আমার রবীন্দ্রনাথ – পবিত্র সরকার

আমার রবীন্দ্রনাথ [ পবিত্র সরকার ] : কবিই জীবনের কবি; সেই সঙ্গে যাঁরা মৃত্যুরও কবি, হয়তো সমহৎ কবির চিহ্ন ধারণ করেন, কারণ তারা জীবন ও মৃত্যু এই দুই ঘটনাকে মিলিয়ে যে সম্পূর্ণতা, যে সমগ্র অস্তিত্ব—তার ছবিটি তাঁরা একসঙ্গে দেখতে পান। রবীন্দ্রনাথ যে প্রগাঢ় জীবনের কবি, এ নিয়ে বাক্য ব্যয় বাহুল্য মাত্র।

পবিত্র সরকার - আমার রবীন্দ্রনাথ
পবিত্র সরকার

[ আমার রবীন্দ্রনাথ – পবিত্র সরকার ]

আমাদের এই বিপুল বিশ্বলোকে তিনি কীভাবে আমাদের বাঁচা উচিত তার নানা সূত্র তৈরি করেন—জাতি বর্ণ সম্প্রদায়ের খোলসবর্জিত বিশুদ্ধ মানুষকে, মানবসত্তাকে ভালোবেসে, বঞ্চিতদের শক্তি ও সম্মান দিয়ে, প্রাণজগতের নিসর্গজগতের সঙ্গে সেবা ও সৌন্দর্যের বন্ধন তৈরি করে, সমগ্র বিশ্বচরাচরে এই সকলের সঙ্গে নিজের অবস্থানে ধন্য ও কৃতার্থ হয়ে।

এই তাঁর অসীমের সঙ্গে অশেষের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। তাঁর অসীম কোনও অলৌকিকতায় বাসা বেঁধে নেই। হেমন্তবালা দেবীকে লেখা চিঠিতে তাঁর স্পষ্ট কথা—“আমার ঠাকুর মন্দিরেও নয়, প্রতিমাতেও নয়, বৈকুণ্ঠেও নয়—আমার ঠাকুর মানুষের মধ্যে—যেখানে ক্ষুধাতৃষ্ণা সত্য, পিত্তিও পড়ে। ঘুমের দরকার আছে—”।

আমার রবীন্দ্রনাথ - পবিত্র সরকার
রবীন্দ্রনাথ

মৃত্যু নিয়েও রবীন্দ্রনাথের কথা যে অন্যরকমের তা গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন। জীবন যেন সুখদুঃখ নিয়েই, দুঃখও জীবনকে মূল্যবান করে তোলে, তেমনই সব দুঃখের সব ভয়ের চরম যে মৃত্যু—–তাও যে জীবনের অনিবার্য এক অংশ—আমি যদি জীবন পাই তা হলে মৃত্যুকেও যে আমাকে পেতে হবে, এ সত্য থেকে আমাদের পলায়নের পথ নেই। জীবনের অনেক কিছু অনিশ্চিত হলেও মৃত্যু যে ঘটনা হিসেবে একমাত্র সুনিশ্চিত সম্ভাবনা, তাও আমরা জানি।

জানি, কিন্তু, ভুলে থাকার চেষ্টা করি, মৃত্যুর সেই অনিবার্যতাকে এড়ানোর বা পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। জীবনের পক্ষে এও খুব স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ জীবন আর মৃত্যু উভয়কে একই সমগ্রতার মধ্যে ধরেন বলেই তিনি পৃথিবীর মহত্তম কবিদের একজন।

এই স্বীকৃতিটাই হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলাম প্রায় চল্লিশ বছর আগে, সুদূর মার্কিন দেশে প্রকাশিত একটি বইয়ে। বইটি ১৯৬৯ সালে নিউ ইয়র্কে ম্যাকমিলান কোম্পানি প্রকাশ করেছিল। তখনই এর বিক্রি দশ লক্ষ কপি ছাপিয়ে গেছে, মার্কিন দেশের বহু মেডিক্যাল কলেজের প্রাক-মেডিক্যাল কোর্সে সেটি পাঠ্য হয়েছে। বইটির নাম ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডাইয়িং’— লেখিকা ডাক্তার এলিজাবেথ কুবলার রস। তিনি তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলিংস হাসপাতালে রয়েছেন। ডাক্তার, কিন্তু সেই সঙ্গে মনঃসমীক্ষক হিসেবেও তাঁর বিশেষ প্রশিক্ষণ আছে।

আমার রবীন্দ্রনাথ - পবিত্র সরকার
রবীন্দ্রনাথ

বইটির বিষয় সম্বন্ধে আমরা এদেশে ইদানীং একটু সচেতন হচ্ছি। মৃত্যু পথযাত্রী যেসব মানুষ—সমাজ ও পরিবার কীভাবে তাদের যত্ন নেবে, কীভাবে তাদের ভয়, বিভ্রান্তি ও বেদনার উপশম ঘটাবে। বিশেষত যেসব মানুষের মৃত্যুর সময় হয়নি, শিশু বা তরুণ বয়স, মধ্যবয়সি সংসারের কর্ত্রী, সন্তানের মা তাদের দেহে যদি অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু এসে ঠিকানা গড়ে, কীভাবে ওই অমোঘ সত্যের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া করানো যায়? কীভাবে তাদের দিয়ে ওই নিষ্ঠুর সত্যকে শান্তভাবে গ্রহণ করানো যায়?

ডাক্তার কুবলার রসের এইসব বিষয় নিয়ে বক্তৃতা ও সেমিনারের খ্যাতি আগেই তৈরি হয়েছিল। কলোরাডোর ডেনভার থেকে সেই খ্যাতি তাঁকে শিকাগোর বিলিংস হাসপাতালের মতো একটি প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়। তিনি একটি অদ্ভুত গবেষণা শুরু করেছিলেন। তাঁর বিষয় ছিলেন মরণাস্তিক অসুখের (টার্মিনাল ডিজিজ) মানুষেরা। নানা হাসপাতাল, ইনফার্মারি ইত্যাদিতে তিনআমার রবীন্দ্রনাথ

সন্ধান করতেন এই ধরনের মানুষদের। খোঁজ পেলে তাঁদের কাছে অবিলম্বে পৌঁছে যেতেন তিনি। তারপর প্রশ্ন করতেন, তাঁরা তাঁর সঙ্গে নিজেদের বিষয়ে কথা বলবেন কি না। রাজি হলে তিনি খুব তীব্র মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনতেন, নোট করতেন। কেউ কেউ জানেন তাঁদের আসন্ন মৃত্যুর কথা, কেউ কেউ, বিশেষত শিশুরা বা অল্পবয়সিরা, জানেন না। কারও কাছে এই সংবাদ জানানোর মুহূর্তে কখনও তিনি হাজির থেকেছেন, লক্ষ্য করেছেন তাঁদের প্রতিক্রিয়া।

আমার রবীন্দ্রনাথ - পবিত্র সরকার
রবীন্দ্রনাথ

তাঁদের সঙ্গে থেকে তিনি তাঁদের মনস্তত্ত্বের পরিবর্তনের এই পাঁচটি পর্যায় লক্ষ্য করেছিলেন—প্রথমে অস্বীকার আর একাকীত্ব (ডিনায়াল অ্যান্ড আইসোলেশন), তারপরে ক্রোধ, তারপরে জীবিতদের সঙ্গে বা জীবনের সঙ্গে এমনকী মৃত্যুর সঙ্গে দরকষাকষি (বারগেনিং)— আচ্ছা, আমি যদি এই এই করি তা হলে মৃত্যুকে আটকানো যাবে না, আর দু-চার বছর সময় পাব না?’ তারপরে মন খারাপ হওয়ায় (ডিপ্রেশান) একটা স্তর। সবশেষে স্বীকৃতি (অ্যাকসেপট্যান্স)।

ডাক্তার ও মনোবিদরা এই পর্যায় ভাগ নিয়ে একমত হবেন কিনা জানি না, কিন্তু প্রায় পঁয়ষট্টিটি রোগীর সঙ্গে কথা বলে, এই পাঁচটি মানসিক পর্যায়ে এবং এই রোগীদের শারীরিক ও মানসিক পরিচর্যা কীরকম হওয়া উচিত তা-ই নিয়েই তাঁর ওই বই। এ বইটি এর মধ্যেই এ ধরনের বইয়ের মধ্যে একটি ‘ক্লাসিক’ হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং ১৯৯৭ সালে ‘স্ক্রিবনার ক্লাসিকস সংস্করণ’ হিসেবে সাইমন অ্যান্ড শুস্টার নতুন করে প্রকাশ করেছেন।

সেটা বড় কথা নয়। শিকাগোর এক গুজরাটি বন্ধু যখন প্রথম এ বইটির সঙ্গে আমার পরিচয় করান তখন হঠাৎ যে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা আমাকে চমকে দিয়েছিল। তা হল এর বারোটি অধ্যায়ের শুরুতে এবং গ্রন্থের অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ের শেষে, মোট তেরোটি জায়গায় একজন মাত্র মানুষের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ডা. রস তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বেশিরভাগই আমাদের চেনা কবিতা, চেনা কথা। যেমন প্রথম অধ্যায়ের (On the Fear of Death) শুরুতে ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’ গানটির পুরোটার অনুবাদ—

Let me not pray to be sheltered from Dangers, but to be fearless in facing them.

দ্বিতীয় অধ্যায়ের (Attitudes Towards Death and Dying) শুরুতে আছে, Men are cruel, but Man is kind. তৃতীয় অধ্যায়ে (Denial and Isolation) Man barricades against himself, 5 (Anger) We read the world wrong and say, that is deceives us, (Bargaining)

আমার রবীন্দ্রনাথ - পবিত্র সরকার
রবীন্দ্রনাথ

The woodcutters axe begged for its handle from the tree, the tree gave it, ষষ্ঠের (Depression) শুরুতে The world rushes on over the strings of the lingering heart making the music of sadness. সপ্তম অধ্যায় স্বীকৃতি বা Acceptence-এর শুরুতে শ্রীমতী কুবলার রস ব্যবহার করেছেন গীতাঞ্জলীর ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই’ গানটির অনুবাদ

I have got my leave. Bid me farewell, my brothers. অষ্টম অধ্যায়টি শুরু হয়েছে ইংরেজি গীতাঞ্জলী-র LXXXVII সংখ্যক কবিতা দিয়ে, মূল বাংলায় এটি স্মরণ-এর কবিতা— আমার ঘরেতে আর নাই যে সে নাই, যাই আর ফিরে আসি খুঁজিয়া না পাই।’ এ অধ্যায়ের নাম Hope। হয়তো কবিতার শেষ দুটি ছত্রে সেই আশার কথা আছে—ঘরে মোর নাই আর সে অমৃতরস, বিশ্ব মাঝে পাই সেই হারানো পরশ।’

নবম অধ্যায়-এর নাম The Patient’s Family, এখানে অনুবাদ লিপিকার শ্মশান থেকে বাপ ফিরে এল’ কথিকাটি দিয়ে, যার অনুবাদ আছে The Fugitive এ। দশম অধ্যায়ে আছে কয়েকটি আসন্ন মৃত্যু রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। তার শুরুতে আছে ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলী’-র ৮৬ সংখ্যক কবিতা, মূলে নৈবেদ্য-এর ‘পাঠাইলে আজি মৃত্যুর দূত আমার ঘরের দ্বারে,/তব আহ্বান করি সে বাহন পার হয়ে এল পারে।’ একাদশের শুরুতে উদ্ধৃতি The storm of the last night has crowned this morning with golden peace. দ্বাদশে আছে এই রোগীদের নিয়ে থেরাপির কথা—তার শুরুতে উৎকীর্ণ— Death belongs to life as birth does / The walk is in the raising of the foot as in the laying of it down. এ অধ্যায়ের শেষে, বইয়ের একেবারে শেষে, আছে—

The water in a vessel is sparkling,

Water in the sea is dark.

The small truth has words it are clear, The great truth has great silence.

আমার রবীন্দ্রনাথ - পবিত্র সরকার
রবীন্দ্রনাথ

গীতাঞ্জলি ছাড়া বাকি সব উদ্ধৃতি Stray Birds থেকে। সবগুলির বাংলা আমরা দেওয়ার চেষ্টা করিনি, কারণ আমরা বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথ অনুবাদক নন, ইংরেজি ভাষাতেও এক মৌলিক কবি।

বইটি পড়ে অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি যে, কেন ডাক্তার কুবলার রস পাশ্চাত্যের এতসব কবি ও দার্শনিক থাকতে শুধু রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিকেই ব্যবহার করলেন। শিকাগোতে আমার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, যদিও তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপক তখন, বিলিংস হাসপাতালে আমি ছুটিতে গায়ে-খাটুনির কাজও করেছি।

পবিত্র সরকার - আমার রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ

তাঁর সঙ্গে দেখা হল যখন আমি মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি, ১৯৭৪ সালে। তিনি ওখানকার মেডিক্যাল কলেজে বক্তৃতা দিতে এলেন, বললেন মরণাপন্ন শিশু ও কিশোরদের কথা। সে এক অসামান্য বক্তৃতা, পরে এ সম্বন্ধে তাঁর বইও বেরিয়েছে। একই টেবিলে মধ্যাহ্নভোজের এক ফাঁকে তাঁকে জিগ্যেস করলাম কথাটা। রবীন্দ্রনাথ কেন?

তিনি উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠলেন, My most favourite poet— আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। আমি বললাম, তা তো তোমার বই পড়েই বুঝেছি, কিন্তু কী ভাবে হলেন তোমার প্রিয়তম কবি?’ আমি ডেরেক গিল-এর লেখা তাঁর জীবনী Quest পড়েছি পরে, সংবাদেও দেখেছি পরে তিনি এক বুজরুক ধর্মগুরুর শিষ্য হয়েছিলেন, শিকাগোর উপকণ্ঠে তাঁর বাড়ির নাম ‘শান্তি নিলয়’। কিন্তু তখনও এসব হয়নি। তিনি বললেন, ১৯৪২ নাগাদ তাঁর মেডিক্যাল ভলান্টিয়ার হয়ে ভারতে আসার কথা ছিল। তখনই রবীন্দ্রনাথ পড়া।

ভারতে আসা হয়নি, তার বদলে সুইজারল্যান্ডের জার্মান এই ডাক্তারি ছাত্রী চলে যান মার্কিন দেশে। বললেন, দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথ প্রথম পড়েই আমার মনে হয়েছিল যে, মৃত্যু সম্বন্ধে এই কবি, এত কথা বলেছেন, এবং এমনভাবে বলেছেন, যার তুলনা যেমন অন্য কোথাও নেই, তেমনি তাঁর কথাগুলোই মৃত্যুকে দেখার সবচেয়ে সত্য উপায় বলে আমার ধারণা।

তারপর বললেন, ‘আমাকে ভুল বুঝো না। মৃত্যু সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে যথার্থ কথাগুলো বলেছেন বলেই তিনি জীবনের কবি হিসেবেও সবচেয়ে বড়। জানো তো, মানুষের জন্ম, ভালোবাসা, ঘৃণা, দুঃখ, মৃত্যু—এগুলো সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে যায়, এগুলো সব মানুষের। তাই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু আর জীবন নিয়ে কথাবার্তাও কোনও একটা সংস্কৃতির নয়।’

আমার তখন মনে পড়ে গেল, সুইজারল্যান্ডের এক প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র আর শিক্ষকদের যখন হিটলারের বন্দিশিবিরে ডাক পড়ে, শিক্ষকেরা বুঝতে পেরেছিলেন, সে ডাকের মানে কী, তাঁদের আর ছাত্রছাত্রীদের ফেরা হবে না বন্দীশিবির থেকে, সে ডাক মৃত্যুর ডাক। তখন তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে ডাকঘর অভিনয় করিয়ে মৃত্যু সম্বন্ধে তাদের মধ্যে একটা বোধ সঞ্চার করার চেষ্টা করেছিলেন, যাতে তাঁরা মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারে।

আমি বাঙালি শুনে ডা. কুবলার রস বললেন, ‘তোমাকে আমার ঈর্ষা হয়।

তুমি তাঁর লেখা মূল ভাষায় পড়তে পারো।”

 

পবিত্র সরকার বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন:

মন্তব্য করুন