত চূড়ান্ত একনিষ্ঠ আত্মমগ্ন ভোগবাদিতা! না হলে তাঁর “মাল” বিক্রি হয় না। শ্রমশক্তি বিক্রয়ে বাধ্য করে তোলার মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে সে নিজেই বিশ্বাস করে এটাই মুক্তি —এটাই তার মদ! এটাই তার পরম। এটাই তার ছুটি। সর্বক্ষণ যেন — “সোনা সোনা করে প্রাণটা খাবি খায়!” মার্কস দেখিয়ে দেন একঘেয়েমি কাজের সময় বাড়ানো, শ্রমের প্রাবল্য শেষ পর্যন্ত শ্রমিকের ব্যক্তিসত্ত্বা লুপ্ত করতে থাকে।

আমার রবীন্দ্রনাথ - চন্দন সেন
আমার রবীন্দ্রনাথ

পুঁজিবাদের সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক শোষণে শ্রমিক তার মানবিক গুণগুলি হারাতে থাকে। তার মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হতে হতে সে কেবলই মুনাফাযন্ত্রের একটা যন্ত্রাংশে পরিণয় হয়। তার ব্যক্তিত্ব হারিয়ে সে কেবলই এক একটা সংখ্যা। রক্তকরবীর সেই ভয়ঙ্কর সংলাপ : তাল তাল সোনা তুলে আনছি, এক তালের পর দু’তাল, দু’তালের পর তিন তাল। যক্ষ্মপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার ঘেঁটে চলেছে, কোনও অর্থে পৌঁছোয় না। তাই ওদের কাছে, আমরা মানুষ নই, কেবল সংখ্যা।

কিন্তু বিশ্ব মানবাত্মার মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ জানতেন এ যক্ষপুরে রাজা-সর্দার গোঁসাই-মোড়লরা শেষ কথা বলবে না। রঞ্জন-বিশু-ফাগুরা শেষ বিচারে ওই ধ্বজদন্তের বন্দিশালা ভাঙবেই। ইতিহাস যে রঞ্জনের পক্ষে! সে মুক্তির দৌবারিক, বিদ্রোহী উল্লাসের কাব্যময় রূপ। আজ যখন ‘অধ্যাপক’ আর ‘গোঁসাইদের আমাদেরই চারপাশে দেখি—যাদের একপিঠে গোঁসাই আরেক পিঠে সর্দার। নামাবলিটা একটু ফেঁসে গেলেই সেটা ফাঁস হয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছিলাম, পৌর ভোটের প্রাক্কালে তেমনই ফেঁসে যাওয়া নামাবলীর এক কমেডি দেখলাম বটে!

‘রক্তকরবী’ নাটক নিয়ে বহুবার, বহুবিধ আলোচনা হয়েছে। অভিনয় চলছে চলবে। রবীন্দ্রনাথ এমন এক নাট্যকার যিনি নাট্যকারদের যুগ যুগ ধরে প্রয়োগের বিভিন্নতায় নিজেদের ঋদ্ধ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। রথের রশি, তাসের দেশ, ডাকঘর, অচলায়তন-এ যেন প্রতিমুহূর্তে স্মিত হাসি হেসে নাট্যক্রিয়ার সংঘাতকে সংস্কৃত করার আহ্বান জানান। সমসাময়িক, কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠার এক উদাত্ত আহ্বান। মুনাফাকামী সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের লড়াইয়ে তো বটেই, এমনকী আজ যাঁরা পরিবেশ রক্ষার কার্যকলাপে আন্দোলিত তাঁদেরও ডাক দেয় ‘রক্তকরবী’।

আরও দেখুন:

মন্তব্য করুন