রবীন্দ্রনাথের গান বা রবীন্দ্রসঙ্গীত সূচি : রবীন্দ্র কৃতির ক্ষেত্রে ঠিক গান বলতে কী বোঝায় তা একটু জটিল। তাই সংখ্যা. ধরণ, বিষয় বা পর্যায় নিরূপণ করা অত্যন্ত শক্ত কাজ। যে তালিকাটি আমরা করছি সেখানে চারটি উৎসের ক্ষেত্রেই গানের সংজ্ঞার যতোটা সম্ভব সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। আর তিনটি নিঃসন্দেহে প্রামাণিক আর একটি সাম্প্রতিক নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে গানের সংখ্যার হিসেব করার একটা চেষ্টা করা হল।
রবীন্দ্রনাথের গান বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা
(ক) “গীতবিতান” ও তত্সংশ্লিষ্ট সূত্রাদি –২১৫০
(খ) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় প্রণীত “গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী” — ২১৭৮
(গ) বিশ্বভারতী প্রকাশিত স্বরবিতান (১-৬৫) ও তত্সংশ্লিষ্ট সূত্রাদি
(১) প্রথম রীতি –২০৯১
(২) দ্বিতীয় রীতি — ২২৩২
(ঘ) সুভাষ চৌধুরী প্রণীত “গীতবিতানের জগৎ — ১৯১৫
স্বরবিতানকে উৎস ধরে (তালিকার গ) দুভাবে গান গণনা করা হয়েছে:
(১) প্রথম ছত্রের বর্ণানুক্রমিক সূচীপত্র থেকে
(২) স্বরলিপির অভ্যন্তরের বিভাজন থেকে।
এই দুই রীতির পিছনে যে কারণ, ওপরের পাঁচটি সংখ্যার মধ্যে ব্যবধানের মুখ্য কারণও তাই। ভিত্তিতে অনেক পার্থক্য থাকা সত্বেও ওপরের তিনটি রীতি থেকে বেশ কাছাকাছি সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, এটা আশ্চর্যের কথা। এ নিছক সমাপতন বলে আমাদের বিশ্বাস।
কিছু কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে যার প্রথম লাইনে সামান্য পাঠভেদ দেখা যায়, যেমন “আলোকের এই ঝর্নাধারায়” আর “আজ আলোকের এই ঝর্নাধারায়”। গানটির দুই নামই প্রচলিত। যেহেতু বর্ণানুক্রমিক সূচীতে পাঠক দুটি নামের যে কোনোটি নিয়ে খুঁজতে পারেন, সে কারণে সূচীতে গানটি দুবার দেখানো হয়েছে, যদিও তাদের পৃষ্ঠাঙ্কও এক আর গানও এক। কিছু কিছু গানের তো তিনটি নাম দেখা যায়, যথা, “আমার মন, যখন”, “ও আমার মন যখন” আর “ওরে মন যখন” গানটি।
প্রায় সব ক্ষেত্রে গীতবিতানের দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পাদনা করার কালে কবি নিজেই এই পরিবর্তন করেছিলেন। গানের আগের নামটি ততোদিনে সাধারণ্যে চালু হয়ে গেছে কাজেই তা আর মুছে ফেলা যায়নি। সূচী থেকে পাওয়া তালিকায় এই রকম দ্বিত্ব-গানের সংখ্যা ১০২।
“প্রথম ছত্রের সূচী”-তে এই শ্রেণীর সব গানের পৃষ্ঠাঙ্ক একাধিক , প্রতিটি পৃষ্ঠায় গানটি মুদ্রিত– প্রথম লাইন এক কিন্তু গানের বাকী অংশ এক হতে পারে আবার নাও হতে পারে। যথা “অলি বার বার ফিরে যায়” গানটি সূচীতে উঠেছে একবারই, কিন্তু তার পৃষ্ঠাঙ্ক দেখানো হয়েছে ৩৯৭। ৬৭৪। ৯২৯– যথাক্রমে প্রেম, মায়ার খেলা ও নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা পর্যায়ে। এরকম পৃষ্ঠাঙ্কের উপস্থিতি সর্বসাকুল্যে ২৬৬ বার।
আমরা সাধারণ বুদ্ধি খাটিয়ে দেখছি যে ওই ২৬৬-টি উপস্থিতি থেকে আমরা ১৩৪-টি আলাদা গান সনাক্ত করতে পারি। এখানে বলে রাখা উচিত যে রবীন্দ্রনাথের বহু গানে একাধিক পাঠান্তর আছে, তার খতিয়ান পাওয়া যায় স্বরবিতানের খণ্ডে খণ্ডে। সেগুলিকে একই গানের বিবর্তন বলে ধরে নেওয়া যুক্তিযুক্ত। উদাহরণ: “অলি বারবার ফিরে যায়” গানটির তিনটি পৃষ্ঠাঙ্ক কিন্তু স্বতন্ত্র গান বলতে একটি। এদিকে আবার “আঃ বেঁচেছি এখন” গানের দুটি পৃষ্ঠাঙ্কে যে দুটি গান মুদ্রিত তাদের মধ্যে তফাৎ এতো যে তাদের দুটি গান বলতেই হয়।
রবীন্দ্রনাথ-রচিত গানের সংখ্যা = (সূচীর সমগ্র পৃষ্ঠাঙ্ক সংখ্যা – ভিন্ন নামের দ্বিত্ব-গানের সংখ্যা – এক নামে একাধিক পৃষ্ঠাঙ্ক বিশিষ্ট গানের উপস্থিতি সংখ্যা + এক নামে একাধিক পৃষ্ঠাঙ্ক বিশিষ্ট গানের মধ্যে আলাদা বলে ধরা যায় এমন গানের সংখ্যা) = (২৩৮৪ – ১০২ -২৬৬ + ১৩৪) = ২১৫০।
প্রসঙ্গত, একই বাণীতে কবি দুটি সুর দিয়েছেন এমন চল্লিশটি গান পাওয়া গেছে। এদের কি ভিন্ন গান বলে ধরা হবে? আমরা তা ধরিনি।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে একমত হবার পথে যে বিরাট বাধা সেটি তাঁর গীতি বা নৃত্যনাট্যের গানগুলিকে ঘিরে। এদের মধ্যে কোন্টি গান আর তার বাণীর বিস্তার কতোটা, আর কোন্টিই বা সুরাশ্রিত সংলাপ এ নিয়ে বিশারদরা একমত হতে পারেন না। এরকম কিছু গান পাওয়া যাচ্ছে গীতবিতান তৃতীয় খণ্ডে। রবীন্দ্রনাথ সে বই তৈরীর ব্যাপারে জড়িত ছিলেন না, কাজেই সমস্যাপূরণের জন্য তাঁর কাছে যাওয়া যাবে না। একটা উদাহরণ দিলেই সমস্যাটি বোঝা যাবে। নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার একটি দৃশ্যে প্রকৃতি আর তার মায়ের পরপর কথোপকথন:
(১) প্রকৃতি। ফুল বলে, ধন্য আমি, ধন্য আমি মাটির প’রে। … (১০ লাইন)
(২) মা। তুই অবাক ক’রে দিলি আমায় মেয়ে। … (৩ লাইন)
(৩) প্রকৃতি। হাঁ মা, আমি বসেছি তপের আসনে।
(৪) মা। তোর সাধনা কাহার জন্যে।
(৫) প্রকৃতি। যে আমারে দিয়েছে ডাক, দিয়েছে ডাক, … (৮ লাইন)
(৬) মা। কিসের ডাক তোর কিসের ডাক। … (৪ লাইন)
(৭) প্রকৃতি। আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে– …(২ লাইন)
(৮) মা। পোড়া কপাল আমার! … (৩ লাইন)
(৯) প্রকৃতি। হাঁ গো মা, সেই কথাই তো ব’লে গেলেন তিনি, … (১৭ লাইন)
প্রথম অবশ্যই গীতবিতানের সূচী। সেখানে ওপরের ১, ২, ৫, ৬ ও ৯-সংখ্যক নাট্যাংশকে সূচীতে পরিষ্কার গান বলে দেখানো হয়েছে, বাকীগুলি সূচীতে অনুপস্থিত। অবশ্য এটা বলা যেতে পারে যে ২ হোলো ২+৩+৪ আর ৬ হোলো ৬+৭+৮ তবে যুক্তি হিসেবে তা দুর্বল। গীতবিতানের সূচীর সঙ্গে মেলালে চণ্ডালিকার গান সংখ্যা ৫৩।
১৩৪৫ সালের চৈত্র মাসে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার পাঠ ও স্বরলিপির প্রথম প্রকাশ। স্বরবিতানের ১৮ নং খণ্ডটি তার সঙ্গে অভিন্ন, রবীন্দ্র-অনুমোদিত বলে ধরে নেওয়া যায়। আশ্চর্যের কথা যে এই বইয়ের সূচীতে গান বলে কেবল ওপরের তালিকার ১ ও ৫ নং অংশের উল্লেখ আছে। এদিকে স্বরলিপি অংশে ১-৯ নং প্রতিটি অংশ সংলগ্ন কিন্তু স্বতন্ত্র শীর্ষনামে দেখানো হয়েছে। স্বরবিতান ১৮-র পুরো সূচীতে মাত্র ২৩টি গান আর স্বরলিপি অংশে পাওয়া যাচ্ছে ৮২টি গান আর সংলাপ অংশ।
আমাদের এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি মন্তব্য: প্রথম, প্রভাতকুমার তাঁর তালিকায় যে কোনো গানের ও তার পাঠান্তর যদি থাকে তাদের জন্য কেবল একটিই ক্রমিক সংখ্যা ধার্য করেছেন। দ্বিতীয়, নাটকের গানে প্রভাতকুমার ছোটো ছোটো সংলাপের টুকরোকেও স্বতন্ত্র গানের মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন ওপরের চণ্ডালিকার উদাহরণ থেকে তিনি ১-৯ সব অংশকেই গান বলে ধরেছেন, অনেকটা স্বরবিতানের স্বরলিপি অংশে যেমন দেখা যাচ্ছে তার মতো। তাঁর তালিকা মতে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকার গান আর সংলাপের সংখ্যা ১২৪।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রামাণ্য স্বরলিপিবাহী ছেষট্টি খণ্ডের স্বরবিতান গ্রন্থমালা রবীন্দ্রসঙ্গীতচর্চায় অপরিহার্য। রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকতে গোড়ায় নানা নামে ষোলোটা স্বরলিপির বই প্রকাশিত হয়– কেতকী, গীতলিপি ইত্যাদি। তারপর ১৩৪২ সাল থেকে শুরু করে স্বরবিতানের প্রকাশ, এদের চারটি রবীন্দ্রনাথ দেখে যেতে পেরেছিলেন। স্বরবিতানের কয়েকটি খণ্ডে তো পূর্বপ্রকাশিত স্বরলিপি-গ্রন্থই নতুন নাম আর অলঙ্করণে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্বরবিতান গ্রন্থমালা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংখ্যা স্থির করার আগে কয়েকটা কথা জানা থাকা দরকার। স্বরবিতানের বিভিন্ন খণ্ড বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকে সম্পাদনা করেছেন তাই শৈলীতে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। প্রথম তো ওই গান আর সুরবদ্ধ সংলাপের মধ্যে বেছে নেওয়ার ব্যাপার। সোজা কথায়, স্বরবিতানে শৃঙ্খলার সঙ্গে তেমন কোনো নিয়ম ব্যবহার করা হয়নি। ফলে এই গ্রন্থমালার একই খণ্ডে কিছু গান যাদের নিশ্চিত গান বলা উচিত তারা সূচীতে ওঠেনি, এদিকে কিছু ছোটো সংলাপ উঠে গেছে।
এ ছাড়া সম্পাদন-প্রমাদ আছে, যথা গীতবিতান সূচীর মতো ভিন্ন নামের গান একই সূচীতে একাধিক স্থান পেয়েছে (সবসময় নয় কিন্তু)। কিছু গান অপরিবর্তিতভাবে একাধিক খণ্ডে যুক্ত করা হয়েছে। একটা রক্ষা যে স্বরবিতানে যদিও সুরান্তরিত কিছু গানের স্বরলিপি আছে কিন্তু তাদের স্বতন্ত্র নাম দেওয়া হয়নি।
তারপর যেসব গানের স্বরলিপি নেই, বা থাকলেও এখনো স্বরবিতান গ্রন্থমালায় প্রকাশিত হয়নি, গীতবিতানের সূত্র ধরে দেখলে সেই সব গানের সংখ্যা ২০৩। তা যোগ দিলে স্বরবিতান মাফিক স্বতন্ত্র গানের সংখ্যা ২০৯১ আর গান ও সুরবদ্ধ সংলাপের সংখ্যা ২২৩২।
“গানে স্থায়ীর সঙ্গে একটি অন্তরা থাকতে হবে এবং স্বতন্ত্র গান হিসেবে তা গীত হবার যোগ্য হতে হবে।“
এই সংজ্ঞার ফলে স্বর-১২ (তাসের দেশ), স্বর-১৭ (চিত্রাঙ্গদা), স্বর-১৮ (চণ্ডালিকা), স্বর-১৯ (শ্যামা), স্বর-২৯ (কালমৃগয়া), স্বর-৪৯ (বাল্মীকি প্রতিভা) থেকে স্বতন্ত্র বলে গণ্য হবার গানের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সুভাষ চৌধুরী তাঁর বইতে এই সব স্বরবিতানের গান বা সংলাপ ধরে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন। উদাহরণ: চণ্ডালিকার ৮২টি গান আর সুরবদ্ধ সংলাপের অংশ থেকে তাঁর সংজ্ঞা অনুসারে তিনি মাত্র আটটি স্বতন্ত্র গান পেয়েছেন। এই রীতি অনুসরণ করলে সমগ্র স্বরবিতান (১-৬৪ খণ্ড) এবং অন্য প্রকাশন (৬টি গান) থেকে স্বতন্ত্র গান বলে গণ্য হতে পারে ১৭১৫টি। এর সঙ্গে স্বরবিতানে স্বরলিপি নেই এমন ১৯৭টি গান যোগ দিলে যোগফল দাঁড়াচ্ছে ১৯১৫।
উত্স:
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অখণ্ড গীতবিতান, বিশ্বভারতী, পৌষ ১৩৮০
২) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, গীতবিতান-কালানুক্রমিক সূচী, টেগোর রিসার্চ ইন্স্টিটিউট, পৌষ ১৪১০
৩) সুভাষ চৌধুরী, গীতবিতানের জগৎ, প্যাপিরাস, আশ্বিন ১৪১১
সূচী:
- রবীন্দ্রসঙ্গীতের বর্ণানুক্রমিক সূচী
- রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গানের সূচী [ List of songs of Rabindranath Tagore’s Puja Episode]
- আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের গান
- রবীন্দ্রনাথের নাট্যগীতি সূচী
- জাতীয় সংগীত পর্যায়ের গান
- পরিশিষ্ট পর্যায়ের গান
- পূজা পর্যায়ের গান
- প্রকৃতি পর্যায়ের গান
- প্রেম পর্যায়ের গান
- বিচিত্র পর্যায়ের গান
- স্বদেশ পর্যায়ের গান
আরও দেখুন: