বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “পুত্রপুট“কাব্যের অন্তর্গত। পত্রপুট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১৩৪৩ (১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট আঠারোটি কবিতা রয়েছে। পত্রপুট রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার অন্ত্যপর্বের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

বসেছি অপরাহ্ণে পারের খেয়াঘাটে
শেষ ধাপের কাছটাতে।
কালো জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পা ডুবিয়ে দিয়ে।
জীবনের পরিত্যক্ত ভোজের ক্ষেত্র প’ড়ে আছে পিছন দিকে
অনেক দিনের ছড়ানো উচ্ছিষ্ট নিয়ে।
মনে পড়ছে ভোগের আয়োজনে
ফাঁক পড়েছে বারংবার।
কতদিন যখন মূল্য ছিল হাতে
হাট জমেনি তখনো,
বোঝাই নৌকো লাগল যখন ডাঙায়
তখন ঘণ্টা গিয়েছে বেজে,
ফুরিয়েছে বেচাকেনার প্রহর।

অকাল বসন্তে জেগেছিল ভোরের কোকিল;
সেদিন তার চড়িয়েছি সেতারে,
গানে বসিয়েছি সুর।
যাকে শোনাব তার চুল যখন হোলো বাঁধা,
বুকে উঠল জাফ্‌রানি রঙের আঁচল
তখন ঝিকিমিকি বেলা,
করুণ ক্লান্তি লেগেছে মূলতানে।
ক্রমে ধূসর আলোর উপরে কালো মরচে পড়ে এল।

থেমে-যাওয়া গানখানি নিভে-যাওয়া প্রদীপের ভেলার মতো
ডুবল বুঝি কোন্ একজনের মনের তলায়,
উঠল বুঝি তার দীর্ঘনিশ্বাস,
কিন্তু জ্বালানো হোলো না আলো॥

The rain has held back for days and days | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

এ নিয়ে আজ নালিশ নেই আমার।
বিরহের কালো গুহা ক্ষুধিত গহ্বর থেকে
ঢেলে দিয়েছে ক্ষুভিত সুরের ঝরনা রাত্রিদিন।
সাত রঙের ছটা খেলেছে তার নাচের উড়নিতে
সারাদিনের সূর্যালোকে,
নিশীথরাত্রের জপমন্ত্র ছন্দ পেয়েছে
তার তিমিরপুঞ্জ কলোচ্ছল ধারায়।
আমার তপ্ত মধ্যাহ্নের শূন্যতা থেকে উচ্ছ্বসিত
গৌড়-সারঙের আলাপ।
আজ বঞ্চিত জীবনকে বলি সার্থক,
নিঃশেষ হয়ে এল তার দুঃখের সঞ্চয়
মৃত্যুর অর্ঘ্যপাত্রে,
তার দক্ষিণা রয়ে গেল কালের বেদীপ্রান্তে।

জীবনের পথে মানুষ যাত্রা করে
নিজেকে খুঁজে পাবার জন্যে।
গান যে-মানুষ গায়, দিয়েছে সে ধরা, আমার অন্তরে;
যে মানুষ দেয় প্রাণ, দেখা মেলেনি তার।
দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ
ছায়ায় পরিকীর্ণ,
যেন পাহাড়তলীতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর।

The rain has held back for days and days | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

তীরের গাছ থেকে
সেখানে বসন্ত-শেষের ফুল পড়ে ঝরে,
ছেলেরা ভাসায় খেলার নৌকো,
কলস ভরে নেয় তরুণীরা
বুদ্বুদ ফেনিল গর্গরধ্বনিতে।
নব বর্ষার গম্ভীর বিরাট শ্যামমহিমা
তার বক্ষতলে পায় লীলাচঞ্চল দোসরটিকে।
কালবৈশাখী হঠাৎ মারে পাখার ঝাপট,
স্থির জলে আনে অশান্তির উন্মন্থন,
অধৈর্যের আঘাত হানে তটবেষ্টনের স্থাবরতায়,
বুঝি তার মনে হয়
গিরিশিখরের পাগলা-ঝোরা পোষ মেনেছে
গিরিপদতলের বোবা জলরাশিতে।
বন্দী ভুলেছে আপনার উদ্বেলকে উদ্দামকে।
পাথর ডিঙিয়ে আপন সীমানা চুর্ণ করতে করতে
নিরুদ্দেশের পথে
অজানার সংঘাতে বাঁকে বাঁকে
গর্জিত করল না সে আপন অবরুদ্ধ বাণী,
আবর্তে আবর্তে উৎক্ষিপ্ত করল না
অন্তর্গূঢ়কে।
মৃত্যুর গ্রন্থি থেকে ছিনিয়ে ছিনিয়ে
যে উদ্ধার করে জীবনকে
সেই রুদ্র মানবের আত্মপরিচয়ে বঞ্চিত
ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি
অপরিস্ফুটতার অসম্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে।

Thought that my voyage had come to its end | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

দুর্গম ভীষণের ওপারে
অন্ধকারে অপেক্ষা করছে জ্ঞানের বরদাত্রী;
মানবের অভ্রভেদী বন্ধনশালা
তুলেছে কালো পাথরে গাঁথা উদ্ধত চূড়া
সূর্যোদয়ের পথে;
বহু শতাব্দীর ব্যথিত ক্ষত মুষ্টি
রক্তলাঞ্ছিত বিদ্রোহের ছাপ
লেপে দিয়ে যায় তার দ্বারফলকে;
ইতিহাস-বিধাতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ
দৈত্যের লৌহদুর্গে প্রচ্ছন্ন;
আকাশে দেবসেনাপতির কণ্ঠ শোনা যায়—
এসো মৃত্যুবিজয়ী;
বাজ্‌ল ভেরী,
তবু জাগ্‌ল না রণদুর্মদ
এই নিরাপদ নিশ্চেষ্ট জীবনে;
ব্যুহ ভেদ ক’রে
স্থান নিইনি যুধ্যমান দেবলোকের সংগ্রাম-সহকারিতায়।
কেবল স্বপ্নে শুনেছি ডমরুর গুরুগুরু,
কেবল সমরযাত্রীর পদপাতকম্পন
মিলেছে হৃৎস্পন্দনে বাহিরের পথ থেকে।
যুগে যুগে যে মানুষের সৃষ্টি প্রলয়ের ক্ষেত্রে,
সেই শ্মশানচারী ভৈরবের পরিচয়জ্যোতি
ম্লান হয়ে রইল আমার সত্তায়,

শুধু রেখে গেলেম নতমস্তকের প্রণাম
মানবের হৃদয়াসীন সেই বীরের উদ্দেশে,
মর্ত্যের অমরাবতী যাঁর সৃষ্টি
মৃত্যুর মূল্যে, দুঃখের দীপ্তিতে॥

১লা বৈশাখ, ১৩৪৩

 

Amar Rabindranath Logo

আরও দেখুন:

মন্তব্য করুন