হৃদয়ের অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৃদয়ের অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “পুত্রপুট“কাব্যের অন্তর্গত। পত্রপুট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্ত্তৃক রচিত একটি বাংলা কাব্যগ্রন্থ। এটি বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১৩৪৩ (১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে) প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট আঠারোটি কবিতা রয়েছে। পত্রপুট রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার অন্ত্যপর্বের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

হৃদয়ের অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৃদয়ের অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট [ পুত্রপুট কাব্যগ্রন্থ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৃদয়ের অসংখ্য অদৃশ্য পত্রপুট
গুচ্ছে গুচ্ছে অঞ্জলি মেলে আছে
আমার চারদিকে চিরকাল ধ’রে,
আমি-বনস্পতির এরা কিরণ-পিপাসু পল্লবস্তবক,
এরা মাধুকরী ব্রতীর দল।
প্রতিদিন আকাশ থেকে এরা ভরে নিয়েছে
আলোকের তেজোরস,
নিহিত করেছে সেই অলক্ষ্য অপ্রজ্বলিত অগ্নিসঞ্চয়
এই জীবনের গূঢ়তম মজ্জার মধ্যে।
সুন্দরের কাছে পেয়েছে অমৃতের কণা
ফুলের থেকে, পাখির গানের থেকে,
প্রিয়ার স্পর্শ থেকে, প্রণয়ের প্রতিশ্রুতি থেকে,
আত্মনিবেদনের অশ্রুগদ্‌গদ্‌ আকুতি থেকে,
মাধুর্যের কত স্মৃতরূপ কত বিস্মৃতরূপ
দিয়ে গেছে অমৃতের স্বাদ
আমার নাড়ীতে নাড়ীতে।
নানা ঘাতে প্রতিঘাতে সংক্ষুব্ধ
সুখদুঃখের ঝোড়ো হাওয়া নাড়া দিয়েছে
আমার চিত্তের স্পর্শবেদনাবাহিনী পাতায় পাতায়।
লেগেছে নিবিড় হর্ষের অনুকম্পন,

এসেছে লজ্জার ধিক্কার, ভয়ের সংকোচ, কলঙ্কের গ্লানি,
জীবন-বহনের প্রতিবাদ।
ভালোমন্দের বিচিত্র বিপরীত বেগ
দিয়ে গেছে আন্দোলন
প্রাণরস-প্রবাহে।
তার আবেগে বয়ে নিয়ে গেছে সর্বগৃধ্নু চেতনাকে
জগতের সর্বদান-যজ্ঞের প্রাঙ্গণে।
এই চিরচঞ্চল চিন্ময় পল্লবের অশ্রুত মর্মরধ্বনি
উধাও ক’রে দেয় আমার জাগ্রত স্বপ্নকে
চিল-উড়ে-যাওয়া দূর দিগন্তে
জনহীন মধ্যদিনে মৌমাছির গুঞ্জন-মুখর অবকাশে।
হাতধ’রে-ব’সে-থাকা বাষ্পাকুল নির্বাক ভালবাসায়
নেমে আসে এদেরই শ্যামল ছায়ার করুণা।
এদেরই মৃদুবীজন এসে লাগে
শয্যাপ্রান্তে নিদ্রিত দয়িতার
নিশ্বাসস্ফুরিত বক্ষের চেলাঞ্চলে।
প্রিয়-প্রত্যাশিত দিনের চিরায়মান উৎকণ্ঠিত প্রহরে
শিহর লাগাতে থাকে এদেরই দোলায়িত কম্পনে।

This is my prayer to thee, my lord | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

বিশ্বভুবনের সমস্ত ঐশ্বর্যের সঙ্গে আমার যোগ হয়েছে
মনোবৃক্ষের এই ছড়িয়ে-পড়া
রসলোলুপ পাতাগুলির সংবেদনে।

এরা ধরেছে সূক্ষ্মকে, বস্তুর অতীতকে;
এরা তাল দিয়েছে সেই গানের ছন্দে
যার সুর যায় না শোনা।
এরা নারীর হৃদয় থেকে এনে দিয়েছে আমার হৃদয়ে
প্রাণলীলার প্রথম ইন্দ্রজাল আদিযুগের,
অনন্ত পুরাতনের আত্মবিলাস
নব নব যুগলের মায়ারূপের মধ্যে।
এরা স্পন্দিত হয়েছে পুরুষের জয়শঙ্খধ্বনিতে
মর্ত্যলোকে যার আবির্ভাব
মৃত্যুর আলোকে আপন অমৃতকে উদ্বারিত করবার জন্যে
দুর্দাম উদ্যমে,
জলস্থল আকাশপথে দুর্গম জয়ের
স্পর্ধিত যার অধ্যবসায়।

This is my prayer to thee, my lord | Song Offerings, Gitanjali by Rabindranath Tagore

আজ আমার এই পত্রপুঞ্জের
ঝরবার দিন এল জানি।
সুধাই আজ অন্তরীক্ষের দিকে চেয়ে—
কোথায় গো সৃষ্টির আনন্দনিকেতনের প্রভু,
জীবনের অলক্ষ্য গভীরে
আমার এই পত্রদূতগুলির সংবাহিত দিনরাত্রির যে সঞ্চয়
অসংখ্য অপূর্ব অপরিমেয়
যা অখণ্ড ঐক্যে মিলে গিয়েছে আমার আত্মরূপে,

যে রূপের দ্বিতীয় নেই কোনোখানে কোনো কালে,
তাকে রেখে দিয়ে যাব কোন্ গুণীর কোন্ রসজ্ঞের
দৃষ্টির সম্মুখে,
কার দক্ষিণ করতলের ছায়ায়,
অগণ্যের মধ্যে কে তাকে নেবে স্বীকার ক’রে।

শান্তিনিকেতন ১০ বৈশাখ, ১৩৪৩

 

 

Amar Rabindranath Logo

আরও দেখুন:

মন্তব্য করুন