আমার রবীন্দ্রনাথ – জয় গোস্বামী

আমার রবীন্দ্রনাথ [ জয় গোস্বামী ] রবীন্দ্রনাথকে কখন দরকার হয়? কার দরকার হয়? ধরো, আমারই হয়। এখন র যেমনা হয়েছে।ন এইরকার লেখার শর্ড করকাড়েছে। বাবা আমারই হয়। এখন কোনও প্রসঙ্গে লিখতে গেলেও দেখা গেল, একটু রবীন্দ্রনাথ খুঁজে আনলাম। উনি সব প্রসঙ্গেই কিছু না কিছু বলে গিয়েছেন। যার মধ্যেই হোক একটু রবীন্দ্রনাথ দিতে পারলে ভালো। তোমারও দরকার হয় রবীন্দ্রনাথকে। ক্লাসে পড়াতে হবে। আরও পাঁচজনের বই ঘেঁটে তৈরি করলে নিজেকে।

কবি জয় গোস্বামী [ Poet Joy Goswami ]
কবি জয় গোস্বামী [ Poet Joy Goswami ]
স্টুডেন্টদের সামনে বললে। তোমার স্টুডেন্টদেরও দরকার হয় তাকে। তাদের প্রশ্ন আসবে পরীক্ষায়। তারা তোমার কাছে থেকে জানতে পারছে কীভাবে অনেক আলাদা রকমের মানুষ—না মানুষ না, ভুল বললাম—অনেক ভিন্ন দৃষ্টির লেখক কবি প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণকে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে হয়, দেখতে দেখতে তাকে পড়তে হয়। এবার এরাও ভবিষ্যতে তোমার কাছ বা তোমার সহকর্মীর কাছে পিএইচডি করবে। তখন তাদের আরও বেশি বেশি দরকার হবে রবীন্দ্রনাথকে। এর মধ্যে এসে পড়ল সার্ধশতবর্ষ, তুমি বললে আমাদের কলেজে এসে একটু বলবেন ছাত্রছাত্রীদের?

আমি বিনয় করলাম, আমি কী আর বলব, কতটুকু জানি! তুমি জোরাজুরি করলে। আমি যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হব-হব করছি হঠাৎ তোমাদের পার্টি থেকে আমার আসা আটকে দিল। তোমার কিছু করার রইল না। চাকরি করো বেচারি, কী আর প্রতিকার করবে। তোমার মন খারাপ। আমি ক্রুদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্টিকল লিখলাম। এই শাসক, ক্ষমতার অপব্যবহার, দাস কাদের বলে। এই সব! আর এইটা লিখতে গিয়েও আমি ব্যবহার করলাম গোকুল খোদাইকর-কে বলা নন্দিনীর উক্তি।

গোকুল বলে বসেছিল, সে নাকি সর্দারকে শ্রদ্ধা করে। নন্দিনীর উত্তর : ‘শ্রদ্ধা? দাসের আবার শ্রদ্ধা? পায়ের তলাটাকে পায়ের কাদার যেমন শ্রদ্ধা। বেশ একহাত নেওয়া হয়ে গেল আমার। এবং এই একহাত নিতে আমার দরকার হল। রবীন্দ্রনাথকে। কয়েকজন বলল, যা একখানা দিয়েছেন না! আমি কোথাও বিগলিত, কোথাও ছদ্মগম্ভীর।

এইবার রাজনীতির জগতের দিকে তাকালেও দেখবে অবিরল এইসব তর্কে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথকে দরকার সবার। কেন? ও, তুই এটা বলেছিস। দাঁড়া, আমি ওটা বলব। রবিঠাকুর কারও একার নয়। সেই যে কথায় বলে, ওরে, মা কি কারও একার!

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আপনি থিয়েটার করেন! তার দুটো নাটক বিভিন্ন সময়ে প্রযোজনা করেছেন! কী মনে হয়েছিল, কেন করেছিলেন? এই সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে যদি জানান আমাদের। আপনি যথাসম্ভব জানালেন। কিন্তু আপনার পাশেই বসে জানানো হল, এই যে আপনার গ্রুপের এগারোটা প্রোডাকশনের মধ্যে একটাও রবীন্দ্রনাটক নেই? কেন নেই? কেন করেননি? একটু যদি বলেন। তিনিও যথাসাধ্য বললেন। সবাই বাড়ি চলে গেলেন।

আমিও টিভি ছেড়ে উঠে, আপনাদের দুজনকেই ফোন করতে লাগলাম। যাকে আগে পেলাম তাকে আগে বললাম, যাকে পরে পেলাম তাকে পরে বললাম। কী বললাম? একই কথা : দুর্দান্ত বলেছেন। সত্যিই আপনারা দুজনেই ভালো বলেছেন। দুরকমভাবে। একইভাবে যিনি আবৃত্তি করেন, যিনি রবীন্দ্রনাথের গান করেন, যিনি রবীন্দ্র নামাঙ্কিত কোনও সংস্থা চালান তাঁরা সকলেই কিছু কিছু বলবেন। এখন। এই সার্ধশতবর্ষে বিশেষত। যেমন, দু-দশটা কবিতা লিখেছি বলে, এই মুহূর্তে আমিও বলছি। তেমনি।

কিন্তু আপনিও জানেন না, আমিও জানি না, ও মেয়েটি, তুমিও জানো না, আমরা কেউ বাড়ি গিয়ে, একলা ঘরে বা বাড়ি থেকে বেরিয়ে, ছুটির বেড়ানোর ট্রেন-জানলায় বসে, একপাতা রবীন্দ্রনাথকেও দরকারি মনে করছি কি না। পড়ছি কি না। ভাবছি কি না। আপনিও জানেন না। আমিও না। কী ভাবছেন? আপনাকে অবিশ্বাস করছি! ভাবছি আপনি টিভিতে গুছিয়ে সুন্দর করে মিথ্যে বলেছেন? ভাবছি, চালাকি করলেন? তা হলে মিথ্যেবাদী ভাবছি আপনাকে?

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

ভাবছি না কিন্তু! আসলে কী ভাবছি জানেন? ভাবছি আমার নিজের কথা! ভাবছি, কোথাও বলতে হবে, কোথাও পড়াতে হবে, কোথাও বিশেষ সংখ্যায় লিখতে হবে, কোনওদিন টিভিতে জানাতে হবে, এমনকী, কোনও গোপন রাগ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কাউকে টাইট দিতে হবে লেখায় কিংবা কমেন্ট-এ কিংবা ভাষণে আমার চারপাশে তাকিয়ে দেখছি—কেবল এই এই কারণগুলোতে প্রধানত রবীন্দ্রনাথকে দরকার হচ্ছে আমার। অর্থাৎ সেই কারণগুলো, যার দ্বারা, এই সার্ধশতবর্ষের আলোতে আমার মুখও দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মুখ ওপরে—তলায় আমার মুখ। আমি কতটা এ বিষয়ে জানি। আমার সেই জ্ঞানমুখ।

আমার অনেক অনেক মুখ। দর্শক, শ্রোতা, পাঠকের আসনেও আছে আমার একটা মুখ। একসহস্র মুখ। এইখানে, সেই পাঠক, সেই শ্রোতা উঠে এসে বলবে, এ কথা বলছেন কেন? আমার নিজেরও তো একজন রবীন্দ্রনাথ আছেন। নন্দিনীর ওই যে কথাটা আপনি এক্ষুনি বললেন : দাসের আবার শ্রদ্ধা? পায়ের তলাটাকে পায়ের তলার কাদার যে শ্রদ্ধা—সেটা কি আমি আমার কর্মস্থলে দেখি না? কী কর্মস্থল আপনার? কর্পোরেট হাউস—আই টি সেক্টরে আমার অফিস।

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

আর একজন দর্শক উঠে দাঁড়ালেন : আমিও দেখেছি। কখনও বলিনি। কিন্তু নন্দিনীর এই কথা কত সত্যি! বস-কে শ্রদ্ধার নামে, যা দেখানো হয় তা শ্রদ্ধা নয়। প্রোমোশন পাওয়ার লোভ থেকে জন্মানো চাটুকারিতা ছাড়া তা আর কিছু নয়। আর একজন উঠলেন। আমিও দেখেছি। আপনি কোথায় কাজ করেন। হাসপাতালে। আপনি? কলেজে। আপনি? সরকারি অফিসে। আপনি? আপনি? আপনি?… এঁরা সবাই দেখেছেন এই দাসচক্র। কিন্তু ‘রক্তকরবী’ সবাই দ্যাখেননি।

পড়েনওনি। আমি পড়েছি। একজন বলে। একজন। এই একজন। মাত্র একজন।

এই একজনকে কোথাও বলতে হয় না রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। এই একজন ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ পড়েনি, কারণ তার বিষয় হল পদার্থবিদ্যা। এই একজনের কোনও বন্ধু, সঙ্গী, স্বামী বা শিক্ষক—কেউই রবীন্দ্রনাথ পড়েন না। আলোচনাও করেন না। এই একজন তবু কী করে পড়ল।

জিগ্যেস করেছিলাম, কেন পড়েন রবীন্দ্রনাথ? প্রথমে চুপ করে থাকলেও শেষে বলেছিল সেই তরুণী, রবীন্দ্রনাথ আমার ডিফেন্স মিনিস্টার। পড়ি, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

ও, তার মানে প্রত্যাঘাতের প্রয়োজনে?

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

না। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

প্রত্যাঘাত না করে আত্মরক্ষা করেন কী করে? করি। নিজেকে সরিয়ে নিই। দাসচক্রের সঙ্গে জড়াই না। নিজেকে কন্ট্রোল করাটা রবিঠাকুর পড়লে শিখতে পারি। মানে স্ট্রেংথটা..পাই…। এর বেশি বলেনি মেয়েটি। নিজের পেশায় প্রতিষ্ঠিত, নিজের কাজটাকেই সে মন দিয়ে করে চলে। যার সঙ্গে অন্যের সেবা জড়িয়ে আছে।

আমি এর মতো পাঠক হতে চেষ্টা করি। যেহেতু আমার চেয়ে ২১ বছরের ছোট, এবং আমার লেখা কাগজপত্রে ছাপা হয়, তাই আমার সামনে এ ধরনের মানুষরা মুখ খুলতে চায় না কিছুতেই। আমি কী বলব আপনাদের মতো মানুষকে। তাকে তো আমি বলতে পারছি না, তুমি কেন পড়ো রবীন্দ্রনাথকে, সেটা আমার জানা দরকার। বলতে পারছি না, আমার, ‘আজন্মকালের ভিক্ষাঝুলি/চরিতার্থ হবে যদি তুমি বলো।

একজন মহিলাকে দেখেছিলাম। স্কুলে পড়ান। মোটেই বাংলা পড়ান না। উঁচু ক্লাসে অঙ্ক করান। সেই বছর রিটায়ার করবেন। অর্থাৎ ষাট বছরে ঢুকে পড়েছেন। আমার তখন ২৮। পান সাজতেন, ‘খাবি কি না’ বলতেন। হ্যাঁ বললাম, আর পান সাজতে সাজতে বললেন তুই তো লিখিসটিখিস। এই কবিতাটা জানিস? বলে গেলেন কয়েকটা লাইন। পরে খুঁজে পেয়েছি সেটা। এখানে দিচ্ছি :

দিন হয়ে গেল গত।

শুনিতেছি বসে নীরব আঁধারে আঘাত করিছে হৃদয় দুয়ারে দূর প্রভাতের ঘরে ফিরে আসা পথিক দুরাশা যত।

আমি তখন নতুন আঁতেল। এটা কোথায় পেলে? সঞ্চয়িতা-য়।

আমি বলি, তুমি তো সব ডিটেকটিভ বই পড়ো দেখি। যত আগাথা ক্রিস্টির স্তূপ তোমার ঘরে। কোনান ডয়েল, পেরি ম্যাসন—এর মধ্যে কবিতা কোত্থেকে ঢুকল।

তিনি বললেন, পড়ি রে। সঞ্চয়িতাখানা পড়ি। ওটাই তো সঙ্গী। ছিঁড়ে গিয়েছিল। ভোলার দোকান থেকে বাঁধিয়ে দিয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম শঙ্খ ঘোষের ‘এ আমির আবরণ’ পড়েছ? সে আবার কী বই রে!

ও কী! জানো না! ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’, তারপর আবু সয়ীদ আইয়ুবের

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’। পড়েছ এগুলো? তিনি একটা পান মুখে দিয়ে আমার হাতে অন্যটা ধরাতে ধরাতে বললেন, না রে। এসব বইয়ের কথা আমি জানি না। তোর বেলু মাসি জানে। ও তো কলেজে পড়াত, এই রিটায়ার করল। ভারী ভারী বই পড়ে খুব। আমি প্রতিবাদ করি। মোটেই ভারী বই না। খুব নামকরা বই এসব। আমার আছে। এনে দেবখন তৌমাকে। উনি বললেন, না রে, থাক। রবিঠাকুর পড়েই আমার চলে যায়। রবিঠাকুরের লেখার ওপর অন্যের লেখা? সে সব কী আর বুঝব। একটা বই ই বুঝি। ‘সঞ্চয়িতা’। সেটা আছে আমার। আরও দু-একটা টুকরো বই, কবিতার। আর হ্যাঁ, অন্যের লেখা একটা বইও আছে—মংপুতে রবীন্দ্রনাথ। পড়ি তো!

আমরা একটা বারান্দায় বসেছিলাম। সন্ধে নেমে আসছে। অনেক পাখি ফেরা গাছ। বারান্দার সামনে একটা সরু রাস্তা চলে গিয়েছে, পায়ে চলা রাস্তা। বিরাট মাঠের ধারে বাড়ি। কবিতাটা আবার বললেন। আমার যথারীতি এমন কিছু লাগল না লেখাটা। উনি বললেন, লোকে কেমন বাড়ি ফিরছে দেখছিস হাতে ঝোলা নিয়ে। সারাদিন পরে, শহরে যাওয়া চাষিরা ফিরছে। ওইরকম আমার সমস্ত আশাগুলো আমার ঘরে ফিরে আসছে। কিন্তু আর হল না আমার। ঘরে ফিরে আসছে মানে?

মানে, আমার নিজের কাছেই ফিরে আসছে। দুরাশা হয়ে। ওই যে লোকগুলোকে দেখছিস, খেয়া ধরতে যাচ্ছে, ওদের যেমন মাঠের শেষে ঝাপসা দেখাচ্ছে—আমিও তেমনই আমার আশাগুলোকেও ঝাপসা দেখছি। তাই ওরা দুরাশা এখন। মানে কীরকম জানিস তো–

বইল বাতাস

পাল তবু না জোটে—

ঘাটের ষাণে

নৌকো মাথা কোটে।

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

এটা আবার কার। কেন, রবিঠাকুরের! ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামে একটা বই আছে না ওঁর? ছোট্ট ছোট্ট কবিতা সব । বেলুর কাছ থেকে এনেছিলাম। আমি তো আর বেশি কিছু পড়িনি। মেয়েদের অঙ্ক খাতা দেখতে দেখতেই সময় কেটে গেল। আমার সারাজীবনটা হল ওই। বইল বাতাস/ পাল তবু না জোটে। যা, ওই মাঠটা পেরিয়ে চূর্ণির ধারে যা। দেখবি এরকম নৌকোও আছে যারা ঘাটেই শুধু মাথা ঠুকে যাচ্ছে। নদীতে আর ভেসে যেতে পারছে না সে। ওই নৌকোটা আমি।

বুঝলি তো। চা খাবি?

খাব। ‘জনতা’য় কোরো না। কেরোসিনের গন্ধ হবে। ওরে না। ধোঁয়া দেখছিলি না? হরেনের মা তোলা উনুনটা জ্বালিয়ে উঠোনে নামিয়ে দিয়েছে তো।

চা বানাতে বানাতে বললেন, দ্যাখ, অত বড় একটা মানুষ। যাঁকে লোকে গুরুদেব বলত। বিশ্বকবি বলত। সারা দেশের লোক মানত। তাঁরও তা হলে দেখলি, আমারই মতো মনের অবস্থা হয়েছিল, কখনও কখনও। নইলে লিখলেন কী করে বল! তাঁরও তা হলে আমার মতোই আশাগুলো ফিরে এসেছিল। ওই যে বলেছেন, অকৃতাৰ্থ হে অতীত! পশ্চাতের নিত্যসহচর! কী বলছেন? না, অকৃতার্থ অতীত। ওঁর মতো লোকের অতীত কখনও অকৃতার্থ হতে পারে, বল? অতৃপ্ত তৃষ্ণার যত ছায়ামূর্তি প্রেমভূমি হতে নিয়েছ আমার সঙ্গ। এই যে সন্ধের পর সন্ধে বসে থাকি বারান্দায়, পড়া ডিটেকটিভ বইগুলো আবার পড়ে শেষ হয়ে যায়।

তারপর?

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

তারপর বসে থাকি। তখন পশ্চাতের নিত্যসহচর কে আমার? অকৃতাৰ্থ অতীত। তার মানে, ওইরকম বিরাট একটা লোক হলেও আমার কথাটা বুঝলেন। তাই তো? ওঁরও নিশ্চয়ই এরকমই মনে হত। নইলে আমার সঙ্গে মিলল কী করে।

আমার চা খাওয়া শেষ। উনি বলছেন : ধর, নিজের কথাই তো বলেছেন নিশ্চয়ই এই যে, শুষ্কপত্র জীর্ণপুষ্প সঙ্গে পথচিহ্নহীন শূন্যে যাব উড়ে? ওঁর মতো অত বড় মানুষটা কিনা এও ভাবছেন, শুকনো পাতা, মরা ফুলের সঙ্গে এলোমেলো উড়ে যাব!

এটা কোন কবিতা?

কেন, ওই যে, যাওয়ার সময় হল বিহঙ্গের। এখনই কুলায় রিক্ত হবে!

ওইটা। সঞ্চয়িতার কবিতা। আমি অতটা সেয়ানা হইনি তখনও। তা হলে বলতাম, না। ওটা সঞ্চয়িতার কবিতা নয়। ‘প্রান্তিক’-এর কবিতা। ভাগ্যিস বলিনি।

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

কারণ, উনি তখন বলছেন, দ্যাখ, দ্যাখ, এটাও তো আমার কথা। ডিসেম্বরে রিটায়ার করে দেশের বাড়ি চলে যাব। কেউ মনে করবে না। তা নিয়ে চিন্তাও করব না। একজন লোক তো বুঝেছে, বল।

আজ মনে হয়, সিন্ধুমাসি, সিন্ধুরানি চৌধুরী, নিজের মনে মনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি করেছিলেন। যে যোগাযোগ তাঁর একাকী জীবনযাপনকে শক্তি দিত। বেঁচে থাকার শক্তি। কোনও আশা পূর্ণ হবে না, জেনেও, ভেঙে না পড়ার শক্তি জোগাত। কীরকম শক্তি সেটা আমরা ঠিক বুঝতে পারব না হয়তো। আমি আপনি রবীন্দ্রনাথ পড়লাম। আর সেই পড়া প্রচারিত হল, কোনও না-কোনওভাবে। চাকরিজীবনে, পরীক্ষার খাতায় ছাত্র পড়াতে, বক্তৃতা দিতে, আবৃত্তি করতে, প্রবন্ধ লিখতে দরকার হল রবীন্দ্রনাথকে।

কিন্তু সিন্ধুমাসির দরকার একেবারে নিজের জন্য। একেবারে একান্ত দরকার। সিন্ধুমাসি ভাইবোনদের মানুষ করেছিলেন। তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল যে যার মতো। সিন্ধুমাসি একলাই ছিলেন। নিজের সংসার করার সুযোগ পাননি। কেউ এসেছিল নিশ্চয়ই জীবনে। কেউ কেউ। এসেছিল শুনেছি। তবু হয়ে ওঠেনি নানা সাংসারিক বাধায়। পরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান।

আমার রবীন্দ্রনাথ - জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথ

সেদিন, সিন্ধুমাসির বেদনাটা বুঝলেও, এই কবিতাগুলোকে আহামরি মনে হয়নি, সত্যিই। এখন, বিস্মিত হয়ে দেখি, সেদিন আমার আটাশ বছর বয়সে শোনা সিন্ধুমাসির কথাগুলো, আজ আমার কথা হয়ে উঠেছে। আমার ৫৬ বছর বয়সে আমিও আমার অনেক আশা যখন ঘরে ফিরে আসছে, তাদের চিনতে পারছি না আর। এত ক্লান্ত, হতমান, দারিদ্রলাঞ্ছিত সেই সব আশা, যে, তাদের দুরাশার মতো দেখাচ্ছে। আমার নৌকাও ঘাটের ষাণে (পাষাণে) মাথা ঠুকছে। পাল খাটানোর সময় সামর্থ্য সহযোগী কিছুই নেই তার।

আজ মনে হয় কেন সিন্ধুমাসি বা সিন্ধুমাসির মতো, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অশিক্ষিত কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে প্রাণের দায়ে প্রয়োজনীয় বলে স্বীকার করে নেওয়া মানুষের মনের সান্নিধ্যে ঢুকে সন্ধান করিনি? কেন বুঝিনি, অনেক সাধারণ জীবনের মধ্যেও রবীন্দ্র কবিতার অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে? সেই জীবনগুলোকে খুঁজে খুঁজে দেখাও যে দরকার ছিল আমার। শুধু রবীন্দ্র-বিষয়ক বই পড়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথকে খোঁজার পথটাই কেন আমার পথ হয়ে পড়ল! রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আমি কী বুঝি, আমি কী জানি তা বলাটাই, বলে বেড়ানোটাই, লিখে দেখানোটাই কেন বেছে নিলাম!

সিন্ধুমাসির সঙ্গে কাটানো সেই আটাশ বছর আগের কয়েকটা বিকেল-সন্ধে আমাকে আরও একটা জরুরি কথা বলে, এই জীবনপ্রান্তে এসে। কী বলে? বলে, স্পেশালিস্টরা অ্যাপ্রুভ না করলেও, এক্সপার্টরা পাসমার্ক না দিলেও কোনও কোনও কবিতা বেঁচে থাকতে পারে। একেবারেই নগণ্য, সামান্য কোনও জীবনযাপনকারীর মনে। শুধু ভালোবাসা ছাড়া কোনও যোগ্যতাই নাই যে দীনের’, তার কাছে, তাদের কাছে বাঁচতে পারে। আর যে মানুষ লেখে, তার কাছেই এই তথ্যটা একটা বিরাট শক্তি।

তবে মনে রাখা দরকার, সে কবিতা বাঁচতে পারে, কিন্তু বেঁচে যে আছে,

তার প্রমাণ বা প্রচার থাকবে না কোথাও। জনসমক্ষে তার চিহ্ন থাকবে না তেমন। সে কবিতা শুধু বেঁচে থাকবে তার কাছে, যার কবিতাকে দরকার—যার রবীন্দ্রনাথকে দরকার। অন্যকে জানানোর জন্য দরকার নয়। নিজের বেঁচে থাকাটাকে সয়ে নেওয়ার জন্য, জীবন থেকে পাওয়া নানারকম চোট, জখম, মার। সহ্য করতে করতে, জীবনেরই পথ চলার জন্য দরকার। কে জানে, হয়তো রবীন্দ্রনাথকে আসল দরকার তাদেরই। তাদের সেই রবীন্দ্রনাথকে নিজের মধ্যে নিতে পারতাম যদি।

 

 

[ আমার রবীন্দ্রনাথ – জয় গোস্বামী ]

বিশিষ্ট কবি জয় গোস্বামী

আরও পড়ুন:

মন্তব্য করুন