‘প্রায়শ্চিত্ত’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি শক্তিশালী ও মনস্তাত্ত্বিক ছোটগল্প, যা তাঁর কালজয়ী গল্পসংকলন গল্পগুচ্ছ-এর অন্তর্ভুক্ত। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ মানুষের মনোজগৎ, আত্মগ্লানি, অনুশোচনা এবং নৈতিক দায়বোধকে গভীরভাবে উপস্থাপন করেছেন। চরিত্রগুলোর দ্বন্দ্ব এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে সামাজিক নিয়ম-নীতির মাঝে মানুষ নিজেকে খুঁজে ফেরে এবং প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হয়। গল্পটি শুধু একটি ব্যক্তিগত দুঃখের বিবরণ নয়, বরং একটি বৃহত্তর মানবিক বোধের প্রতিচ্ছবি, যা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ গল্পের ভাষা, বর্ণনা এবং মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অনন্যতা প্রমাণ করে।
প্রায়শ্চিত্ত ছোটগল্প [ গল্পগুচ্ছ ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাটকের পাত্রগণ
প্রতাপাদিত্য – যশোহরের রাজা; উদয়াদিত্য – যশোহরের যুবরাজ; বসন্ত রায় – প্রতাপাদিত্যের খুড়া , রায়গড়ের রাজা; রামচন্দ্র রায় – প্রতাপাদিত্যের জামাতা , চন্দ্রদ্বীপের রাজা; রমাই – রামচন্দ্রের ভাঁড়; রামমোহন – রামচন্দ্র রায়ের মল্ল; ফর্নাণ্ডিজ – রামচন্দ্র রায়ের পোর্টুগীজ সেনাপতি;
ধনঞ্জয় – একজন বৈরাগী; সীতারাম – প্রতাপাদিত্যের গৃহরক্ষক; পীতাম্বর – প্রতাপাদিত্যের অনুচর; প্রতাপাদিত্যের মন্ত্রী; প্রতাপাদিত্যের মহিষী; সুরমা – উদয়াদিত্যের স্ত্রী; বিভা – প্রতাপাদিত্যের কন্যা , রামচন্দ্র রায়ের মহিষী; বামী – প্রতাপাদিত্যের মহিষীর পরিচারিকা
প্রায়শ্চিত্তঃ প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রথম অঙ্ক
১
উদয়াদিত্য।
আমার উপর মাধবপুর পরগনা শাসনের ভার মহারাজ রেখেছিলেন। জান তো, দু-বৎসর থেকে সেখানে কী রকম অজন্মা হয়েছে– আমি তাই খাজনা আদায় বন্ধ করেছিলুম। মহারাজ আমাকে বলেছিলেন যেমন করে হোক টাকা চাই।
সুরমা।
আমি তো তোমাকে আমার গহনাগুলো দিতে চেয়েছিলুম।
উদয়াদিত্য।
তোমার গহনা টাকা দিয়ে কেনে এত বড়ো বুকের পাটা এ-রাজ্যে আছে কার? মহারাজার কানে গেলে কি রক্ষা আছে? আমি মহারাজকে বললুম মাধবপুর থেকে টাকা আমি কোনোমতেই আদায় করতে পারব না। শুনে তিনি মাধবপুর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। তিনি এখন সৈন্য বাড়াচ্ছেন, টাকা তাঁর চাই!
সুরমা।
পরগনা তো কেড়ে নিলেন, কিন্তু তুমি চলে এলে প্রজারা যে মরবে।
উদয়াদিত্য।
আমি ঠিক করেছি, যে করে হোক তাদের পেটের ভাতটা জোগাব। শুনতে পেলে মহারাজ খুশি হবেন না– দয়া জিনিসটাকে তিনি মেয়েমানুষের লক্ষণ বলেই জানেন। কিন্তু তোমার ঘরে আজ এত ফুলের মালার ঘটা কেন?
সুরমা।
রাজপুত্রকে রাজসভায় যখন চিনল না, তখন যে তাকে চিনেছে সে তাকে মালা দিয়ে বরণ করবে।
উদয়াদিত্য।
সত্যি নাকি! তোমার ঘরে রাজপুত্র আসাযাওয়া করেন? তিনি কে শুনি? এ খবরটা তো জানতুম না।
সুরমা।
রামচন্দ্র যেমন ভুলেছিলেন তিনি অবতার, তোমারও সেই দশা হয়েছে। কিন্তু ভক্তকে ভোলাতে পারবে না।
উদয়াদিত্য।
রাজপুত্র! রাজার ঘরে কোনো জন্মে পুত্র জন্মাবে না, বিধাতার এই অভিশাপ।
উদয়াদিত্য।
হাঁ, রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।
সুরমা।
এ তুমি মনের ক্ষোভে বলছ।
উদয়াদিত্য।
কথাটা কি আমার কাছে নূতন যে ক্ষোভ হবে? যখন এতটুকূ ছিলুম তখন থেকে মহারাজ এইটেই দেখেছেন যে আমি তাঁর রাজ্যভার বইবার যোগ্য কি না । কেবলই পরীক্ষা, স্নেহ নেই।
সুরমা।
প্রিয়তম, দরকার কী স্নেহের! খুব কঠোর পরীক্ষাতেও তোমার জিত হবে। তোমার মতো রাজার ছেলে কোন্ রাজা পেয়েছে?
উদয়াদিত্য।
বল কী? পরীক্ষক তোমার পরামর্শ নিয়ে বিচার করবেন না, সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
সুরমা।
কারও পরামর্শ নিয়ে বিচার করতে হবে না– আগুনের পরীক্ষাতেও সীতার চুল পোড়ে নি। তুমি রাজ্যভার বহনের উপয়ুক্ত নও, এ-কথা কি বললেই হল? এতবড়ো অবিচার কি জগতে কখনো টিকতে পারে?
উদয়াদিত্য।
রাজ্যভারটা নাই-বা ঘাড়ের উপর পড়ল, তাতেই বা দুঃখ কিসের?
সুরমা।
না না, ও-কথা তোমার মুখে আমার সহ্য হয় না। ভগবান তোমাকে রাজার ছেলে করে পাঠিয়েছেন, সে-কথা বুঝি অমন করে উড়িয়ে দিতে আছে? না হয় দুঃখই পেতে হবে– তা বলে–
উদয়াদিত্য।
আমি দুঃখের পরোয়া রাখি নে। তুমি আমার ঘরে এসেছ, তোমাকে সুখী করতে পারি নে আমার পৌরুষে সেই ধিক্কার বাজে।
সুরমা।
যে সুখ দিয়েছ তাই যেন জন্ম-জন্মান্তর পাই।
উদয়াদিত্য।
সুখ যদি পেয়ে থাক তো সে নিজের গুণে, আমার শক্তিতে নয়। এ-ঘরে আমার আদর নেই বলে তোমারও যে অপমান ঘটে! এমন কি, মাও যে তোমাকে অবজ্ঞা করেন।
আমার সব সম্মান যে তোমার প্রেমে, সে তো কেউ কাড়তে পারে নি।
উদয়াদিত্য।
তোমার পিতা শ্রীপুররাজ কিনা যশোরের অধীনতা স্বীকার করেন না-, সেই হয়েছে তোমার অপরাধ– মহারাজ তোমার উপরে রাগ দেখিয়ে তার শোধ তুলতে চান।
উদয়াদিত্য।
ও কে ও। বিভা বুঝি! (দ্বার খুলিয়া) কী বিভা! কী হয়েছে? এত রাত্রে কেন?
বিভা।
(চুপি চুপি কিছু বলিয়া সরোদনে) দাদা কী হবে?
উদয়াদিত্য।
ভয় নেই আমি যাচ্ছি।
বিভা।
না না, তুমি যেয়ো না।
বিভা।
বাবা যদি জানতে পারেন?
উদয়াদিত্য।
জানতে পারবেন তো কী? তাই বলে বসে থাকব?
সুরমা।
ছি বিভা, এখন সে-কথা কি ভাববার সময়?
বিভা।
(উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া) দাদা, তুমি যেয়ো না, তুমি লোক পাঠিয়ে দাও। আমার ভয় করছে।
উদয়াদিত্য।
ভয় করবার সময় নেই বিভা!
বিভা।
কী হবে ভাই? বাবা জানতে পারলে জানি নে কী কাণ্ড করবেন।
সুরমা।
যাই করুন না বিভা, নারায়ণ আছেন।
২
মন্ত্রগৃহে প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রী
মন্ত্রী।
মহারাজ, কাজটা কি ভালো হবে?
প্রতাপাদিত্য।
কোন্ কাজটা?
মন্ত্রী।
আজ্ঞে, কাল যেটা আদেশ করেছিলেন।
প্রতাপাদিত্য।
কাল কী আদেশ করেছিলুম?
মন্ত্রী।
আপনার পিতৃব্য সম্বন্ধে–
প্রতাপাদিত্য।
আমার পিতৃব্য সম্বন্ধে কী?
মন্ত্রী।
মহারাজ আদেশ করেছিলেন, যখন রাজা বসন্ত রায় যশোরে আসবার পথে শিমুলতলির চটিতে আশ্রয় নেবেন, তখন–
প্রতাপাদিত্য।
তখন কী? কথাটা শেষ করেই ফেলো।
মন্ত্রী।
তখন দুজন পাঠান গিয়ে–
প্রতাপাদিত্য।
নিহত করবে! অমরকোষ খুঁজে বুঝি আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না? নিহত করবে! মেরে ফেলবে কথাটা মুখে আনতে বুঝি বাধছে?
মন্ত্রী।
মহারাজ আমার ভাবটি ভালো বুঝতে পারেন নি।
প্রতাপাদিত্য।
বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি।
মন্ত্রী।
আজ্ঞে মহারাজ আমি–
প্রতাপাদিত্য।
তুমি শিশু! খুন করাকে তুমি জুজু বলে জান! তোমার বুড়ি দিদিমার কাছে শিখেছ খুন করাটা পাপ! খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ, এটা এখনও তোমার শিখতে বাকি আছে। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে, তাদের যারা মিত্র, তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম। পিতৃব্য বসন্ত রায় নিজেকে ম্লেচ্ছের দাস বলে স্বীকার করেছেন। ক্ষত হলে নিজের বাহুকে কেটে ফেলা যায়, সে-কথা মনে রেখো মন্ত্রী।
প্রতাপাদিত্য।
অমন তাড়াতাড়ি “যে আজ্ঞে’ বললে চলবে না। তুমি মনে করছ নিজের পিতৃব্যকে বধ করা সকল অবস্থাতেই পাপ। “না’ ব’লো না, ঠিক এই কথাটাই তোমার মনে জাগছে। কিন্তু মনে ক’রো না এর উত্তর নেই। পিতার অনুরোধে ভৃগু তাঁর মাকে বধ করেছিলেন, আর ধর্মের অনুরোধে আমি আমার পিতৃব্যকে কেন বধ করব না?
মন্ত্রী।
কিন্তু দিল্লীশ্বর যদি শোনেন তবে–
প্রতাপাদিত্য।
আর যাই কর, দিল্লীশ্বরের ভয় আমাকে দেখিয়ো না।
মন্ত্রী।
প্রজারা জানতে পারলে কী বলবে?
প্রতাপাদিত্য।
জানতে পারলে তো।
মন্ত্রী।
এ-কথা কখনোই চাপা থাকবে না।
প্রতাপাদিত্য।
দেখো মন্ত্রী, কেবল ভয় দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করে তোলবার জন্যেই কি তোমাকে রেখেছি?
মন্ত্রী।
মহারাজ, যুবরাজ উদয়াদিত্য–
প্রতাপাদিত্য।
দিল্লীশ্বর গেল, প্রজারা গেল, শেষকালে উদয়াদিত্য! সেই স্ত্রৈণ বালকটার কথা আমার কাছে তুলো না।
মন্ত্রী।
তাঁর সম্বন্ধে একটি সংবাদ আছে। কাল তিনি রাত্রে ঘোড়ায় চড়ে একলা বেরিয়েছেন, এখনো ফেরেন নি।
প্রতাপাদিত্য।
কোন্দিকে গেছে?
মন্ত্রী।
তখন রাত দেড় প্রহর হবে।
প্রতাপাদিত্য।
নাঃ, আর চলল না! ঈশ্বর করুন আমার কনিষ্ঠ পুত্রটি যেন উপযুক্ত হয়। এখনও ফেরে নি!
প্রতাপাদিত্য।
একজন প্রহরী তার সঙ্গে যায় নি কেন?
মন্ত্রী।
যেতে চেয়েছিল, তিনি নিষেধ করেছিলেন।
প্রতাপাদিত্য।
তাকে না জানিয়ে, তার পিছনে পিছনে যাওয়া উচিত ছিল।
মন্ত্রী।
তারা তো কোনো সন্দেহ করে নি।
প্রতাপাদিত্য।
বড়ো ভালো কাজই করেছিল! মন্ত্রী, তুমি কি বোঝাতে চাও এজন্যে কেউ দায়ী নয়? তা হলে এ দায় তোমার।
৩
পথপার্শ্বে গাছতলায় বাহকহীন পালকিতে বসন্ত রায় আসীন,
পাশে একজন পাঠান দণ্ডায়মান
পাঠান।
নাঃ, এ বুড়োকে মারার চেয়ে বাঁচিয়ে রেখে লাভ আছে। মারলে যশোরের রাজা কেবল একবার বকশিশ দেবে, কিন্তু একে বাঁচিয়ে রাখলে এর কাছে অনেক বকশিশ পাব।
বসন্ত রায়।
খাঁ সাহেব, তুমিও যে ওদের সঙ্গে গেলে না?
পাঠান।
হুজুর, যাই কী করে? আপনি তো ডাকাতের হাত থেকে আমাদের ধনপ্রাণ রক্ষার জন্যে আপনার সব লোকজনদেরই পাঠিয়ে দিলেন– আপনাকে মাঠের মধ্যে একলা ফেলে যাব এমন অকৃতজ্ঞ আমাকে ঠাওরাবেন না। দেখুন, আমাদের কবি বলেন, যে আমার অপকার করে সে আমার কাছে ঋণী, পরকালে সে-ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে, যে আমার উপকার করে আমি তার কাছে ঋণী, কোনো কালেই সে-ঋণ শোধ করতে পারব না।
বসন্ত রায়।
বা বা বা! লোকটা তো বেশ! খাঁ সাহেব, তোমাকে বড়ো ঘরের লোক বলে মনে হচ্ছে।
পাঠান।
(সেলাম করিয়া) ক্যা তাজ্জব! মহারাজ ঠিক ঠাউরেছেন।
বসন্ত রায়।
এখন তোমার কি করা হয়?
পাঠান।
(সনিশ্বাসে) হুজুর, গরিব হয়ে পড়েছি, চাষবাস করেই দিন চলে। কবি বলেন, হে অদৃষ্ট, তৃণকে তৃণ করে গড়েছ সেজন্যে তোমাকে দোষ দিই নে। কিন্তু বটগাছকে বটগাছ করেও তাকে ঝড়ের ঘায়ে তৃণের সঙ্গে এক মাটিতে শোয়াও, এতেই বুঝেছি তোমার হৃদয়টা পাষাণ!
বসন্ত রায়।
বাহবা, বাহবা! কবি কী কথাই বলেছেন! সাহেব, যে দুটো বয়েত আজ বললে ও তো আমাকে লিখে দিতে হবে। আচ্ছা খাঁসাহেব, তোমার তো বেশ মজবুত শরীর, তুমি তো ফৌজের সিপাহি হতে পার।
পাঠান।
হুজুরের মেহেরবানি হলেই পারি। আমার বাপ-পিতামহ সকলেই তলোয়ার হাতে মরেছেন। কবি বলেন–
বসন্ত রায়।
(হাসিয়া) কবি যাই বলুন, আমার কাজ যদি নাও তবে তলোয়ার হাতে নিয়ে মরার শখ মিটতে পারে, কিন্তু সে-তলোয়ার খাপ থেকে খোলবার সুযোগ হবে না। প্রজারা শান্তিতে আছে– ভগবান করুন আর লড়াইয়ের দরকার না হয়। বুড়ো হয়েছি তলোয়ার ছেড়েছি, এখন তার বদলে আর-একজন আমার পাণিগ্রহণ করেছে। (সেতারে ঝংকার)
পাঠান।
(ঘাড় নাড়িয়া) হায় হায়, এমন অস্ত্র কি আছে! একটি বয়েত আছে– তলোয়ারে শত্রুকে জয় করা যায় কিন্তু সংগীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়।
বসন্ত রায়।
(উৎসাহে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) কী বললে, খাঁ সাহেব! সংগীতে শত্রুকে মিত্র করা যায়! কী চমৎকার! তলোয়ার যে এমন ভয়ানক জিনিস, তাতেও শত্রুর শত্রুত্ব নাশ করা যায় না। কেমন করে বলব নাশ করা যায়? রোগীকে বধ করে রোগ আরোগ্য করা সে কেমনতরো আরোগ্য? কিন্তু সংগীত যে এমন মৃদু জিনিস তাতে শত্রু নাশ না করেও শত্রুত্ব নাশ করা যায়। একি সাধারণ কবিত্বের কথা! বাঃ, কী তারিফ! খাঁ সাহেব, তোমাকে একবার রায়গড়ে যেতে হচ্ছে। আমি যশোর থেকে ফিরে গিয়েই আমার সাধ্যমতো তোমার কিছু–
পাঠান।
আপনার পক্ষে যা “কিছু’ আমার পক্ষে তাই ঢের। হুজুর, আপনার সেতার বাজানো আসে?
বসন্ত রায়।
বাজানো আসে কেমন করে বলি? তবে বাজাই বটে।
উদয়াদিত্য।
আঃ, বাঁচলুম! দাদামশায়, পথের ধারে এত রাত্রে কাকে বাজনা শোনাচ্ছ?
বসন্ত রায়।
খবর কী দাদা? সব ভালো তো? দিদি ভালো আছে?
বসন্ত রায়।
সেতার লইয়া গান
ভূপালী – যৎ
বঁধুয়া অসময়ে কেন হে প্রকাশ?
সকলি যে স্বপ্ন বলে হতেছে বিশ্বাস।
তুমি গগনেরি তারা
মর্ত্যে এলে পথহারা,
এলে ভুলে অশ্রুজলে আনন্দেরি হাস।
উদয়াদিত্য।
দাদামশায়, এ লোকটি কোথা থেকে জুটল?
বসন্ত রায়।
খাঁ সাহেব বড়ো ভালো লোক। সমজদার ব্যক্তি। আজ রাত্রে এঁকে নিয়ে বড়ো আনন্দেই কাটানো গেছে।
উদয়াদিত্য।
তোমার সঙ্গের লোকজন কোথায়? চটিতে না গিয়ে এই পথের ধারে রাত কাটাচ্ছ যে?
বসন্ত রায়।
ভালো কথা মনে করিয়ে দিলে! খাঁ সাহেব, তোমাদের জন্যে আমার ভাবনা হচ্ছে। এখনও তো কেউ ফিরল না। সেই ডাকাতের দল কি তবে–
পাঠান।
হুজুর, অভয় দেন তো সত্য কথা বলি। আমরা রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রজা, যুবরাজ বাহাদুর আমাদের বেশ চেনেন। মহারাজ আমাকে আর আমার ভাই রহিমকে আদেশ করেন যে, আপনি যখন নিমন্ত্রণ রাখতে যশোরের দিকে আসবেন তখন পথে আপনাকে খুন করা হয়।
পাঠান।
আমার ভাই গ্রামে ডাকাত পড়েছে বলে কেঁদেকেটে আপনার অনুচরদের নিয়ে গেলেন। আমার উপরেই এই কাজের ভার ছিল। কিন্তু মহারাজ, যদিও রাজার আদেশ, তবু এমন কাজে আমার প্রবৃত্তি হল না। কারণ আমাদের কবি বলেন, রাজা তো পৃথিবীরই রাজা, তাঁর আদেশে পৃথিবী নষ্ট করতে পার, কিন্তু সাবধান, স্বর্গের এক কোণও নষ্ট ক’রো না। গরিব এখন মহারাজের শরণাগত। দেশে ফিরে গেলে আমার সর্বনাশ হবে।
বসন্ত রায়।
তোমাকে পত্র দিচ্ছি তুমি এখান থেকে রায়গড়ে চলে যাও।
উদয়াদিত্য।
দাদামশায়, তুমি এখান থেকে যশোরে যাবে নাকি?
বসন্ত রায়।
আমি তো ভাই ভবসমুদ্রের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি– একটা ঢেউ লাগলেই বাস। আমার ভয় কাকে? কিন্তু আমি যদি না যাই তবে প্রতাপের সঙ্গে ইহজন্মে আমার আর দেখা হওয়া শক্ত হবে। এইযে ব্যাপারটা ঘটল এর সমস্ত কালি মুছে ফেলতে হবে যে– এইখেন থেকেই যদি রায়গড়ে ফিরে যাই তা হলে সমস্তই জমে থাকবে। চল্ দাদা চল্। রাত শেষ হয়ে এল।
৪
মন্ত্রসভায় প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রী
প্রতাপাদিত্য।
দেখো দেখি মন্ত্রী সে পাঠান দুটো এখনও এল না।
মন্ত্রী।
সেটা তো আমার দোষ নয় মহারাজ!
প্রতাপাদিত্য।
দোষের কথা হচ্ছে না। দেরি কেন হচ্ছে তুমি কী অনুমান কর তাই জিজ্ঞাসা করছি।
মন্ত্রী।
শিমুলতলি তো কাছে নয়। কাজ সেরে আসতে দেরি তো হবেই।
প্রতাপাদিত্য।
উদয় কাল রাত্রেই বেরিয়ে গেছে?
মন্ত্রী।
আজ্ঞে হাঁ সে তো পূর্বেই জানিয়েছি।
প্রতাপাদিত্য।
কী উপযুক্ত সময়েই জানিয়েছ। আমি তোমাকে নিশ্চয় বলছি মন্ত্রী এ সমস্তই সে তার স্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে করেছে। কী বোধ হয়?
মন্ত্রী।
কেমন করে বলব মহারাজ?
প্রতাপাদিত্য।
আমি কি তোমার কাছে বেদবাক্য শুনতে চাচ্ছি? তুমি কী আন্দাজ কর তাই জিজ্ঞাসা করছি।
পাঠান।
মহারাজ, এতক্ষণে কাজ নিকেশ হয়ে গেছে।
প্রতাপাদিত্য।
সে কী রকম কথা? তবে তুমি জান না?
পাঠান।
জানি বই কি। কাজ শেষ হয়ে গেছে ভুল নেই, তবে আমি সে-সময়ে উপস্থিত ছিলুম না। আমার ভাই হোসেন খাঁর উপর ভার আছে, সে খুব হুঁশিয়ার। মহারাজের পরামর্শমতে আমি খুড়ারাজা-সাহেবের লোকজনদের তফাত করেই চলে আসছি।
প্রতাপাদিত্য।
হোসেন যদি ফাঁকি দেয়?
পাঠান।
তোবা! সে তেমন বেইমান নয়। মহারাজ, আমি আমার শির জামিন রাখলুম।
প্রতাপাদিত্য।
আচ্ছা, এইখানে হাজির থাকো, তোমার ভাই ফিরে এলে বকশিশ মিলবে। (পাঠানের বাহিরে গমন) এটা যাতে প্রজারা টের না পায় সে চেষ্টা করতে হবে।
মন্ত্রী।
মহারাজ, এ-কথা গোপন থাকবে না।
প্রতাপাদিত্য।
কিসে তুমি জানলে?
মন্ত্রী।
আপনার পিতৃব্যের প্রতি বিদ্বেষ আপনি তো কোনোদিন লুকোতে পারেন নি। এমন-কি, আপনার কন্যার বিবাহেও আপনি তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন নি– তিনি বিনা নিমন্ত্রণেই এসেছিলেন। আর আজ আপনি অকারণে তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন আর পথে এই কাণ্ডটি ঘটল, এমন অবস্থায় প্রজারা আপনাকেই এর মূল বলে জানবে।
প্রতাপাদিত্য।
তাহলেই তুমি খুশি হও! না?
মন্ত্রী।
মহারাজ, এমন কথা কেন বলছেন? আপনার ধর্ম-অধর্ম পাপপুণ্যের বিচার আমি করি নে, কিন্তু রাজ্যের ভালোমন্দর কথাও যদি আমাকে ভাবতে না দেবেন তবে আমি আছি কী করতে? কেবল প্রতিবাদ করে মহারাজের জেদ বাড়িয়ে তোলবার জন্যে?
প্রতাপাদিত্য।
আচ্ছা, ভালোমন্দর কথাটা কী ঠাওরালে শুনি।
মন্ত্রী।
আমি এই কথা বলছি, পদে পদে প্রজাদের মনে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলবেন না। দেখুন মাধবপুরের প্রজারা খুব প্রবল এবং আপনার বিশেষ বাধ্য নয়। তারা রাজ্যের সীমানার কাছে থাকে, পাছে আপনার প্রতিবেশী শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দেয় এই ভয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা যায় না। সেইজন্য মাধবপুর-শাসনের ভার যুবরাজের উপর দেবার কথা আমিই মহারাজকে বলেছিলেম।
প্রতাপাদিত্য।
সে তো বলেছিলে। তার ফল কী হল দেখো না। আজ দু-বৎসরের খাজনা বাকি। সকল মহল থেকে টাকা এল, আর ওখান থেকে কী আদায় হল।
মন্ত্রী।
আজ্ঞে আশীর্বাদ। তেমন সব বজ্জাত প্রজাও যুবরাজের পায়ের গোলাম হয়ে গেছে। টাকার চেয়ে কি তার কম দাম? সেই যুবরাজের কাছ থেকে আপনি মাধবপুরের ভার কেড়ে নিলেন। সমস্তই উলটে গেল। এর চেয়ে তাঁকে না পাঠানোই ভালো ছিল। সেখানকার প্রজারা তো হন্যে কুকুরের মত খেপে রয়েছে, তার পরে আবার যদি এই কথাটা প্রকাশ হয় তা-হলে কী হয় বলা যায় না। রাজকার্যে ছোটোদেরও অবজ্ঞা করতে নেই মহারাজ! অসহ্য হলেই ছোটোরা জোট বাঁধে, জোট বাঁধলেই ছোটোরা বড়ো হয়ে ওঠে।
প্রতাপাদিত্য।
সেই ধনঞ্জয় বৈরাগী তো মাধবপুরে থাকে!
প্রতাপাদিত্য।
সেই বেটাই যত নষ্টের গোড়া। ধর্মের ভেক ধরে সেই তো যত প্রজাকে নাচিয়ে তোলে। সেই তো প্রজাদের পরামর্শ দিয়ে খাজনা বন্ধ করিয়েছে। উদয়কে বলেছিলুম যেমন করে হোক তাকে আচ্ছা করে শাসন করে দিতে। কিন্তু উদয়কে জান তো? এদিকে তার না আছে তেজ, না আছে পৌরুষ, কিন্তু একগুঁয়েমির অন্ত নেই। ধনঞ্জয়কে শাসন দূরে থাক তাকে আস্পর্ধা দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এবারে তার কন্ঠিসুদ্ধ কন্ঠ চেপে ধরতে হচ্ছে, তার পরে দেখা যাবে তোমার মাধবপুরের প্রজাদের কতবড়ো বুকের পাটা! আর দেখো, লোকজন আজই সব ঠিক করে রাখো– খবরটা পাবামাত্রই রায়গড়ে গিয়ে বসতে হবে। সেইখানেই শ্রাদ্ধশান্তি করব– আমি ছাড়া উত্তরাধিকারী আর তো কাউকে দেখি নে।
বসন্ত রায়ের প্রবেশ। প্রতাপাদিত্য চমকিয়া উঠিয়া দণ্ডায়মান
বসন্ত রায়।
আমাকে কিসের ভয় প্রতাপ? আমি তোমার পিতৃব্য; তাতেও যদি বিশ্বাস না হয়, আমি বৃদ্ধ, তোমার কোনো অনিষ্ট করি এমন শক্তিই নেই। (প্রতাপ নীরব) প্রতাপ একবার রায়গড়ে চলো– ছেলেবেলা কতদিন সেখানে কাটিয়েছ– তারপরে বহুকাল সেখানে যাও নি।
প্রতাপাদিত্য।
(নেপথ্যের দিকে চাহিয়া সগর্জনে) খবরদার! ঐ পাঠানকে ছাড়িস নে!
প্রতাপাদিত্য।
দেখো মন্ত্রী, রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ দেখা যাচ্ছে।
মন্ত্রী।
মহারাজ, এ বিষয়ে আমার কোনো অপরাধ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
এ বিষয়ের কথা তোমাকে কে বলছে? আমি বলছি রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ দেখছি। সেদিন তোমাকে চিঠি রাখতে দিলেম, হারিয়ে ফেললে! আর একদিন মনে আছে উমেশ রায়ের কাছে তোমাকে যেতে বলেছিলুম, তুমি লোক দিয়ে কাজ সেরেছিলে।
প্রতাপাদিত্য।
চুপ করো। দোষ কাটাবার জন্যে মিথ্যে চেষ্টা ক’রো না। যাহোক তোমাকে জানিয়ে রাখছি রাজকার্যে তুমি কিছুমাত্র মনোযোগ দিচ্ছ না। যাও, কাল রাত্রে যারা পাহারায় ছিল তাদের কয়েদ করো গে।
৫
সুরমা।
(বিভার গলা ধরিয়া) তুই অমন চুপ করে থাকিস কেন ভাই? যা মনে আছে বলিস নে কেন?
বিভা।
আমার আর কী বলবার আছে?
সুরমা।
অনেকদিন তাঁকে দেখিস নি। তা তুই-ই নাহয় তাঁকে একখানা চিঠি লেখ্ না। আমি তোর দাদাকে দিয়ে পাঠাবার সুবিধা করে দেব।
বিভা।
যেখানে তাঁর আদর নেই সেখানে আসবার জন্যে আমি কেন তাঁকে লিখব? তিনি আমাদের চেয়ে কিসে ছোটো?
সুরমা।
আচ্ছা গো আচ্ছা, না হয় তিনি খুব মানী, তাই বলে মানটাই কি সংসারে সকলের চেয়ে বড়ো হল? সেটা কি বিসর্জন করবার কোনো জায়গা নেই।
গান
ওর মানের এ বাঁধ টুটবে না কি টুটবে না?
ওর মনের বেদন থাকবে মনে
প্রাণের কথা ফুটবে না?
কঠিন পাষাণ বুকে লয়ে
নাই রহিল অটল হয়ে।
প্রেমেতে ঐ পাথর খ’য়ে
চোখের জল কি ছুটবে না?
আচ্ছা বিভা, তুই যদি পুরুষ হতিস তো কী করতিস? নিমন্ত্রণ-চিঠি না পেলে এক পা নড়তিস নে নাকি?
বিভা।
আমার কথা ছেড়ে দাও– কিন্তু তাই বলে–
সুরমা।
বিভা, শুনেছিস দাদামশায় এসে পৌঁছেছেন।
বিভা।
এখানে এলেন কেন ভাই? আবার তো কিছু বিপদ ঘটবে না?
সুরমা।
বিপদের মুখের উপর তেড়ে এলে বিপদ ছুটে পালায়।
বিভা।
না ভাই, আমার বুকের ভিতর এখনও কেঁপে উঠছে। আমার এমন একটা ভয় ধরে গেছে কিছুতে ছাড়ছে না –আমার মনে হচ্ছে কী যেন একটা হবে। মনে হচ্ছে যেন কাকে সাবধান করে দেবার আছে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আচ্ছা, তিনি আমাদের দেখতে এখনও এলেন না কেন?
আজ তোমারে দেখতে এলেম
অনেক দিনের পরে।
ভয় করো না সুখে থাকো
বেশিক্ষণ থাকব নাকো,
এসেছি দণ্ড দুয়ের তরে।
দেখব শুধু মুখখানি,
শোনাও যদি শুনব বাণী,
না হয় যাব আড়াল থেকে
হাসি দেখে দেশান্তরে।
সুরমা।
(বিভার চিবুক ধরিয়া) দাদামশায়, বিভার হাসি দেখবার জন্যে তো আড়ালে যেতে হল না। এবার তবে দেশান্তরের উদ্যোগ করো।
বসন্ত রায়।
না না, অত সহজে না। অমনি যে ফাঁকি দিয়ে হেসে তাড়াবে আমি তেমন পাত্র না। কেঁদে না তাড়ালে বুড়ো বিদায় হবে না। গোটা পনেরো নতুন গান আর একমাথা পুরানো পাকাচুল এনেছি সমস্ত নিকেশ না করে নড়ছি নে।
বিভা।
মিছে বড়াই কর কেন? আধমাথা বই চুলই নেই!
বসন্ত রায়।
(মাথায় হাত বুলাইয়া) ওরে সে একদিন গেছে রে ভাই। বললে বিশ্বাস করবি নে, বসন্ত রায়েরও মাথায় একেবারে মাথাভরা চুল ছিল। সেদিন কি আর এত রাস্তা পেরিয়ে তোদের খোশামোদ করতে আসতুম। সেদিন একটা চুল পেকেছে কি, অমনি পাঁচটা রূপসী তোলবার জন্যে উমেদার হত। মনের আগ্রহে কাঁচাচুল সুদ্ধ উজাড় করে দেবার জো করত।
সুরমা।
দাদামশায়, টাকের আলোচনা পরে হবে, এখন বিভার একটা যা হয় উপায় করে দাও।
বসন্ত রায়।
সেও কি আমাকে আবার বলতে হবে না কি? এতক্ষণ কী করছিলুম? এই যে বুড়োটা রয়েছে এ কি কোনো কাজেই লাগে না মনে করছ?
গান
মলিন মুখে ফুটুক হাসি জুড়াক দু-নয়ন
মলিন বসন ছাড়ো সখী পরো আভরণ।
অশ্রুধোয়া কাজলরেখা
আবার চোখে দিক না দেখা,
শিথিল বেণী তুলুক বেঁধে কুসুমবন্ধন।
বিভা।
দাদামশায়, সত্যি তুমি বাবার কাছে কিছু বলেছ?
বসন্ত রায়।
একটা কিছু যে বলেছি তার সাক্ষী আমি থাকতে থাকতেই হাজির হবে।
বিভা।
কেন এমন কাজ করতে গেলে?
বসন্ত রায়।
খুব করেছি বেশ করেছি।
বিভা।
না দাদামশায়, আমি ভারি রাগ করেছি।
বসন্ত রায়।
এই বুঝি বকশিশ! যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর!
বিভা।
না, সত্যি বলছি, কেন তুমি বাবাকে অনুরোধ করতে গেলে?
বসন্ত রায়।
দিদি, রাজার ঘরে যখন জন্মেছিস তখন অভিমান করে ফল নেই– এরা সব পাথর।
বিভা।
আমার নিজের জন্যে অভিমান করি বুঝি! তিনি যে মানী, তাঁর অপমান কেন হবে?
বসন্ত রায়।
আচ্ছা বেশ, সে আমার সঙ্গে তার বোঝাপড়া হবে। ওরে তুই এখন–
গান
পিলু বারোয়াঁ
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে
এগিয়ে নিয়ে আয়–
তারে এগিয়ে নিয়ে আয়।
চোখের জলে মিশিয়ে হাসি
ঢেলে দে তার পায়–
ওরে ঢেলে দে তার পায়।
আসছে পথে ছায়া পড়ে,
আকাশ এল আঁধার করে,
শুষ্ক কুসুম পড়ছে ঝরে
সময় বহে যায়–
ওরে সময় বহে যায়।
৬
ধনঞ্জয়।
একেবারে সব মুখ চুন করে আছিস কেন? মেরেছে বেশ করেছে। এতদিন আমার কাছে আছিস বেটারা এখনও ভালো করে মার খেতে শিখলি নে? হাড়গোড় সব ভেঙ্গে গেছে নাকি রে?
১।
রাজার কাছারিতে ধরে মারলে সে বড়ো অপমান!
ধনঞ্জয়।
আমার চেলা হয়েও তোদের মানসম্ভ্রম আছে? এখনো সবাই তোদের গায়ে ধুলো দেয় না রে? তবে এখনও তোরা ধরা পড়িস নি? তবে এখনও আরও অনেক বাকি আছে!
২।
বাকি আর রইল কী ঠাকুর। এদিকে পেটের জ্বালায় মরছি, ওদিকে পিঠের জ্বালাও ধরিয়ে দিলে।
ধনঞ্জয়।
বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে– একবার খুব করে নেচে নে!
গান
আরো আরো প্রভু আরো আরো।
এমনি করে আমায় মারো।
লুকিয়ে থাকি আমি পালিয়ে বেড়াই,
ধরা পড়ে গেছি আর কি এড়াই?
যা কিছু আছে সব কাড়ো কাড়ো।
এবার যা করবার তা সারো সারো।
আমি হারি কিংবা তুমিই হার!
হাটে ঘাটে বাটে করি মেলা,
কেবল হেসে খেলে গেছে বেলা,
দেখি কেমনে কাঁদাতে পার।
২।
আচ্ছা ঠাকুর, তুমি কোথায় চলেছ বলো দেখি।
৩।
কী সর্বনাশ! সেখানে কী করতে যাচ্ছ?
ধনঞ্জয়।
একবার রাজাকে দেখে আসি। চিরকাল কি তোদের সঙ্গেই কাটাব? এবার রাজদরবারে নাম রেখে আসব।
৪।
তোমার উপরে রাজার যে ভারি রাগ। তার কাছে গেলে কি তোমার রক্ষা আছে?
৫।
জান তো যুবরাজ তোমাকে শাসন করতে চায় নি বলে তাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
ধনঞ্জয়।
তোরা যে মার সইতে পারিস নে। সেই জন্যে তোদের মারগুলো সব নিজের পিঠে নেবার জন্যে স্বয়ং রাজার কাছে চলেছি। পেয়াদা নয় রে পেয়াদা নয়– যেখানে স্বয়ং মারের বাবা বসে আছে সেইখানে ছুটেছি।
১।
না, না, সে হবে না ঠাকুর, সে হবে না।
ধনঞ্জয়।
খুব হবে– পেট ভরে হবে, আনন্দে হবে!
১।
তবে আমরাও তোমার সঙ্গে যাব।
ধনঞ্জয়।
পেয়াদার হাতে আশ মেটে নি বুঝি?
২।
না ঠাকুর, সেখানে একলা যেতে পারছ না, আমরাও সঙ্গে যাব।
ধনঞ্জয়।
আচ্ছা, যেতে চাস তো চল্। এক বার শহরটা দেখে আসবি।
৩।
কিছু হাতিয়ার সঙ্গে নিতে হবে।
ধনঞ্জয়।
কেন রে? হাতিয়ার নিয়ে কী করবি?
৩।
যদি তোমার গায়ে হাত দেয় তাহলে–
ধনঞ্জয়।
তা হলে তোরা দেখিয়ে দিবি হাত দিয়ে না মেরে কী করে হাতিয়ার দিয়ে মারতে হয়। কী আমার উপকারটা করতেই যাচ্ছ! তোদের যদি এই রকম বুদ্ধি হয় তবে এইখানেই থাক্।
৪।
না, না, তুমি যা বলবে তাই করব কিন্তু আমরা তোমার সঙ্গে থাকব।
৩।
আমরাও রাজার কাছে দরবার করব।
ধনঞ্জয়।
বেশ, বেশ, অর্ধেক রাজত্ব চাইবি নে?
ধনঞ্জয়।
ঠাট্টা কেন করব? সব রাজত্বটাই কি রাজার? অর্ধেক রাজত্ব প্রজার নয় তো কী? চাইতে দোষ নেই রে। চেয়ে দেখিস।
ধনঞ্জয়।
তখন আবার চাইব। তুই কি ভাবিস রাজা একলা শোনে? আরও একজন শোনবার লোক রাজদরবারে বসে থাকেন– শুনতে শুনতে তিনি একদিন মঞ্জুর করেন, তখন রাজার তাড়াতে কিছুই ক্ষতি হয় না।
গান
আমরা বসব তোমার সনে।
তোমার শরিক হব রাজার রাজা,
তোমার আধেক সিংহাসনে।
তোমার দ্বারী মোদের করেছে শির নত,
তারা জানে না যে মোদের গরব কত,
তাই বাহির হতে তোমায় ডাকি
তুমি ডেকে লও গো আপন জনে।
প্রায়শ্চিত্তঃ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় অঙ্ক
১
চন্দ্রদ্বীপ। রাজা রামচন্দ্র রায়ের কক্ষ
রামচন্দ্র, রমাই ভাঁড়, ফর্নাণ্ডিজ ও মন্ত্রী
রামচন্দ্র।
(তামাকু টানিয়া) ওহে রমাই।
ফর্নাণ্ডিজ।
(হাততালি দিয়া) হিঃ হিঃ হিঃ– হিঃ হিঃ হিঃ।
রমাই।
পরম্পরায় শুনা গেল, সেনাপতি মশাইয়ের ঘরে চোর পড়েছিল।
রামচন্দ্র।
(চোখ টিপিয়া) তার পরে?
রমাই।
নিবেদন করি মহারাজ। (ফর্নাণ্ডিজ তাঁর কোর্তার বোতাম খুলছেন ও দিচ্ছেন) আজ দিন তিন-চার ধরে সেনাপতি মশাইয়ের ঘরে রাত্রে চোর আনাগোনা করছিল। সাহেবের ব্রাহ্মণী জানতে পেরে কর্তাকে অনেক ঠেলাঠেলি করেন, কিন্তু কোনোমতেই কর্তার ঘুম ভাঙাতে পারেন নি।
রামচন্দ্র।
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
মন্ত্রী।
হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ।
রমাই।
তারপর দিনের বেলায় গৃহিণীর নিগ্রহ আর সইতে না পেরে জোড় হস্তে বললেন, “দোহাই তোমার, আজ রাত্রে চোর ধরব।” রাত্রি দুই দণ্ডের সময় গিন্নী বললেন, “ওগো চোর এসেছে।” কর্তা বললেন, “ওই যাঃ ঘরে যে আলো জ্বলছে!” চোরকে ডেকে বললেন,”আজ তুই বড়ো বেঁচে গেলি। ঘরে আলো আছে, আজ নিরাপদে পালাতে পারবি, কাল আসিস দেখি– অন্ধকারে কেমন না ধরা পড়িস।”
রমাই।
জানি না, কী কারণে চোরের যথেষ্ট ভয় হল না তার পর রাত্রেও ঘরে এল। গিন্নী বললেন, “সর্বনাশ হল, ওঠ।” কর্তা বললেন, “তুমি ওঠ না।” গিন্নী বললেন, “আমি উঠে কী করব?” কর্তা বললেন, “কেন, ঘরে একটা আলো জ্বালাও না, কিছু যে দেখতে পাচ্ছি না।” গিন্নী বিষম ক্রুদ্ধ; কর্তা ততোধিক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “দেখো দেখি। তোমার জন্যই তো যথাসর্বস্ব গেল। আলোটা জ্বালাও। বন্দুকটা আনো।” ইতিমধ্যে চোর কাজকর্ম সেরে বললে, “মশাই এক ছিলিম তামাক খাওয়াতে পারেন? বড়ো পরিশ্রম হয়েছে।” কর্তা বিষম ধমক দিয়ে বললেন,” রোস বেটা! আমি তামাক সেজে দিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে আসবি তো এই বন্দুকে তোর মাথা উড়িয়ে দেব।” তামাক খেয়ে চোর বললে,”মশাই, আলোটা যদি জ্বালেন তো বড়ো উপকার হয়। সিঁদকাটিটা পড়ে গেছে, খুঁজে পাচ্ছি না।” সেনাপতি বললেন, “বেটার ভয় হয়েছে। তফাতে থাক্, কাছে আসিস নে।” বলে তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে দিলেন। ধীরে সুস্থে জিনিসপত্র বেঁধে চোর তো চলে গেল। কর্তা গিন্নীকে বললেন,”বেটা বিষম ভয় পেয়েছে।”
রামচন্দ্র।
রমাই, শুনেছ আমি শ্বশুরালয়ে যাচ্ছি?
রমাই।
(মুখভঙ্গি করিয়া) অসারং খলু সংসারং সারং শ্বশুরমন্দিরং (সকলের হাস্য) কথাটা মিথ্যা নয় মহারাজ! (দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলিয়া) শ্বশুরমন্দিরের সকলই সার– আহারটা, সমাদরটা; দুধের সরটি পাওয়া যায়, মাছের মুড়োটি পাওয়া যায়; সকলই সারপদার্থ! কেবল সর্বাপেক্ষা অসার ওই যিনি–
রামচন্দ্র।
(হাসিয়া) সে কী হে, তোমার অর্ধাঙ্গ–
রমাই।
(জোড়হস্তে ব্যাকুলভাবে) মহারাজ তাকে অর্ধাঙ্গ বলবেন না। তিন জন্ম তপস্যা করলে আমি বরঞ্চ একদিন তার অর্ধাঙ্গ হতে পারব এমন ভরসা আছে। আমার মতন পাঁচটা অর্ধাঙ্গ জুড়লেও তার আয়তনে কুলোয় না।
রামচন্দ্র।
আমি তো শুনেছি, তোমার ব্রাহ্মণী বড়োই শান্তস্বভাবা, ঘরকন্নায় বিশেষ পটু।
রমাই।
সেকথায় কাজ কী! ঘরে আর সকল রকমই জঞ্জাল আছে, কেবল আমি তিষ্ঠতে পারি না। প্রত্যুষে গৃহিণী এমনি ঝেঁটিয়ে দেন যে একেবারে মহারাজের দুয়ারে এসে পড়ি।
রামচন্দ্র।
ওহে রমাই, তোমাকে এবার যে যেতে হবে, সেনাপতিকে সঙ্গে নেব। (সেনাপতিকে) যাত্রার জন্য সমস্ত উদ্যোগ করো। আমার চৌষট্টি দাঁড়ের নৌকা যেন প্রস্তুত থাকে।
রামচন্দ্র।
রমাই, তুমি তো সমস্তই শুনেছ। গতবারে শ্বশুরালয়ে আমাকে বড়োই মাটি করেছিল!
রমাই।
আজ্ঞে হাঁ, মহারাজের লেজ বানিয়ে দিয়েছিল।
রামচন্দ্র।
(কাষ্ঠ হাসিয়া তাম্রকূট সেবন)
রমাই।
আপনার এক শ্যালক এসে আমাকে বললেন, বাসরঘরে তোমাদের রাজার লেজ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি রামচন্দ্র না রামদাস? এমন তো পূর্বে জানতাম না। আমি তৎক্ষণাৎ বললুম, “পূর্বে জানবেন কী করে? পূর্বে তো ছিল না। আপনাদের ঘরে বিবাহ করতে এসেছেন, তাই যস্মিন্ দেশে যদাচার।”
রামচন্দ্র।
রমাই, এবারে গিয়ে জিতে আসতে হবে। যদি জয় হয় তবে তোমাকে আমার আংটি উপহার দেব।
রমাই।
মহারাজ, জয়ের ভাবনা কী? রমাইকে যদি অন্তঃপুরে নিয়ে যেতে পারেন, তবে স্বয়ং শাশুড়ীঠাকরুনকে পর্যন্ত মনের সাধে ঘোল খাইয়ে আসতে পারি।
রামচন্দ্র।
তার ভাবনা? তোমাকে আমি অন্তঃপুরেই নিয়ে যাব।
রমাই।
আপনার অসাধ্য কী আছে?
২
পথপার্শ্বে ধনঞ্জয় বৈরাগী ও মাধবপুরের একদল প্রজা
১।
বাবাঠাকুর, রাজার কাছে যাচ্ছ, কিন্তু তিনি তোমাকে সহজে ছাড়বেন না।
ধনঞ্জয়।
ছাড়বেন কেন বাপসকল! আদর করে ধরে রাখবেন।
ধনঞ্জয়।
ধরে রাখতে কষ্ট আছে বাপ– পাহারা দিতে হয়– যে-সে লোককে কি রাজা এত আদর করে? রাজবাড়িতে কত লোক যায়, দরজা থেকেই ফেরে– আমাকে ফেরাবে না।
গান
আমাকে যে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন,
সে কি অমনি হবে!
আপনাকে সে বাঁধা দিয়ে আমায় দেবে বাঁধন।
সে কি অমনি হবে!
আমাকে যে দুঃখ দিয়ে আনবে আপন বশে–
সে কি অমনি হবে!
তার আগে তার পাষাণ হিয়া গলবে করুণ রসে
সে কি অমনি হবে!
আমাকে যে কাঁদাবে তার ভাগ্যে আছে কাঁদন
সে কি অমনি হবে!
২।
বাবাঠাকুর, তোমার গায়ে যদি রাজা হাত দেন তাহলে কিন্তু আমরা সইতে পারব না।
ধনঞ্জয়।
আমার এই গা যাঁর তিনি যদি সইতে পারেন বাবা, তবে তোমাদেরও সইবে। যেদিন থেকে জন্মেছি আমার এই গায়ে তিনি কত দুঃখই সইলেন– কত মার খেলেন, কত ধুলোই মাখলেন– হায় হায়–
কে বলেছে তোমায় বঁধু এত দুঃখ সইতে?
আপনি কেন এলে বঁধু আমার বোঝা বইতে?
প্রাণের বন্ধু বুকের বন্ধু
সুখের বন্ধু দুখের বন্ধু
(তোমায়) দেব না দুখ পাব না দুখ
হেরব তোমার প্রসন্ন মুখ,
(আমি) সুখে দুঃখে পারব বন্ধু চিরানন্দে রইতে–
তোমার সঙ্গে বিনা কথায় মনের কথা কইতে।
৩।
বাবা, আমরা রাজাকে গিয়ে কী বলব?
ধনঞ্জয়।
বলব, আমরা খাজনা দেব না।
ধনঞ্জয়।
বলব, ঘরের ছেলেমেয়েকে কাঁদিয়ে যদি তোমাকে টাকা দিই তা হলে আমাদের ঠাকুর কষ্ট পাবে। যে অন্নে প্রাণ বাঁচে সেই অন্নে ঠাকুরের ভোগ হয়; তিনি যে প্রাণের ঠাকুর। তার বেশি যখন ঘরে থাকে তখন তোমাকে দিই– কিন্তু ঠাকুরকে ফাঁকি দিয়ে তোমাকে খাজনা দিতে পারব না।
৪।
বাবা, এ কথা রাজা শুনবে না।
ধনঞ্জয়।
তবু শোনাতে হবে। রাজা হয়েছে বলেই কি সে এমন হতভাগা যে ভগবান তাকে সত্য কথা শুনতে দেবেন না? ওরে জোর করে শুনিয়ে আসব।
৫।
ও ঠাকুর, তাঁর জোর যে আমাদের চেয়ে বেশি– তাঁরই জিত হবে।
ধনঞ্জয়।
দূর বাঁদর, এই বুঝি তোদের বুদ্ধি! যে হারে তার বুঝি জোর নেই! তার জোর যে একেবারে বৈকুন্ঠ পর্যন্ত পৌঁছোয় তা জানিস?
৬।
কিন্তু ঠাকুর, আমরা দূরে ছিলুম, লুকিয়ে বাঁচতুম– একেবারে রাজার দরজায় গিয়ে পড়ব, শেষে দায়ে ঠেকলে আর পালাবার পথ থাকবে না।
ধনঞ্জয়।
দেখ্ পাঁচকড়ি, অমন চাপাচুপি দিয়ে রাখলে ভালো হয় না। যতদূর পর্যন্ত হবার তা হতে দে, নইলে কিছুই শেষ হতে চায় না। যখন চূড়ান্ত হয় তখনই শান্তি হয়।
৭।
তোরা অত ভয় করছিস কেন? বাবা যখন আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন উনি আমাদের বাঁচিয়ে আনবেন।
ধনঞ্জয়।
তোদের এই বাবা যার ভরসায় চলেছে তার নাম কর্। বেটারা কেবল তোরা বাঁচতেই চাস্– পণ করে বসেছিস যে মরবি নে। কেন, মরতে দোষ কী হয়েছে? যিনি মারেন তাঁর গুণগান করবি নে বুঝি! ওরে সেই গানটা ধর্।
গান
বলো ভাই ধন্য হরি।
বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি।
ধন্য হরি সুখের নাটে,
ধন্য হরি রাজ্যপাটে।
ধন্য হরি শ্মশান-ঘাটে–
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
সুধা দিয়ে মাতান যখন
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
ব্যথা দিয়ে কাঁদান যখন
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
আত্মজনের কোলে বুকে
ধন্য হরি হাসিমুখে–
ছাই দিয়ে সব ঘরের সুখে
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
আপনি কাছে আসেন হেসে
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
খুঁজিয়ে বেড়ান দেশে দেশে
ধন্য হরি, ধন্য হরি।
ধন্য হরি স্থলে জলে,
ধন্য হরি ফুলে ফলে–
ধন্য হৃদয়পদ্মদলে
চরণ-আলোয় ধন্য করি।
৩
রামমোহনের প্রবেশ ও প্রণাম
বিভা।
মোহন তুই এতদিন আসিস নি কেন?
রামমোহন।
তা মা, কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়, তুমি কোন্ আমাকে মনে করেছ? সে-কথা বলো। একবার ডাকলেই তো হত। অমনি লজ্জা হল। আর মুখে উত্তরটি নেই! না না, মা, অবসর পাই নে বলেই আসতে পারি নে– নইলে মনে মনে ওই চরণপদ্ম দুখানি কখনো তো ভুলি নে।
বিভা।
মোহন তুই বোস, তোদের দেশের গল্প আমায় বল্।
রাম।
মা, তোমার জন্যে চারগাছি শাঁখা এনেছি, তোমাকে ওই হাতে পরতে হবে, আমি দেখব।
বিভা।
(স্বর্ণালংকার খুলিয়া, হাতে শাঁখা পরিয়া) এই দেখো মা। মোহন তোমার চুড়ি খুলে আমায় চারগাছি শাঁখা পরিয়ে দিয়েছে।
মহিষী।
(হাসিয়া) তা বেশ তো মানিয়েছে। মোহন, এই বারে তোর সেই আগমনী গানটি গা। তোর গান শুনতে আমার বড়ো ভালো লাগে।
রামমোহন।
গান
সারা বরষ দেখি নে মা,
মা তুই আমার কেমন ধারা
নয়নতারা হারিয়ে আমার–
অন্ধ হল নয়নতারা।
এলি কি পাষাণী ওরে,
দেখব তোরে আঁখি ভরে,
কিছুতেই থামে না যে মা
পোড়া এ নয়নের ধারা।
মহিষী।
মোহন চল্, তোকে খাইয়ে আনি গে।
[ রামমোহন ও মহিষীর প্রস্থান
সুরমা ও বসন্ত রায়ের প্রবেশ
বসন্ত রায়।
সুরমা, ও সুরমা। একবার দেখে যাও। তোমাদের বিভার মুখখানি দেখো। বয়স যদি না যেত তো আজ তোর ওই মুখ দেখে এইখানে মাথা ঘুরে পড়তুম আর মরতুম। হায় হায়– মরবার বয়স গেছে! যৌবনকালে ঘড়ি ঘড়ি মরতুম। বুড়োবয়সে রোগ না হলে আর মরণ হয় না।
গান
হাসিরে কি লুকাবি লাজে
চপলা সে বাঁধা পড়ে না যে।
রুধিয়া অধর-দ্বারে
ঝাঁপিতে চাহিলি তারে
অমনি সে ছুটে এল নয়নমাঝে।
৪
না বলে যেয়ো না চলে মিনতি করি!
গোপনে জীবন মন লইয়া হরি।
সারা নিশি জেগে থাকি,
ঘুমে ঢুলে পড়ে আঁখি,
ঘুমালে হারাই পাছে সে ভয়ে মরি।
চকিতে চমকি বঁধু, তোমারে খুঁজি
থেকে থেকে মনে হয় স্বপন বুঝি!
নিশিদিন চাহে হিয়া
পরান পসারি দিয়া
অধীর চরণ তব বাঁধিয়া ধরি।
[ রামচন্দ্র রায় মাঝে মাঝে বাহবা দিতেছেন, মাঝে মাঝে উৎকন্ঠিত
হইয়া দ্বারের দিকে চাহিতেছেন ]
রামচন্দ্র।
(দ্বারের কাছে উঠিয়া আসিয়া অনুচরের প্রতি) রমাইয়ের খবর কী?
রামচন্দ্র।
এখনও ফিরল না কেন? ধরা পড়ে নি তো?
অনুচর।
হুজুর, বলতে তো পারি নে।
রামচন্দ্র।
(ফিরিয়া আসিয়া আসনে বসিয়া) গাও, গাও, তোমরা গাও! কিন্তু ওটা নয়– একটা জলদ তাল লাগাও!
ও যে মানে না মানা।
আঁখি ফিরাইলে বলে, “না, না, না।’
যত বলি “নাই রাতি,
মলিন হয়েছে বাতি,’
মুখপানে চেয়ে বলে, “না, না, না।’
বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে
ফাগুন করিছে হাহা ফুলের বনে।
আমি যত বলি “তবে
এবার যে যেতে হবে’
দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, “না, না, না।’
রামচন্দ্র।
এ কী রকম হল! গান শুনে যে কেবলই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে!
রামমোহন।
শীঘ্র আসুন আর দেরি করবেন না।
রামচন্দ্র।
চমৎকার গান জমেছে– এখন আর বিরক্ত করিস নে।
রামমোহন।
যুবরাজ ডেকে পাঠিয়েছেন– বিশেষ কথা আছে।
রামচন্দ্র।
আচ্ছা, তোমরা গান করো, আমি আসছি। রমাইয়ের কী হল জান? এখনও সে এলো না কেন?
৫
প্রতাপাদিত্য ও লছমন সর্দার
প্রতাপাদিত্য।
দেখো লছমন, আজ রাত্রে আমি রামচন্দ্র রায়ের ছিন্ন মুণ্ডু দেখতে চাই।
লছমন।
(সেলাম করিয়া) যো হুকুম মহারাজ!
রাজশ্যালক।
(পদতলে পড়িয়া) মহারাজ, মার্জনা করুন, বিভার কথা একবার মনে করুন। অমন কাজ করবেন না।
প্রতাপাদিত্য।
কী মুশকিল! আজ রাত্রে এরা আমাকে ঘুমোতে দেবে না নাকি।
রাজশ্যালক।
মহারাজ, রাজজামাতা এখন অন্তঃপুরে আছেন। তাঁকে মার্জনা করুন। লছমনকে সেখানে যেতে নিষেধ করুন। তাতে আপনার অন্তঃপুরের অবমাননা হবে।
প্রতাপাদিত্য।
এখন আমার ঘুমোবার সময়। কাল সকালে তোমাদের দরবার শোনা যাবে। তুমি বলছ রাজজামাতা এখন অন্তঃপুরে। আচ্ছা, লছমন।
প্রতাপাদিত্য।
কাল সকালে রামচন্দ্র যখন শয়নঘর হতে বাহিরে আসবে তখন আমার আদেশ পালন করবে। এখন সব যাও– আমার ঘুমের ব্যাঘাত ক’রো না।
বসন্ত রায়।
প্রতাপ! (প্রতাপাদিত্য নিরুত্তরে নিদ্রার ভান করিয়া রহিলেন) বাবা প্রতাপ। (প্রতাপাদিত্য নিরুত্তর) বাবা প্রতাপ, এও কি সম্ভব?
প্রতাপাদিত্য।
(দ্রুত বিছানায় উঠিয়া বসিয়া) কেন সম্ভব নয়?
বসন্ত রায়।
ছেলেমানুষ, অপরিণামদর্শী, সে কি তোমার ক্রোধের যোগ্য পাত্র?
প্রতাপাদিত্য।
ছেলেমানুষ! আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায় এ বোঝবার বয়স তার হয় নি? ছেলেমানুষ! কোথাকার একটা লক্ষ্মীছাড়া মূর্খ ব্রাহ্মণ, নির্বোধদের কাছে দাঁত দেখিয়ে যে রোজকার করে খায়, তাকে স্ত্রীলোক সাজিয়ে, আমার মহিষীর সঙ্গে বিদ্রূপ করবার জন্যে এনেছে– এতটা বুদ্ধি যার জোগাতে পারে, তার ফল কী হতে পারে সে-বুদ্ধিটা আর তার মাথায় জোগাল না! দুঃখ এই, বুদ্ধিটা যখন মাথায় জোগাবে, তখন তার মাথাও শরীরে থাকবে না।
বসন্ত রায়।
আহা, সে ছেলেমানুষ। সে কিছুই বোঝে না।
প্রতাপাদিত্য।
দেখো পিতৃব্যঠাকুর, যশোরের রায়-বংশের কিসে মান-অপমান সে জ্ঞান যদি তোমার থাকবে, তবে কি ওই পাকা মাথার উপর মোগল-বাদশার শিরোপা জড়িয়ে বেড়াতে পার। তোমার ওই মাথাটা ধূলিতে লুটাবার সাধ ছিল, বিধাতার বিড়ম্বনায় তাতে বাধা পড়ল। এই তোমাকে স্পষ্টই বললুম। খুড়ামহাশয় এখন আমার নিদ্রার সময়।
[ বসন্ত রায়ের দিকে পিছন করিয়া চোখ বুজিয়া শয়ন
বসন্ত রায়।
প্রতাপ আমি সব বুঝেছি – তুমি যখন একবার ছুরি তোল তখন সে ছুরি একজনের উপর পড়তেই চায়, আমি তার লক্ষ্য হতে সরে পড়লুম বলে আর-এক জন তার লক্ষ্য হয়েছে। ভালো প্রতাপ, তোমার ক্ষুধিত ক্রোধ একজনকে যদি গ্রাস করতেই চায়, তবে আমাকেই করুক। প্রতাপ। (প্রতাপ নিদ্রার ভানে নিরুত্তর) প্রতাপ। (প্রতাপ নিরুত্তর) বাবা, প্রতাপ, একবার বিভার কথা ভেবে দেখো। (প্রতাপ নিরুত্তর) করুণাময় হরি।
৬
প্রথমা।
কই, এখনও তো ফিরলেন না!
দ্বিতীয়া।
আর তো ভাই পারি নে। ঘুম পেয়ে আসছে।
তৃতীয়া।
ফের কি সভা জমবে নাকি?
প্রথমা।
কেউ যে জেগে আছে তা তো বোধ হচ্ছে না! এতবড়ো রাজবাড়ি সমস্ত যেন হাঁ হাঁ করছে।
দ্বিতীয়া।
চাকররাও সব-হঠাৎ কে কোথায় যেন চলে গেল!
তৃতীয়া।
বাতিগুলো সব নিবে আসছে, কেউ জ্বালিয়ে দেবে না?
প্রথমা।
আমার কেমন ভয় করছে ভাই।
দ্বিতীয়া।
(বাদকদিগকে দেখাইয়া দিয়া) ওরাও যে সব ঘুমোতে লাগল– কী মুশকিলেই পড়া গেল। ওদের তুলে দে না। কেমন গা ছম ছম করছে।
তৃতীয়া।
মিছে না ভাই! একটা গান ধর্। ওগো তোমরা ওঠো ওঠো।
বাদকগণ।
(ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া) অ্যাঁ অ্যাঁ! এসেছেন নাকি?
প্রথমা।
তোমরা একবার বেরিয়ে গিয়ে দেখো না গো। কেউ কোথাও নেই। আমাদের আজকে বিদায় দেবে না নাকি?
একজন বাদক।
(বাহিরে গিয়া ফিরিয়া আসিয়া) ওদিকে যে সব বন্ধ।
প্রথমা।
অ্যাঁ। বন্ধ! আমাদের কি কয়েদ করলে নাকি?
দ্বিতীয়া।
দূর। কয়েদ করতে যাবে কেন?
তৃতীয়া।
গান
নয়ন মেলে দেখি আমায় বাঁধন বেঁধেছে।
গোপনে কে এমন করে ফাঁদ ফেঁদেছে।
বসন্ত-রজনীশেষে
বিদায় নিতে গেলেম হেসে
যাবার বেলায় বঁধু আমায় কাঁদিয়ে কেঁদেছে।
প্রথমা।
তোর সকল সময়েই গান। ভালো লাগছে না। কী হল বুঝতে পারছি নে।
৭
বিভা,উদয়াদিত্য, রামচন্দ্র রায় ও সুরমা। বসন্ত রায়ের প্রবেশ
বসন্ত রায়কে দেখিয়া মুখে কাপড় ঢাকিয়া বিভা কাঁদিয়া উঠিল
বসন্ত রায়।
(উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া) দাদা, একটা উপায় করো।
উদয়াদিত্য।
অন্তঃপুরের প্রহরীদের জন্যে আমি ভাবি নে। সদর-দরজায় এই প্রহরে যে দু-জন পাহারা দেয় তারাও আমার বশ আছে। কিন্তু দেখলুম বড়ো ফটক বন্ধ, সে তো পার হবার উপায় নেই।
বসন্ত রায়।
উপায় নেই বললে চলবে কেন? উপায় যে করতেই হবে। দাদা, চলো।
উদয়াদিত্য।
যদি বা ফটক পার হওয়া যায়, এ-রাজ্য থেকে পালাবে কী করে?
রামচন্দ্র।
আমার চৌষট্টি দাঁড়ের ছিপ রয়েছে, একবার তাতে চড়ে বসতে পারলে আমি আর কাউকে ভয় করি নে।
বসন্ত রায়।
সে-নৌকা কোথায় আছে ভাই?
উদয়াদিত্য।
সে-নৌকা আমি রাজবাটীর দক্ষিণ পাশের খালের মধ্যে আনিয়ে রেখেছি। কিন্তু সে-পর্যন্ত পৌঁছোব কী করে?
রামচন্দ্র।
রামমোহন কোথায় গেল?
উদয়াদিত্য।
সে বন্ধ ফটকের উপর খাঁচার সিংহের মতো বৃথা ধাক্কা মারছে, তাতে কোনো ফল হবে না।
বিভা।
খাল তো দূরে নয়। তোমার দক্ষিণের ঘরের জানালার একেবারে নিচেই তো খাল।
উদয়াদিত্য।
সে যে অনেক নিচে। লাফিয়ে পড়া চলে না তো।
সুরমা।
(উদয়াদিত্যকে মৃদুস্বরে) আমাদের এখানে যে দাঁড়িয়ে থাকলে কোনো ফল হবে তা তো বোধ হয় না। মহারাজ কি শুতে গিয়েছেন?
বসন্ত রায়।
হাঁ শুতে গিয়েছেন, রাত তো কম হয় নি।
সুরমা।
মা কি একবার তাঁর কাছে গিয়ে–
উদয়াদিত্য।
মা এ-সমস্ত কিছুই জানেন না। জানলে তিনি কান্নাকাটি করে এমনি গোলমাল বাধিয়ে তুলবেন যে, আর কোনো উপায় থাকবে না। জানই তো তিনি মহারাজের কাছে কিছু বলতে গেলে সমস্তই উলটো হবে– মাঝের থেকে কেবল তিনিই অস্থির হয়ে উঠবেন।
সুরমা।
বিভা, কাঁদিস নে বিভা। এ কখনো ঘটতেই পারে না। এ একটা স্বপ্ন– এ সমস্তই কেটে যাবে।
রামচন্দ্র।
কী রামমোহন– কী করবি বল্।
রামমোহন।
যতক্ষণ আমার প্রাণ আছে ততক্ষণ–
রামচন্দ্র।
আরে তোর প্রাণ নিয়ে আমার কী হবে? এখন পালাবার উপায় কী?
রামমোহন।
মহারাজ, তুমি যদি ভয় না কর, আমি এক কাজ করতে পারি।
রামমোহন।
তোমাকে পিঠে করে নিয়ে রাজবাটীর ছাতের উপর থেকে আমি খালের মধ্যে লাফিয়ে পড়তে পারি।
বসন্ত রায়।
কী সর্বনাশ! সে কি হয়।
রামচন্দ্র।
না সে হবে না। আর একটা সহজ উপায় কিছু বল্।
রামমোহন।
যুবরাজ, আমাকে গোটাকতক মোটা চাদর এনে দাও– পাকিয়ে শক্ত করে দক্ষিণের দরজার সঙ্গে বেঁধে নিচে ঝুলিয়ে দিই।
উদয়াদিত্য।
ঠিক বলেছিস রামমোহন। বিপদের সময় সব চেয়ে সহজ কথাটাই মাথায় আসে না। চল্ চল্।
বিভা।
মোহন, কোনো ভয় নেই তো?
রামমোহন।
কোনো ভয় নেই মা! আমি দড়ি বেয়ে স্বচ্ছন্দে নামিয়ে নিয়ে যাব। জয় মা কালী।
৮
মহিষী।
কী হল বুঝতে পারছি নে তো। সকলকেই খাওয়ালুম কিন্তু মোহনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি-নে কেন? বামী।
বামীর প্রবেশ
এদিককার খাওয়াদাওয়া তো সব শেষ হল মোহনকে খুঁজে পাচ্ছিনে কেন?
বামী।
মা তুমি অত ভাবছ কেন? তুমি শুতে যাও, রাত যে পুইয়ে এল, তোমার শরীরে সইবে কেন?
মহিষী।
সে কি হয়। আমি যে তাকে নিজে বসিয়ে খাওয়াব বলে রেখেছি।
বামী।
সে নিশ্চয় রাজকুমারীর মহলে গেছে, তিনি তাকে খাইয়েছেন। তুমি চলো, শুতে চলো।
মহিষী।
আমি তো ও-মহলে খোঁজ করতে যাচ্ছিলুম, দেখি সব দরজা বন্ধ– এর মানে কী, কিছু তো বুঝতে পারছি নে।
বামী।
বাড়িতে গোলমাল দেখে রাজকুমারী তাঁর মহলের দরজা বন্ধ করেছেন। অনেক দিন পরে জামাই এসেছেন, আজ লোকজনের ভিড় সইবে কেন? চলো তুমি শুতে চলো।
মহিষী।
কী জানি বামী আজ ভালো লাগছে না। প্রহরীদের ডাকতে বললুম, তাদের কারো কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না।
বামী।
যাত্রা হচ্ছে, তারা তাই আমোদ করতে গেছে।
মহিষী।
মহারাজ জানতে পারলে যে তাদের আমোদ বেরিয়ে যাবে। উদয়ের মহলও যে বন্ধ, তারা ঘুমিয়েছে বুঝি!
বামী।
ঘুমোবেন না! বল কী! রাত কম হয়েছে?
মহিষী।
গানবাজনা ছিল, জামাইকে নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করবে না! ওরা মনে কী ভাববে বল্ তো? এ-সমস্তই ওই বউমার কাণ্ড। একটু বিবেচনা নেই। রোজই তো ঘুমোচ্ছে– একটা দিন কি আর–
বামী।
মা, সে-সব কথা কাল হবে– আজ চলো।
মহিষী।
মঙ্গলার সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে তো?
৯
প্রতাপাদিত্য, প্রহরী, পীতাম্বর। অনুচরের প্রবেশ
পীতাম্বর।
এখনও চার দণ্ড রাত আছে।
প্রতাপাদিত্য।
কী যেন একটা গোলমাল শুনলুম।
পীতাম্বর।
আজ্ঞে হাঁ তাই শুনেই আমি আসছি।
পীতাম্বর।
আসবার সময় দেখলুম বাইরের প্রহরীরা দ্বারে নেই।
প্রতাপাদিত্য।
অন্তঃপুরের প্রহরীরা?
পীতাম্বর।
হাতপা-বাঁধা পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্য।
তারা কী বললে
পীতাম্বর।
আমার কথায় কোনো জবাব দিলে না– হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্য।
রামচন্দ্র রায় কোথায়? উদয়াদিত্য, বসন্ত রায় কোথায়?
পীতাম্বর।
বোধ করি তাঁরা অন্তঃপুরেই আছেন।
প্রতাপাদিত্য।
বোধ করি! তোমার বোধ করার কথা কে জিজ্ঞাসা করছে? মন্ত্রীকে ডাকো।
মন্ত্রী।
মহারাজ, রাজজামাতা–
প্রতাপাদিত্য।
রামচন্দ্র রায়–
মন্ত্রী।
তিনি রাজপুরী পরিত্যাগ করে গেছেন।
প্রতাপাদিত্য।
(দাঁড়াইয়া উঠিয়া) পরিত্যাগ করে গেছে, প্রহরীরা গেল কোথা?
মন্ত্রী।
বহির্দ্বারের প্রহরীরা পালিয়ে গেছে।
প্রতাপাদিত্য।
(মুষ্টি বদ্ধ করিয়া) পালিয়ে গেছে? পালাবে কোথায়? যেখানে থাকে তাদের খুঁজে আনতে হবে। অন্তঃপুরের প্রহরীদের এখনই ডেকে নিয়ে এস। অন্তঃপুরের পাহারায় কে কে ছিল?
মন্ত্রী।
সীতারাম আর ভাগবত।
প্রতাপাদিত্য।
ভাগবত ছিল? সে তো হুঁশিয়ার। সেও কি উদয়ের সঙ্গে যোগ দিলে?
মন্ত্রী।
সে হাতপা-বাঁধা পড়ে আছে।
প্রতাপাদিত্য।
হাত-পা-বাঁধা আমি বিশ্বাস করি নে। হাত পা ইচ্ছা করে বাঁধিয়েছে। আচ্ছা, সীতারামকে নিয়ে এস। সেই গর্দভের কাছ থেকে কথা বের করা শক্ত হবে না।
মন্ত্রীর প্রস্থান ও সীতারামকে লইয়া পুনঃপ্রবেশ
প্রতাপাদিত্য।
অন্তঃপুরের দ্বার খোলা হল কী করে?
সীতারাম।
(করজোড়ে) দোহাই মহারাজ, আমার কোনো দোষ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
সে-কথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করছে?
সীতারাম।
আজ্ঞা না, মহারাজ। যুবরাজ– যুবরাজ আমাকে বলপূর্বক বেঁধে অন্তঃপুর হতে বেরিয়েছিলেন।
ব্যস্তভাবে বসন্ত রায়ের প্রবেশ
সীতারাম।
যুবরাজকে নিষেধ করলুম তিনি শুনলেন না।
বসন্ত রায়।
হাঁ, হাঁ সীতারাম, কী বললি? অধর্ম করিস নে সীতারাম, উদয়াদিত্যের এতে কোনো দোষ নেই।
সীতারাম।
আজ্ঞা না, যুবরাজের কোনো দোষ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
তবে তোর দোষ!
প্রতাপাদিত্য।
তবে কার দোষ?
প্রতাপাদিত্য।
তাঁর সঙ্গে আর কে ছিল?
প্রতাপাদিত্য।
বউরানী! ওই সেই শ্রীপুরের (বসন্ত রায়ের দিকে চাহিয়া) উদয়াদিত্যের এ অপরাধের মার্জনা নেই।
বসন্ত রায়।
বাবা প্রতাপ, উদয়ের এতে কোনো দোষ নেই।
প্রতাপাদিত্য।
দোষ নেই? তুমি দোষ নেই বলছ বলেই তাকে বিশেষরূপে শাস্তি দেব। তুমি মাঝে পড়ে মীমাংসা করতে এসেছ কেন? শোনো পিতৃব্যঠাকুর! তুমি যদি দ্বিতীয় বার যশোরে এসে উদয়াদিত্যের সঙ্গে দেখা কর তবে তার প্রাণ বাঁচানো দায় হবে।
বসন্ত রায়।
(কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া) ভালো প্রতাপ, আজ সন্ধ্যাবেলায় তবে আমি চললেম।
প্রায়শ্চিত্তঃ তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় অঙ্ক
১
উদয়াদিত্যের ঘরের অলিন্দ
উদয়াদিত্য ও মাধবপুরের একদল প্রজা
উদয়াদিত্য।
ওরে তোরা মরতে এসেছিস এখানে? মহারাজ খবর পেলে রক্ষা রাখবেন না। পালা পালা।
১।
আমাদের মরণ সর্বত্রই। পালাব কোথায়?
২।
তা মরতে যদি হয় তো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে মরব।
উদয়াদিত্য।
তোদের কী চাই বল্ দেখি।
অনেকে।
আমরা তোমাকে চাই।
উদয়াদিত্য।
আমাকে নিয়ে তোদের কোনো লাভ হবে না রে– দুঃখই পাবি।
৩।
আমাদের দুঃখই ভালো কিন্তু তোমাকে আমরা নিয়ে যাব।
৪।
আমাদের মাধবপুরে ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত কাঁদছে সে কি কেবল ভাত না পেয়ে? তা নয়। তুমি চলে এসেছ বলে। তোমাকে আমরা ধরে নিয়ে যাব।
উদয়াদিত্য।
আরে চুপ কর্, চুপ কর্। ও-কথা বলিস নে।
৫।
রাজা তোমাকে ছাড়বে নে। আমরা তোমাকে জোর করে নিয়ে যাব। আমরা রাজাকে মানি নে– আমরা তোমাকে রাজা করব।
প্রতাপাদিত্যের প্রবেশ
প্রতাপাদিত্য।
কাকে মানিস নে রে। তোরা কাকে রাজা করবি?
প্রজাগণ।
মহারাজ, পেন্নাম হই।
১।আমরা তোমার কাছে দরবার করতে এসেছি।
প্রতাপাদিত্য।
কিসের দরবার?
১।
আমরা যুবরাজকে চাই।
প্রতাপাদিত্য।
বলিস কী রে!
সকলে।
হাঁ মহারাজ, আমরা যুবরাজকে মাধবপুরে নিয়ে যাব।
প্রতাপাদিত্য।
আর ফাঁকি দিবি? খাজনা দেবার নামটি করবি নে।
সকলে।
অন্ন বিনে মরছি যে।
প্রতাপাদিত্য।
মরতে তো সকলকেই হবে। বেটারা রাজার দেনা বাকি রেখে মরবি?
১।
আচ্ছা আমরা না খেয়েই খাজনা দেব, কিন্তু যুবরাজকে আমাদের দাও। মরি তো ওঁরই হাতে মরব।
প্রতাপাদিত্য।
সে বড়ো দেরি নেই। তোদের সর্দার কোথায় রে?
২।
(প্রথমকে দেখাইয়া) এই যে আমাদের গণেশ সর্দার।
প্রতাপাদিত্য।
ও নয়– সেই বৈরাগীটা।
১।
আমাদের ঠাকুর! তিনি তো পূজোয় বসেছেন। এখনই আসছেন। ওই যে এসেছেন।
ধনঞ্জয় বৈরাগীর প্রবেশ
ধনঞ্জয়।
দয়া যখন হয় তখন সাধনা না করেই পাওয়া যায়। ভয় ছিল কাঙালদের দরজা থেকেই ফিরতে হয় বা। প্রভুর কৃপা হল, রাজাকে অমনি দেখতে পেলুম। (উদয়াদিত্যের প্রতি) আর এই আমাদের হৃদয়ের রাজা। ওকে রাজা বলতে যাই বন্ধু বলে ফেলি!
উদয়াদিত্য।
ধনঞ্জয়!
ধনঞ্জয়।
কী রাজা! কী ভাই?
উদয়াদিত্য।
এখানে কেন এলে?
ধনঞ্জয়।
তোমাকে না দেখে থাকতে পারি নে যে।
উদয়াদিত্য।
মহারাজ রাগ করছেন।
ধনঞ্জয়।
রাগই সই। আগুন জ্বলছে তবু পতঙ্গ মরতে যায়।
প্রতাপাদিত্য।
তুমি এই সমস্ত প্রজাদের খেপিয়েছ?
ধনঞ্জয়।
খেপাই বই কি! নিজে খেপি, ওদেরও খেপাই, এই তো আমার কাজ।
গান
আমারে, পাড়ায় পাড়ায় খেপিয়ে বেড়ায়
কোন্ খেপা সে।
ওরে আকাশ জুড়ে মোহন সুরে
কী যে বাজে কোন্ বাতাসে।
ওরে খেপার দল গান ধর্ রে– হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? রাজাকে পেয়েছিস আনন্দ করে নে। রাজা আমাদের মাধবপুরের নৃত্যটা দেখে নিক।
সকলে মিলিয়া নৃত্যগীত
গেল রে গেল বেলা, পাগলের কেমন খেলা–
ডেকে সে আকুল করে দেয় না ধরা।
তারে কানন-গিরি খুঁজে ফিরি,
কেঁদে মরি কোন্ হুতাশে!
(প্রতাপাদিত্যের মুখের দিকে চাহিয়া) আহা, আহা, রাজা আমার, অমন নিষ্ঠুর সেজে এ কী লীলা হচ্ছে। ধরা দেবে না বলে পণ করেছিলে আমরা ধরব বলে কোমর বেঁধে বেরিয়েছি।
প্রতাপাদিত্য।
দেখো বৈরাগী, তুমি অমন পাগলামি করে আমাকে ভোলাতে পারবে না। এখন কাজের কথা হোক। মাধবপুরের প্রায় দু-বছরের খাজনা বাকি– দেবে কি না বলো।
ধনঞ্জয়।
না মহারাজ দেব না।
প্রতাপাদিত্য।
দেবে না! এতবড়ো আস্পর্ধা।
ধনঞ্জয়।
যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।
প্রতাপাদিত্য।
আমার নয়!
ধনঞ্জয়।
আমাদের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়। যিনি আমাদের প্রাণ দিয়েছেন এ অন্ন যে তাঁর, এ আমি তোমাকে দিই কী ব’লে?
প্রতাপাদিত্য।
তুমিই প্রজাদের বারণ করেছ খাজনা দিতে!
ধনঞ্জয়।
হাঁ মহারাজ, আমিই তো বারণ করেছি। ওরা মূর্খ, ওরা তো বোঝে না– পেয়াদার ভয়ে সমস্তই দিয়ে ফেলতে চায়। আমিই বলি, আরে আরে এমন কাজ করতে নেই– প্রাণ দিবি তাঁকে প্রাণ দিয়েছেন যিনি – তোদের রাজাকে প্রাণহত্যার অপরাধী করিস নে।
প্রতাপাদিত্য।
দেখো ধনঞ্জয়, তোমার কপালে দুঃখ আছে।
ধনঞ্জয়।
যে-দুঃখ কপালে ছিল তাকে আমার বুকের উপর বসিয়েছি মহারাজ– সেই দুঃখই তো আমাকে ভুলে থাকতে দেয় না। যেখানে ব্যথা সেইখানেই হাত পড়ে– ব্যথা আমার বেঁচে থাক।
প্রতাপাদিত্য।
দেখো বৈরাগী, তোমার চাল নেই – চুলো নেই, কিন্তু এরা সব গৃহস্থমানুষ, এদের কেন বিপদে ফেলতে চাচ্ছ? (প্রজাদের প্রতি) দেখ্ বেটারা, আমি বলছি তোরা সব মাধবপুরে ফিরে যা। বৈরাগী তুমি এইখানেই রইলে।
প্রজাগণ।
আমাদের প্রাণ থাকতে সে তো হবে না।
ধনঞ্জয়।
কেন হবে না রে। তোদের বুদ্ধি এখনও হল না। রাজা বললে বৈরাগী তুমি রইলে, তোরা বললি না তা হবে না– আর বৈরাগী লক্ষ্মীছাড়াটা কি ভেসে এসেছে? তার থাকা না-থাকা কেবল রাজা আর তোরা ঠিক করে দিবি?
গান
রইল বলে রাখলে কারে
হুকুম তোমার ফলবে কবে?
(তোমার) টানাটানি টিকবে না ভাই,
রবার যেটা সেটাই রবে।
যা খুশি তাই করতে পার–
গায়ের জোরে রাখ মার–
যাঁর গায়ে সব ব্যথা বাজে
তিনি যা সন সেটাই সবে!
অনেক তোমার টাকাকড়ি,
অনেক দড়া অনেক দড়ি,
অনেক অশ্ব অনেক করী
অনেক তোমার আছে ভবে।
ভাবছ হবে তুমিই যা চাও,
জগৎটাকে তুমিই নাচাও,
দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে
হয় না যেটা সেটাও হবে।
মন্ত্রীর প্রবেশ
প্রতাপাদিত্য।
তুমি ঠিক সময়েই এসেছ। এই বৈরাগীকে এইখানেই ধরে রেখে দাও। ওকে মাধবপুরে যেতে দেওয়া হবে না।
মন্ত্রী।
মহারাজ–
প্রতাপাদিত্য।
কী। হুকুমটা তোমার মনের মতো হচ্ছে না বুঝি।
উদয়াদিত্য।
মহারাজ, বৈরাগীঠাকুর সাধুপুরুষ।
প্রজারা।
মহারাজ এ আমাদের সহ্য হবে না। মহারাজ অকল্যাণ হবে।
ধনঞ্জয়।
আমি বলছি তোরা ফিরে যা। হুকুম হয়েছে আমি দু-দিন রাজার কাছে থাকব, বেটাদের সেটা সহ্য হল না।
প্রজারা।
আমরা এই জন্যেই কি দরবার করতে এসেছিলুম? আমরা যুবরাজকেও পাব না, তোমাকেও হারাব?
ধনঞ্জয়।
দেখ্ তোদের কথা শুনলে আমার গা জ্বালা করে। হারাবি কি রে বেটা? আমাকে তোদের গাঁঠে বেঁধে রেখেছিলি? তোদের কাজ হয়ে গেছে এখন পালা সব পালা।
প্রজারা।
মহারাজ, আমরা কি আমাদের যুবরাজকে পাব না?
প্রতাপাদিত্য।
না।
২
অন্তঃপুর
সুরমা ও বিভা
সুরমা।
বিভা, ভাই বিভা, তোর চোখে যদি জল দেখতুম তাহলে আমার মনটা যে খোলসা হত। তোর হয়ে যে আমার কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছা করে ভাই, সব কথাই কি এমনি করে চেপে রাখতে হয়!
বিভা।
কোনো কথাই তো চাপা রইল না বউরানী। ভগবান তো লজ্জা রাখলেন না!
সুরমা।
আমি কেবল এই কথাই ভাবি যে জগতে সব দাহই জুড়িয়ে যায়। আজকের মতো এমন কপাল-পোড়া সকাল তো রোজ আসবে না; সংসার লজ্জা দিতেও যেমন, লজ্জা মিটিয়ে দিতেও তেমনি! সব ভাঙাচোরা জুড়ে আবার দেখতে দেখতে ঠিক হয়ে যায়।
বিভা।
ঠিক নাও যদি হয়ে যায় তাতেই বা কী? যেটা হয় সেটা তো সইতেই হয়।
সুরমা।
শুনেছিস তো বিভা, মাধবপুর থেকে ধনঞ্জয় বৈরাগী এসেছেন। তাঁর তো খুব নাম শুনেছি, বড়ো ইচ্ছা করে তাঁর গান শুনি। গান শুনবি বিভা? ওই দেখ, – কেবল অতটুকু মাথা নাড়লে হবে না। লোক দিয়ে বলে পাঠিয়েছি আজ যেন একবার মন্দিরে গান গাইতে আসেন তা হলে আমরা উপরের ঘর থেকে শুনতে পাব। ও কী, পালাচ্ছিস কোথায়?
বিভা।
দাদা আসছেন।
সুরমা।
তা এলই বা দাদা।
বিভা।
না, আমি যাই বউরানী!
[ উভয়ের প্রস্থান ]
সুরমা।
আজ ওর দাদার কাছেও মুখ দেখাতে পারছে না।
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
সুরমা।
আজ ধনঞ্জয় বৈরাগীকে আমাদের মন্দিরে গান গাবার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি।
উদয়াদিত্য।
সে তো হবে না।
সুরমা।
কেন?
উদয়াদিত্য।
তাঁকে মহারাজ কয়েদ করেছেন।
সুরমা।
কী সর্বনাশ, অমন সাধুকে কয়েদ করেছেন!
উদয়াদিত্য।
ওটা আমার উপর রাগ করে। তিনি জানেন আমি বৈরাগীকে ভক্তি করি– মহারাজের কঠিন আদেশেও আমি তাঁর গায়ে হাত দিই নি– সেই জন্যে আমাকে দেখিয়ে দিলেন রাজকার্য কেমন করে করতে হয়।
সুরমা।
কিন্তু এগুলো যে অমঙ্গলের কথা– শুনলে ভয় হয়। কী করা যাবে।
উদয়াদিত্য।
মন্ত্রী আমার অনুরোধে বৈরাগীকে গারদে না দিয়ে তাঁর বাড়িতে লুকিয়ে রাখতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ধনঞ্জয় কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি বললেন আমি গারদেই যাব সেখানে যত কয়েদি আছে তাদের প্রভুর নামগান শুনিয়ে আসব। তিনি যেখানেই থাকুন তাঁর জন্যে কাউকেই ভাবতে হবে না– তাঁর ভাবনার লোক উপরে আছেন।
সুরমা।
মাধবপুরের প্রজাদের জন্যে আমি সব সিধে সাজিয়ে রেখেছি– কোথায় সব পাঠাব?
উদয়াদিত্য।
গোপনে পাঠাতে হবে। নির্বোধগুলো আমাকে রাজা রাজা করে চেঁচাচ্ছিল, মহারাজ সেটা শুনতে পেয়েছেন– নিশ্চয় তাঁর ভালো লাগে নি। এখন তোমার ঘর থেকে তাদের খাবার পাঠানো হলে মনে কী সন্দেহ করবেন বলা যায় না।
সুরমা।
আচ্ছা সে আমি বিভাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আমি ভাবছি, কাল রাত্রে যারা পাহারায় ছিল সেই সীতারাম-ভাগবতের কী দশা হবে!
উদয়াদিত্য।
মহারাজ ওদের গায়ে হাত দেবেন না– সে ভয় নেই।
সুরমা।
কেন?
উদয়াদিত্য।
মহারাজ কখনো ছোটো শিকারকে বধ করেন না। দেখলে না, রমাই ভাঁড়কে তিনি ছেড়ে দিলেন।
সুরমা।
কিন্তু শাস্তি তো তিনি একজন কাউকে না দিয়ে থাকবেন না।
উদয়াদিত্য।
সে তো আমি আছি।
সুরমা।
ও-কথা ব’লো না।
উদয়াদিত্য।
বলতে বারণ কর তো বলব না। কিন্তু বিপদের জন্যে কি প্রস্তুত হতে হবে না?
সুরমা।
আমি থাকতে তোমার বিপদ ঘটবে কেন? সব বিপদ আমি নেব।
উদয়াদিত্য।
তুমি নেবে? তার চেয়ে বিপদ আমার আর আছে নাকি? যাই হোক সীতারাম-ভাগবতের অন্নবস্ত্রের একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
সুরমা।
তুমি কিন্তু কিছু ক’রো না। তাদের জন্যে যা করবার ভার সে আমি নিয়েছি।
উদয়াদিত্য।
না, না, এতে তুমি হাত দিয়ো না।
সুরমা।
আমি দেবো না তো কে দেবে। ও তো আমার কাজ। আমি সীতারাম-ভাগবতের স্ত্রীদের ডেকে পাঠিয়েছি।
উদয়াদিত্য।
সুরমা, তুমি বড়ো অসাবধান।
সুরমা।
আমার জন্যে তুমি কিছু ভেবো না। আসল ভাবনার কথা কী জান?
উদয়াদিত্য।
কী বলো দেখি?
সুরমা।
ঠাকুরজামাই তাঁর ভাঁড়কে নিয়ে যে কাণ্ডটি করলেন বিভা সেজন্যে লজ্জায় মরে গেছে।
উদয়াদিত্য।
লজ্জার কথা বই কি।
সুরমা।
এতদিন স্বামীর অনাদরে বাপের ‘পরেই তার অভিমান ছিল– আজ যে তার সে অভিমান করবারও মুখ রইল না। বাপের নিষ্ঠুরতার চেয়ে তার স্বামীর এই নীচতা তাকে অনেক বেশি বেজেছে। একে তো ভারি চাপা মেয়ে– তার পরে এই কাণ্ড। আজ থেকে দেখো, ওর স্বামীর কথা আমার কাছেও বলতে পারবে না। স্বামীর গর্ব যে স্ত্রীলোকের ভেঙেছে জীবন তার পক্ষে বোঝা, বিশেষত বিভার মতো মেয়ে।
উদয়াদিত্য।
ভগবান বিভাকে দুঃখ যথেষ্ট দিলেন, তেমনি সহ্য করবার শক্তিও দিয়েছেন।
সুরমা।
সে-শক্তির অভাব নেই– বিভা তোমারই তো বোন বটে!
উদয়াদিত্য।
আমার শক্তি যে তুমি।
সুরমা।
তাই যদি হয় তো সে-ও তোমারই শক্তিতে।
উদয়াদিত্য।
আমার কেবলই ভয় হয় তোমাকে যদি হারাই তাহলে–
সুরমা।
তাহলে তোমার কোনো অনিষ্ট হবে না। দেখো এক দিন ভগবান প্রমাণ করিয়ে দেবেন যে, তোমার মহত্ত্ব একলা তোমাতেই আছে।
উদয়াদিত্য।
আমার সে-প্রমাণে কাজ নেই।
সুরমা।
ভাগবতের স্ত্রী অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।
উদয়াদিত্য।
আচ্ছা চললুম কিন্তু দেখো।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
ভাগবতের স্ত্রীর প্রবেশ
সুরমা।
ভোর-রাত্রে আমি যে টাকা আর কাপড় পাঠিয়েছি তা তোদের হাতে গিয়ে পৌঁছেছে তো?
ভাগবতের স্ত্রী।
পৌঁছেছে মা, কিন্তু তাতে আমাদের কতদিন চলবে? তোমরা আমাদের সর্বনাশ করলে।
সুরমা।
ভয় নেই কামিনী! আমার যতদিন খাওয়াপরা জুটবে তোদেরও জুটবে। আজও কিছু নিয়ে যা। কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ থাকিস নে।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
মহিষী ও বামীর প্রবেশ
মহিষী।
এত বড়ো একটা কাণ্ড হয়ে গেল, আমি জানতেও পারলুম না।
বামী।
মহারানীমা, জেনেই বা লাভ হত কী। তুমি তো ঠেকাতে পারতে না।
মহিষী।
সকালে উঠে আমি ভাবছি হল কী– জামাই বুঝি রাগ করেই গেল। এদিকে যে এমন সর্বনাশের উদ্যোগ হচ্ছিল তা মনে আনতেও পারি নি। তুই সে-রাত্রেই জানতিস আমাকে ভাঁড়িয়েছিলি।
বামী।
জানলে তুমি যে ভয়েই মরে যেতে। তা মা, আর ও-কথায় কাজ নেই– যা হয়ে গেছে সে হয়ে গেছে।
মহিষী।
হয়ে চুকলে তো বাঁচতুম– এখন যে আমার উদয়ের জন্যে ভয় হচ্ছে।
বামী।
ভয় খুব ছিল কিন্তু সে কেটে গেছে।
মহিষী।
কী করে কাটল।
বামী।
মহারাজার রাগ বউরানীর উপর পড়েছে। তিনিও আচ্ছা মেয়ে যা হোক– আমাদের মহারাজের ভয়ে যম কাঁপে কিন্তু ওঁর ভয় ডর নেই। যাতে তাঁরই উপরে সব রাগ পড়ে তিনি ইচ্ছে করেই যেন তার জোগাড় করছেন।
মহিষী।
তার জন্যে তো বেশি জোগাড় করবার দরকার দেখি নে। মহারাজ যে ওকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। এবারে আর তো ঠেকিয়ে রাখতে পারা যাবে না। তা তোকে যা বলেছিলুম সেটা ঠিক আছে তো?
বামী।
সে-সমস্তই তৈরি হয়ে রয়েছে, সেজন্যে ভেবো না।
মহিষী।
আর দেরি করিস নে আজকেরই যাতে–
বামী।
সে আমাকে বলতে হবে না কিন্তু–
মহিষী।
যা হয় হবে– এত ভাবতে পারি নে– ওকে বিদায় করতে পারলেই আপাতত মহারাজের রাগ পড়ে যাবে নইলে উদয়কে বাঁচাতে পারা যাবে না। তুই যা, শীঘ্র কাজ সেরে আয়।
বামী।
আমি সে ঠিক করেই এসেছি– এতক্ষণে হয়তো–
মহিষী।
কি জানি বামী, ভয়ও হয়।
৩
প্রতাপাদিত্যের কক্ষ
মহিষী ও প্রতাপাদিত্য
প্রতাপাদিত্য।
মহিষী।
মহিষী।
কি মহারাজ!
প্রতাপাদিত্য।
এ-সব কাজ কি আমাকে নিজের হাতে করতে হবে!
মহিষী।
কী কাজ।
প্রতাপাদিত্য।
ওই যে আমি তোমাকে বলেছিলুম, শ্রীপুরের মেয়েকে তার পিত্রালয়ে দূর করে দিতে হবে– এ কাজটা কি আমার সৈন্য-সেনাপতি নিয়ে করতে হবে?
মহিষী।
আমি তার জন্যে বন্দোবস্ত করছি।
প্রতাপাদিত্য।
বন্দোবস্ত! এর আবার বন্দোবস্ত কিসের। আমার রাজ্যে ক-জন পালকির বেহারা জুটবে না নাকি?
মহিষী।
সে জন্যে নয় মহারাজ!
প্রতাপাদিত্য।
তবে কী জন্যে?
মহিষী।
দেখো তবে খুলে বলি। ওই বউ আমার উদয়কে যেন জাদু করে রেখেছে সে তো তুমি জান। ওকে যদি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিই তাহলে–
প্রতাপাদিত্য।
এমন জাদু তো ভেঙে দিতে হবে– এবাড়ি থেকে ওই মেয়েটাকে নির্বাসিত করে দিলেই জাদু ভাঙবে।
মহিষী।
মহারাজ, এ-সব কথা তোমরা বুঝবে না– সে আমি ঠিক করেছি।
প্রতাপাদিত্য।
কী ঠিক করেছ জানতে চাই।
মহিষী।
আমি বামীকে দিয়ে মঙ্গলার কাছ থেকে ওষুধ আনিয়েছি।
প্রতাপাদিত্য।
ওষুধ কিসের জন্যে?
মহিষী।
ওকে ওষুধ খাওয়ালেই ওর জাদু কেটে যাবে। মঙ্গলার ওষুধ অব্যর্থ, সকলেই জানে।
প্রতাপাদিত্য।
আমি তোমার ওষুধ-টষুধ বুঝি নে। আমি এক ওষুধ জানি– শেষকালে সেই ওষুধ প্রয়োগ করব। আমি তোমাকে বলে রাখছি, কাল যদি ঐ শ্রীপুরের মেয়ে শ্রীপুরে ফিরে না যায় তাহলে আমি উদয়কে সুদ্ধ নির্বাসনে পাঠাব– এখন যা করতে হয় করো গে।
মহিষী।
আর তো বাঁচি নে! কী যে করব মাথামুণ্ডু ভেবে পাই নে।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
প্রতাপাদিত্য।
সীতারাম-ভাগবতের বেতন বন্ধ হয়েছে সে কি রাজকোষে অর্থ নেই বলে?
উদয়াদিত্য।
না মহারাজ, আমি বলপূর্বক তাদের কর্তব্যে বাধা দিয়েছি, আমাকে তারই দণ্ড দেবার জন্যে।
প্রতাপাদিত্য।
বউমা তাদের গোপনে অর্থসাহায্য করছেন।
উদয়াদিত্য।
আমি তাঁকে সাহায্য করতে বলেছি।
প্রতাপাদিত্য।
আমার ইচ্ছার অপমান করবার জন্যে?
উদয়াদিত্য।
না মহারাজ, যে দণ্ড আমারই প্রাপ্য তা নিজে গ্রহণ করবার জন্যে।
প্রতাপাদিত্য।
আমি আদেশ করছি, ভবিষ্যতে তাদের আর যেন অর্থ সাহায্য না করা হয়।
উদয়াদিত্য।
আমার প্রতি আরও গুরুতর শাস্তির আদেশ হল।
প্রতাপাদিত্য।
আর বউমাকে ব’লো, তিনি আমাকে একেবারেই ভয় করেন না– দীর্ঘকাল তাঁকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলেই এরকম ঘটতে পেরেছে, কিন্তু তিনি জানতে পারবেন স্পর্ধা প্রকাশ করা নিরাপদ নয়। তিনি মনে রাখেন যেন আমার রাজবাড়ি আমার রাজত্বের বাইরে নয়।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
মহিষী ও বামীর প্রবেশ
মহিষী।
ওষুধের কী করলি?
বামী।
সে তো এনেছি– পানের সঙ্গে সেজে দিয়েছি।
মহিষী।
খাঁটি ওষুধ তো?
বামী।
খুব খাঁটি।
মহিষী।
খুব কড়া ওষুধ হওয়া চাই এক দিনেই যাতে কাজ হয়। মহারাজ বলেছেন কালকের মধ্যে যদি সুরমা বিদায় না হয় তাহলে উদয়কে সুদ্ধ নির্বাসনে পাঠাবেন। আমি যে কী কপাল করেছিলুম!
বামী।
কড়া ওষুধ তো বটে। বড়ো ভয় হয় মা, কী হতে কী ঘটে।
মহিষী।
ভয়ভাবনা করবার সময় নেই বামী! একটা কিছু করতেই হবে। মহারাজকে তো জানিস– কেঁদেকেটে মাথা খুঁড়ে তাঁর কথা নড়ানো যায় না। উদয়ের জন্যে আমি দিনরাত্রি ভেবে মরছি। ওই বউটাকে বিদায় করতে পারলে তবু মহারাজের রাগ একটু কম পড়বে। ও যেন ওঁর চক্ষুশূল হয়েছে।
বামী।
তা তো জানি। কিন্তু ওষুধের কথা তো বলা যায় না। দেখো, শেষকালে মা আমি যেন বিপদে না পড়ি। আর আমার বাজুবন্দর কথাটা মনে রেখো।
মহিষী।
সে আমাকে বলতে হবে না। তোকে তো গোটছড়াটা আগাম দিয়েছি।
বামী।
শুধু গোট নয় মা, বাজুবন্দ চাই।
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
মহিষী।
বাবা উদয়, সুরমাকে বাপের বাড়ি পাঠানো যাক!
উদয়াদিত্য।
কেন মা, সুরমা কী অপরাধ করেছে?
মহিষী।
কী জানি বাছা, আমরা মেয়েমানুষ কিছু বুঝি না, বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে মহারাজার রাজকার্যের যে কী সুযোগ হবে, মহারাজই জানেন।
উদয়াদিত্য।
মা, রাজবাড়িতে যদি আমার স্থান হয়ে থাকে তবে সুরমার কি হবে না? কেবল স্থানটুকুমাত্রই তার ছিল, তার বেশি তো আর কিছু সে পায় নি!
মহিষী।
(সরোদনে) কী জানি বাবা, মহারাজ কখন কী যে করেন কিছুই বুঝতে পারি নে। কিন্তু তাও বলি বাছা, আমাদের বউমা বড়ো ভালো মেয়ে নয়। ও রাজবাড়িতে প্রবেশ করে অবধিই এখানে আর শান্তি নেই। হাড় জ্বালাতন হয়ে গেল। তা, ও দিনকতক বাপের বাড়িতেই যাক না কেন, দেখা যাক– কী বল বাছা? ও দিনকতক এখান থেকে গেলেই দেখতে পাবে, বাড়ির শ্রী ফেরে কি না।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
সুরমার প্রবেশ
সুরমা।
কই এখানে তো তিনি নেই।
মহিষী।
পোড়ামুখী, আমার বাছাকে তুই কী করলি? আমার বাছাকে আমায় ফিরিয়ে দে। এসে অবধি তুই তার কী সর্বনাশ না করলি? অবশেষে– সে রাজার ছেলে– তার হাতে বেড়ি না দিয়ে কি তুই ক্ষান্ত হবি নে?
সুরমা।
কোনো ভয় নেই মা। বেড়ি এবার ভাঙল। আমি বুঝতে পারছি আমার বিদায় হবার সময় হয়ে এসেছে– আর বড়ো দেরি নেই। আমি আর দাঁড়াতে পারছি নে। বুকের ভিতর যেন আগুনে জ্বলে যাচ্ছে। তোমার পায়ের ধুলো নিতে এলুম। অপরাধ যা কিছু করেছি মাপ ক’রো। ভগবান করুন যেন আমি গেলেই শান্তি হয়।
[ উভয়ের প্রস্থান ]
মহিষী।
ওষুধ খেয়েছে বুঝি। বিপদ কিছু ঘটবে না তো? যে যা বলুক, বউমা কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ে। ওকে এমন জোর করে বিদায় করলে কি ধর্মে সইবে? বামী, বামী!
বামীর প্রবেশ
বামী।
কী মা।
মহিষী।
ওষুধটা কি বড্ড কড়া হয়েছে?
বামী।
তুমি তো কড়া ওষুধের কথাই বলেছিলে।
মহিষী।
কিন্তু বিপদ ঘটবে না তো?
বামী।
আপদবিপদের কথা বলা যায় কি।
মহিষী।
সত্যি বলছি বামী, আমার মনটা কেমন করছে। ওষুধটা কি খেয়েছে ঠিক জানিস?
বামী।
বেশিক্ষণ নয়– এই খানিকক্ষণ হল খেয়েছে।
মহিষী।
দেখলুম, মুখ একেবারে সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে? কী করলুম কে জানে। হরি রক্ষা করো।
বামী।
তোমরা তো ওকে বিদায় করতেই চেয়েছিলে!
মহিষী।
না না, ছি ছি– অমন কথা বলিস নে। দেখ্ আমি তোকে আমার এই গলার হারগাছাটা দিচ্ছি, তুই শিগগির দৌড়ে গিয়ে মঙ্গলার কাছ থেকে এর উলটো ওষুধ নিয়ে আয় গে। যা বামী, যা! শিগগির যা!
[ উভয়ের প্রস্থান ]
বিভার সরোদনে প্রবেশ
বিভা।
মা মা, কী হল মা?
মহিষী।
কী হয়েছে বিভু।
বিভা।
বউদিদির এমন হল কেন মা। তোমরা তাকে কী করলে মা? কী খাওয়ালে?
মহিষী।
(উচ্চস্বরে) ওরে, বামী, বামী, শিগগির দৌড়ে যা– ওরে ওষুধ নিয়ে আয়।
উদয়াদিত্যের প্রবেশ
মহিষী।
বাবা, উদয়, কী হয়েছে বাপ।
উদয়াদিত্য।
সুরমা বিদায় হয়েছে মা, এবার আমি বিদায় হতে এসেছি– আর এখানে নয়।
মহিষী।
(কপালে করাঘাত করিয়া) কী সর্বনাশ হল রে, কী সর্বনাশ হল।
উদয়াদিত্য।
(প্রণাম করিয়া) চললুম তবে।
মহিষী।
(হাত ধরিয়া) কোথায় যাবি বাপ। আমাকে মেরে ফেলে দিয়ে যা।
বিভা।
(পা জড়াইয়া) কোথায় যাবে দাদা। আমাকে কার হাতে দিয়ে যাবে।
উদয়াদিত্য।
তোকে কার হাতে দিয়ে যাব। আমি হতভাগা ছাড়া তোর কে আছে। ওরে বিভা, তুই-ই আমাকে টেনে রাখলি– নইলে এ পাপ-বাড়িতে আমি আর এক মুহূর্ত থাকতুম না।
বিভা।
বুক ফেটে গেল দাদা, বুক ফেটে গেল।
উদয়াদিত্য।
দুঃখ করিস নে বিভা, যে গেছে সে সুখে গেছে। এবাড়িতে এসে সেই সোনার লক্ষ্মী এই আজ প্রথম আরাম পেল।
৪
১।
(উচ্চস্বরে) আমরা এখানে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকব।
২।
আমরা এখানে না খেয়ে মরব।
প্রহরী।
এরা সব বৈরাগীঠাকুরের চেলা, এদের গায়ে হাত দিতে ভয় করে। কিন্তু যে-রকম গোলমাল লাগিয়েছে, এখনই মহারাজের কানে যাবে– মুশকিলে পড়ব। কী বাবা, তোমরা মিছে চেঁচামেচি করছ কেন বলো তো।
সকলে।
আমরা রাজার কাছে দরবার করব।
প্রহরী।
আমার পরামর্শ শোন্ বাবা– দরবার করতে গিয়ে মরবি। তোরা নেহাত ছোটো বলেই মহারাজ তোদের গায়ে হাত দেন নি– কিন্তু হাঙ্গামা যদি করিস তো একটি প্রাণীও রক্ষা পাবি নে।
১।
আমরা আর তো কিছু চাই নে, যে-গারদে বাবা আছেন আমরাও সেখানে থাকতে চাই।
প্রহরী।
ওরে চাই বললেই হবে এমন দেশ এ নয়।
২।
আচ্ছা আমরা আমাদের যুবরাজকে দেখে যাব।
প্রহরী।
তিনি তোদের ভয়েই লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন।
৩।
তাঁকে না দেখে আমরা যাব না।
সকলে।
(ঊর্ধ্বস্বরে) দোহাই যুবরাজ বাহাদুর।
উদয়াদিত্য।
আমি তোদের হুকুম করছি তোরা দেশে ফিরে যা।
১।
তোমার হুকুম মানব– আমাদের ঠাকুরও হুকুম করেছেন তাঁর হুকুমও মানব– কিন্তু তোমাকে আমরা নিয়ে যাব।
উদয়াদিত্য।
আমায় নিয়ে কী হবে।
১।
তোমাকে আমাদের রাজা করব।
উদয়াদিত্য।
তোদের তো বড়ো আস্পর্ধা! এমন কথা মুখে আনিস! তোদের কি মরবার জায়গা ছিল না।
২।
মরতে হয় মরব, কিন্তু আমাদের আর দুঃখ সহ্য হয় না।
৩।
আমাদের যে বুক কেমন করে ফাটছে তা বিধাতাপুরুষ জানেন।
৪।
রাজা, তোমার দুঃখে আমাদের কলিজা জ্বলে গেল।
৫।
আমাদের মা-লক্ষ্মী কোথায় গেল রাজা?
১।
আমাদের দয়া করেছিল বলেই সে গেল।
২।
এ-রাজ্যে কেউ আমাদের মুখ তুলে চায় নি– সন্তানের সেই অনাদর কেবল আমাদের মার মনে সয় নি।
৩।
দু’বেলা মা আমাদের কত যত্ন করে কত খাবার পাঠিয়েছে। সেই মাকে রাখতে পারলুম না রে।
৪।
কিন্তু রাজা, তুমি মুখ ফিরিয়ে চলেছ কোথায়? তোমাকে ছাড়ছি নে।
৫।
আমরা জোর করে নিয়ে যাব, কেড়ে নিয়ে যাব।
উদয়াদিত্য।
আচ্ছা শোন্ আমি বলি– তোরা যদি দেরি না করে এখনই দেশে চলে যাস তাহলে আমি মহারাজের কাছে নিজে মাধবপুরে যাবার দরবার করব।
১।
সঙ্গে আমাদের ঠাকুরকেও নিয়ে যাবে?
উদয়াদিত্য।
চেষ্টা করব। কিন্তু আর দেরি না– এই মুহূর্তে তোরা এখান থেকে বিদায় হ।
প্রজারা।
আচ্ছা আমরা বিদায় হলুম। জয় হোক। তোমার জয় হোক।
৫
চন্দ্রদীপ। রাজা রামচন্দ্রের কক্ষ
রামচন্দ্র, মন্ত্রী, দেওয়ান, রমাই ও অন্যান্য সভাসদগণ
রামচন্দ্র গদির উপর তাকিয়া হেলান দিয়া গুড়গুড়ি টানিতে টানিতে
সম্মুখস্থ একজন অপরাধীর বিচার করিতেছেন
রামচন্দ্র।
বেটা,তোর এতবড়ো যোগ্যতা!
অপরাধী।
(সরোদনে) দোহাই মহারাজ, আমি এমন কাজ করি নি।
মন্ত্রী।
বেটা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে আর আমাদের মহারাজের তুলনা?
দেওয়ান।
বেটা, জানিস নে, যখন প্রতাপাদিত্যের বাপ প্রথম রাজা হয় তখন তাকে রাজটিকা পরাবার জন্যে সে আমাদের মহারাজার স্বর্গীয় পিতামহের কাছে আবেদন করে। অনেক কাঁদাকাটা করাতে তিনি তাঁর বাঁ-পায়ের কড়ে আঙুল দিয়ে তাকে টিকা পরিয়ে দেন।
রমাই।
বিক্রমাদিত্যের বেটা প্রতাপাদিত্য, ওরা তো দুই পুরুষে রাজা। প্রতাপাদিত্যের পিতামহ ছিল কেঁচো, কেঁচোর পুত্র হল জোঁক, বেটা প্রজার রক্ত খেয়ে খেয়ে বিষম ফুলে উঠল, সেই জোঁকের পুত্র আজ মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে মাথাটা কুলোপানা করে তুলেছে আর চক্র ধরতে শিখেছে। আমরা পুরুষানুক্রমে রাজসভায় ভাঁড়বৃত্তি করে আসছি; আমরা বেদে, আমরা জাতসাপ চিনি নে?
রামচন্দ্র।
আচ্ছা, যা– এ-যাত্রা বেঁচে গেলি, ভবিষ্যতে সাবধান থাকিস।
রমাই।
আপনি তো চলে এলেন, এ দিকে যুবরাজ বাবাজি বিষম গোলে পড়লেন। রাজার অভিপ্রায় ছিল, কন্যাটি বিধবা হলে হাতের লোহা আর বালা দুগাছি বিক্রি করে রাজকোষে কিঞ্চিৎ অর্থাগম হয়। যুবরাজ তাতে ব্যাঘাত করলেন। তা নিয়ে তম্বি কত।
রামচন্দ্র।
(হাসিতে হাসিতে) বটে?
মন্ত্রী।
মহারাজ, শুনতে পাই, প্রতাপাদিত্য আজকাল আপসোসে সারা হচ্ছেন। এখন কী উপায়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন, তাই ভেবে তাঁর আহারনিদ্রা নেই।
রামচন্দ্র।
সত্যি নাকি ? [ হাস্য ও তাম্রকূট সেবন ]
মন্ত্রী।
আমি বললুম, আর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে কাজ নেই। তোমাদের ঘরে মহারাজ বিবাহ করেছেন, এতেই তোমাদের সাত পুরুষ উদ্ধার হয়ে গেছে। তার পরে আবার তোমাদের মেয়েকে ঘরে এনে ঘর নিচু করা, এত পুণ্য এখনও তোমরা কর নি। কেমন হে, ঠাকুর?
রমাই।
তার সন্দেহ আছে। মহারাজ, আপনি যে পাঁকে পা দিয়েছেন, সে তো পাঁকের বাবার ভাগ্যি, কিন্তু তাই বলে ঘরে ঢোকবার সময় পা ধুয়ে আসবেন না তো কী।
রামমোহন।
মহারাজ, আজ্ঞা দিন আমি মাঠাকরুনকে আনতে যাই।
আজ্ঞে হাঁ। অন্তঃপুর অন্ধকার হয়ে আছে, আমি তা দেখতে পারি নে। অন্দরে যাই, মহারাজের ঘরে কাকেও দেখতে পাই নে, আমার যেন প্রাণ কেমন করতে থাকে। আমার মা-লক্ষ্মী ঘরে এসে ঘর আলো করুন দেখে চক্ষু সার্থক করি।
রামচন্দ্র।
রামমোহন, তুমি পাগল হয়েছ? সে-মেয়েকে আমি ঘরে আনি?
রামমোহন।
(নেত্র বিস্ফারিত করিয়া) কেন মহারাজ!
রামচন্দ্র।
বল কী রামমোহন? প্রতাপাদিত্যের মেয়েকে আমি ঘরে আনব?
রামমোহন।
কেন আনবেন না হুজুর? আপনার রানীকে আপনি যদি ঘরে এনে তাঁর সম্মান না রাখেন তাহলে কি আপনার সম্মানই রক্ষা হবে?
রামচন্দ্র।
যদি প্রতাপাদিত্য মেয়েকে না দেয়?
রামমোহন।
(বক্ষ ফুলাইয়া) কী বললে মহারাজ? যদি না দেয়? এতবড়ো সাধ্য কার যে দেবে না? আমার মা জননী, আমাদের ঘরের মা-লক্ষ্মী, কার সাধ্য তাঁকে আমাদের কাছ হতে কেড়ে রাখতে পারে? আমার মাকে আমি আনব, তুমিই বা বারণ করবার কে?
রামচন্দ্র।
(তাড়াতাড়ি) রামমোহন, যেয়ো না, শোনো শোনো। আচ্ছা তুমি আনতে যাচ্ছ যাও– তাতে আপত্তি নেই কিন্তু দেখো, এ-কথা যেন কেউ শুনতে না পায়। রমাই কিংবা মন্ত্রীর কানে একথা যেন কোনোমতে না ওঠে।