Site icon Amar Rabindranath [ আমার রবীন্দ্রনাথ ] GOLN

ভগ্নহৃদয় একবিংশ সর্গ bhagno hriday ekobingso sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভগ্নহৃদয় একবিংশ সর্গ bhagno hriday ekobingso sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাব্যগ্রন্থ : ভগ্নহৃদয়

কবিতার শিরোনামঃ ভগ্নহৃদয় একবিংশ সর্গ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

ভগ্নহৃদয় একবিংশ সর্গ bhagno hriday ekobingso sorgo [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনিল
কেমন? এখন তোর ঘুচেছে ত ভ্রম?
ভেঙ্গে দিলি হাল তুই,    তুলে দিলি পাল তুই,
করিলি প্রবৃত্তিস্রোতে আত্মবিসর্জ্জন–
ভেবেছিলি যাবি ভেসে     কোন ফুলময় দেশে
চাঁদের চুম্বনে যেথা ঘুমায়ে গোলাপ
সুখের স্বপনে কহে সুরভিপ্রলাপ!
কিন্তু রে ভাঙ্গিলি তরী     কঠিন শৈলের ‘পরি,
কিছুতেই পারিলি নে সামালিতে আর!
এখন কি করিবি রে ভাব্‌ একবার!
ভগ্নকাষ্ঠ বুকে ধরি   উন্মত্ত সাগর-‘পারি
উলটিয়া পালটিয়া যাবি ভেসে ভেসে–
নাই দ্বীপ, নাই তীর,  উনমত্ত জলধির
কেনজটা ঊর্ম্মি যত নাচে অট্ট হেসে।
কেমন? এখন তোর ঘুচেছে ত ভ্রম?
এই ত নলিনী তোর?  প্রাণের দেবতা তোর?
ছি ছি রে, কোথায় গিয়ে ঢাকিবি সরম?
নীচ হতে নীচ অতি–হীন হতে হীন–
পথের ধূলার চেয়ে অসার মলিন।
এই এক ধূলিমুষ্টি কিনিয়া রাখিতে
সমস্ত জগৎ তোর চেয়েছিলি দিতে!
রাজপথে মনের দোকান খুলিয়াছে–
রঙ্গ মাখাইয়া কত    ঝুঁটা মন শত শত
সাজাইয়া রেখেছে সে দুয়ারের কাছে,
যে কোন পথিক আসে    ডাকি তারে লয় পাশে,
হৃদয়ের ব্যবসায় করে সে রমণী–
আমারেও প্রতারণা করেছে এমনি!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
যে মন কিনিয়াছিনু কিছুই সে নয়,
রঙ্গ-করা দুটা হাসি দুটা কথা-ময়!
প্রতি পিপাসিত আঁখি যে হাসি লুটিছে,
প্রতি শ্রবণের কাছে যে কথা ফুটিছে,
যে হাসির নাই বাস, নাই অন্তঃপুর,
চরণে যে বেঁধে রাখে মুখর নূপুর,
যে হাসি দিবস রাতি    ভিক্ষার অঞ্জলি পাতি
প্রতি পথিকের কাছে নাচিয়া বেড়ায়–
অনিল রে! তারি তরে কেঁদেছিল হায়!
যে কথা, পথের ধারে পঙ্কের মতন,
জড়াইয়া ধরে প্রতি পান্থের চরণ,
সেই একটি কথা-তরে হৃদয় আমার,
দিবানিশি ছিলি পড়ে দুয়ারে তাহার!
হৃদয়ের হত্যা করা যার ব্যবসায়
সেই মহা পাপিষ্ঠার তুলনা কোথায়?
শরীর ত কিছু নয়, সে ত শুধু ধূলা–
ধূলির মুষ্টির সাথে হয় তার তুলা–
সমস্ত জগৎ তুল্য হৃদয়ের পাশে
সাধ ক’রে হেন হৃদি যেজন বিনাশে,
তোর মাথা পরশিল তাহারি চরণ!
তারেই দেবতা ব’লে করিলি বরণ!
তারি পদতলে তুই সঁপিলি হৃদয়–
তোর হৃদি — যার কাছে কিছুই সে নয়!
শতেক সহস্র হেন  নলিনী আসুক কেন
মনের পথের তোর ধূলিও না হয়!
বিধাতা, এ সৃষ্টি তব সব বিড়ম্বনা,
সত্য ব’লে যাহা কিছু  পরশিতে গেছি পিছু
ছুঁয়েছি যেমনি আর কিছুই রহে না!
হৃদে হৃদে ভালবাসা করেছ সঞ্চার,
অথচ দাও নি লোক ভালবাসিবার!
সমস্ত সংসার এই খুঁজিয়া দেখিলে।
দুটি হৃদি একরূপে কেন নাহি মিলে?
ওই-যে ললিতা হেথা আসিছে আবার!
করেছে সমস্ত মুখ বিষণ্ন আঁধার!
কেন? তার হয়েছে কি ভেবে ত না পাই
যা লাগি বিষণ্ন হয়ে রয়েছে সদাই!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
চায় কি সে দিন রাত্রি বুকে তারে রাখি,
অবাক্‌ মুখেতে তার তাকাইয়া থাকি?
দিবানিশি বলি তারে শত শত বার
“ভালবাসি–ভালবাসি প্রেয়সী আমার”!
তবেই কি মুখ তার হইবে উজ্জ্বল?
তবেই মুছিবে তার নয়নের জল?
এত ভাল কত জন বাসে এ ধরায়?
নিঃশব্দে সংসার তবু চ’লে কি না যায়!
ঘরে ঘরে অশ্রুবারি ঝরিত নহিলে,
জগৎ ভাসিয়া যেত নয়নসলিলে!
দিনরাত অশ্রুবারি     আর ত সহিতে নারি–
দূর হোক, হেথা হতে লইব বিদায়,
অদৃষ্টের অত্যাচার সহা নাহি যায়!
[ উভয়ের প্রস্থান ]
[ললিতার প্রবেশ]
ললিতা।
    এমনি ক’রেই তোর কাটিবে কি দিন?
ললিতা রে, আর ত সহে না!
এ জীবন আর ত রহে না!
বিধাতা, বিধাতা, তোর ধরি রে চরণ–
বল্‌ মোরে কবে মোর হইবে মরণ?
নাইক সুখের আশা–    চাই নাকো ভালবাসা–
সুখসম্পদের আশা দুরাশা আমার–
কপালে নাইক যাহা চাই না তা আর!
এক ভিক্ষা মাগি ওরে–   তাও কি দিবি নে মোরে?
সে নহে সুখের ভিক্ষা– মরণ– মরণ!–
মরণ– মরণ দে রে–     আর কিছু চাহি নে রে,
আর কোন আশা নেই– মরণ মরণ!–
এখনি মুদিলে আঁখি     যদি রে আর না থাকি,
অমনি বায়ুর স্রোতে মিশাইয়া যাই–
এখনি এখনি আহা হয় যদি তাই!
[অনিলের প্রবেশ]
ললিতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
    কোথা যাও, কোথা যাও,   সখা, তুমি কোথা যাও–
একবার চেয়ে দেখ এই দিক-পানে!
কহি গো চরণ ধরে– ফেলিয়া যেও না মোরে!
আর ত যাতনা, সখা, সহে না এ প্রাণে।
ভালবাসা চাই না ত, সখা গো, তোমার–
একটুকু দয়া শুধু কোরো একবার!
একটুকু কোরো, সখা, মুখের যতন–
মুহূর্ত্তের তরে, সখা, দিও দরশন!
নিতান্ত সহিতে নারিযবে পা-দুখানি ধরি
আঘাত করিয়া, সখা, ফেলিও না দূরে–
এইটুকু দয়া শুধু করো তুমি মোরে!
কোথা যাও বল বল, কোথা যাও চলে!
যেতেছ কি হেথা হ’তে অমি আছি বলে?
গভীর রজনী এবে      ঘুমেতে মগন সবে–
বল, সখা, কোথা যাও, চাও কি করিতে?
অনিল।
      মরিতে! মরিতে বালা! যেতেছি মরিতে!
ললিতা, বিধবা তুই আজ হতে হলি!
ফেল্‌ অনিলের আশা মন হতে দলি!
আর তুই সাথে সাথে আসিস নে মোর,
হেথা রহি যাহা ইচ্ছা করিস রে তোর!
আবার! আবার!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
থাক্‌ ওইখেনে তুই, এগোস নে আর!
শত শত বার ক’রে     বলিতে কি হবে তোরে?
দাঁড়া হোথা, এক পদ আসিস নে আর!
আসিস নে বলি তোরে, বলি বার বার!
শান্তিতে মরিব যে রে   তাও তুই দিবি নে রে!
মরিতে যেতেছি, তবু রাহুর মতন
পদে পদে সাথে সাথে করিবি গমন?
দাঁড়া হোথা, সাথে সাথে আসিস নে আর,
এই তোর ‘পরে শেষ আদেশ আমার!
[অনিলের প্রস্থান ও ললিতার মুর্চ্ছিত হইয়া পতন]
আরও পড়ুনঃ
 প্রাণ pran [ কবিতা ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Exit mobile version