Site icon Amar Rabindranath [ আমার রবীন্দ্রনাথ ] GOLN

ভগ্নহৃদয় অষ্টম সর্গ bhagno hriday ostom sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভগ্নহৃদয় অষ্টম সর্গ bhagno hriday ostom sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাব্যগ্রন্থ : ভগ্নহৃদয়

কবিতার শিরোনামঃ ভগ্নহৃদয় অষ্টম সর্গ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভগ্নহৃদয় অষ্টম সর্গ bhagno hriday ostom sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মুরলা ও চপলা
চপলা।
          দেখ্‌, সখি মোর, সত্য কহি তোরে
      প্রাণে বড় ব্যথা বাজে–
চপলার কেহ সখী নাই  হেথা
      এত বালিকার মাঝে!
তোদের ও মুখ হেরিলে মলিন
      হৃদয় কাঁদিয়া উঠে,
আকুল হইয়া শুধাবার তরে
      তাড়াতাড়ি আসি ছুটে।
শতবার করে শুধাই তোদের,
      কথা না কহিস্‌ তবু–
ভাবিস চপলা অবোধ বালিকা
      কিছু সে বুঝে না কভু!
চোখের জলের কাহিনী বুঝে না,
      বুঝে না সে ভালবাসা,
পড়িতে পারে না প্রাণের লিখন
      দুখের সুখের ভাষা!
ভাল, সখি, ভাল, নাইবা বুঝিল
      তাহাতে কি যায় আসে?
চপলা কি শুধু হাসিতেই জানে,
      কাঁদিতে কি জানে না সে?
মুরলা আমার, তোরে আমি এত
      ভালবাসি প্রাণ ভ’রে–
তবু একদিন তোর তরে, সখি,
      কাঁদিতে দিবি নে মোরে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মুরলা।
           চপলাটি মোর, হাসিরাশি মোর,
      আমার প্রাণের সখি!
নিজের হৃদয় নিজেই বুঝি না,
      অপরে তা বুঝাব কি?
যাহাদের সুখে আমি সুখে রই
      সকলেই সুখী তারা–
তবে কেন আমি একেলা বসিয়া
      ফেলি এ নয়নধারা?
সকলেই যদি সুখে থাকে, সখি,
      আমি থাকিব না কেন?
প্রমোদ তেয়াগি বিজনে আসিয়া
      কেন বা কাঁদিব হেন?
নিজের মনেরে বুঝানু কতই,
      কিছুই না পেনু সাড়া–
মুরলার কথা শুধাস্‌ নে আর,
      মুরলা জগত-ছাড়া!
চপলা।
          এত দিনে দেখি কবির অধরে
      হরষকিরণ জ্বলে–
যেন আঁখি তার ডুবিয়া গিয়াছে
      সুখের স্বপনতলে!
জোছনা উদিলে কুসুমকাননে
      একেলা ভ্রমিয়া ফিরে,
ভাবে-মাতোয়ারা আপনার মনে
      গান গাহে ধীরে ধীরে।
নয়নে অধরে মলয়-আকুল
      বসন্ত বিরাজ করে,
মধুর অথচ উদাস হরষ
      ঘুমায় মুখের ‘পরে!
হেন ভাব কেন হেরি লো তাহার
      শুধাইব তোর কাছে।
   বড়ই সে সুখে আছে।
মুরলা।
           চপলা, সখি লো, দেখেছিস তারে?
      বড় কি সে সুখে আছে?
কেমন বুঝিলি বল্‌ তাহা বল্‌
      বল্‌ সখি মোর কাছে!
      বড় কি সে সুখে আছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চপলা।
           হাঁ লো, সখি, হাঁ, লো– শোন্‌ বলি তোরে–
      আয়, সখি, মোর পাশে–
কবি আমাদের নলিনীবালারে
      মনে মনে ভালবাসে।
সত্য কহি তোরে, নলিনীরে বড়
      ভাল নাহি লাগে মোর–
শুনিয়াছি নাকি পাষাণ হতেও
      মন তার সুকঠোর!
মুরলা।
          সে কি কথা বালা!   মুখখানি তার
      নহে কি মধুর অতি?
নয়নে কি তার দিবস রজনী
      খেলে না মধুর জ্যোতি?
চপলা।
          শুনেছি সে জ্যোতি আলেয়ার চেয়ে
      কপট, চপল নাকি–
পথিকের পথ ভুলাবারি তরে
      জ্বলি উঠে থাকি থাকি!
শুনেছি সে বালা সারাটি জীবন
      চড়িয়া পাষাণরথে
চাকায় দলিয়া চলিবারে চায়
      হৃদয়বিছানো পথে!
শুনেছি সে নাকি একটি একটি
      হৃদয় গণিয়া রাখে–
কি কুখনে, আহা, কবি আমাদের
      ভাল বাসিয়াছে তাকে!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মুরলা।
           চপলা, চপলা, পায়ে ধরি তোর,
      ক’স্‌ নে অমন করে।
তুই লো বালিকা হৃদয় তাহার
      চিনিবি কেমন করে?
চপলা।
          কে জানে, সজনি, বুঝিতে পারি নে
      কেন যে হইল হেন–
তাহারে হেরিলে মুখ ফিরাইতে
      সাধ যায় মোর যেন?
সেদিন যখন দেখিনু নলিনী
      বসিয়া কবির-সাথে,
সরমের বেশে লাজহীন হাসি
      খেলিছে আঁখির পাতে,
দেখিনু কপোল ঢাকিয়া তাহার
      অলক পড়েছে ঝুলি,
আঁচলেতে গাঁঠ বাঁধি শতবার
      শতবার ফেলে খুলি,
কে জানে আমার ভাল না লাগিল
      চলে এনু ত্বরা করে–
কপট সরম দেখিলে, সজনি,
      সরমেতে যাই ম’রে!
মুরলা আমার, অমন করিয়া
      কেন লো রহিলি বসি!
দেখিতে দেখিতে মলিন হইয়া
      এসেছে ও মুখশশী!
ভাবিস্‌ নে, সখি, কমলা কয়েছে
      কাল মোর কাছে এসে
পাষাণহৃদয়া নলিনীও নাকি
      ভালবাসে কবিরে সে।
শুনেছি নলিনী কবিরে দেখিতে
      নদীতীরে যায় নাকি।
কবিরে দেখিলে ঢ’লে পড়ে তার
      অনুরাগনত আঁখি
মুরলা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
           নলিনীবালারে ভালবেসে যদি
      কবি মোর সুখে থাকে
তাহা হলে, সখি, বল্‌ দেখি মোরে
      কেন না বসিবে তাকে?
মোরা তাহা লয়ে ভাবি কেন এত?
      চপলা লো, আমরা কে?
               চপলার গান
যে ভাল বাসুক– সে ভাল বাসুক–
        সজনি লো, আমরা কে!
দীনহীন এই হৃদয় মোদের
        কাছেও কি কেহ ডাকে?
তবে কেন বল ভেবে মরি মোরা
        কে কাহারে ভালবাসে,
আমাদের কিবা আসে যায় বল
        কেবা কাঁদে, কেবা হাসে!
আমাদের মন কেহই চাহে না,
তবে মনখানি লুকান’ থাক্‌,
প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্‌।
        যদি, সখি, কেহ ভুলে
        মনখানি লয় তুলে,
উলটি-পালটি দু-দণ্ড ধরিয়া
        পরখ করিয়া দেখিতে চায়,
তখনি ধূলিতে ছুঁড়িয়া ফেলিবে
        নিদারুণ উপেখায়!
কাজ কি লো, মন লুকান’ থাক্‌,
        প্রাণের ভিতরে ঢাকিয়া রাখ্‌।
হাসিয়া খেলিয়া ভাবনা ভুলিয়া
        হরষে প্রমোদে মাতিয়া থাক্‌!

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Exit mobile version