বিশ্বনৃত্য কবিতাটি [ bishonitto kobita ] কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের অংশ। এটি ১৮৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার “মানসী-সোনার তরী পর্ব”-এর অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
কাব্যগ্রন্থের নামঃ সোনার তরী
কবিতার নামঃ বিশ্বনৃত্য

বিশ্বনৃত্য কবিতা । bishonitto kobita | সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্বনৃত্য
বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
কে বাজাবে সেই বাজনা!
উঠিবে চিত্ত করিয়া নৃত্য
বিস্মৃত হবে আপনা।
টুটিবে বন্ধ, মহা আনন্দ,
নব সঙ্গীতে নূতন ছন্দ,
হৃদয় সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাবে নবীন বাসনা।
সঘন অশ্রুমগন হাস্য
জাগিবে তাহার বদনে।
প্রভাত-অরুণ-কিরণ-রশ্মি
ফুটিবে তাহার নয়নে।
দক্ষিণ করে ধরিয়া যন্ত্র
ঝনন-রণন স্বর্ণ তন্ত্র,
কাঁপিয়া উঠিবে মোহন মন্ত্র
নির্ম্মল নীল গগনে।
হাহা করি সবে উচ্ছল রবে
চঞ্চল কলকলিয়া,
চৌদিক হতে উন্মাদ স্রোতে
আসিবে তৃর্ণ চলিয়া।
ছুটিবে সঙ্গে মহা তরঙ্গে
ঘিরিয়া তাঁহারে হরষ রঙ্গে
বিঘ্নতরণ চরণ ভঙ্গে
পথকণ্টক দলিয়া।

দ্যুলোক চাহিয়া সে লোকসিন্ধু
বন্ধনপাশ নাশিবে,
অসীম পুলকে বিশ্ব-ভূলোকে
অঙ্কে তুলিয়া হাসিবে।
উর্ম্মি-লীলায় সূর্য্য কিরণ
ঠিকরি উঠিবে হিরণ বরণ,
বিঘ্ন বিপদ দুঃখ মরণ
ফেনের মতন ভাসিবে।ওগো কে বাজায় (বুঝি শুনা যায়!)
মহা রহস্যে রসিয়া
চিরকাল ধরে’ গম্ভীর স্বরে
অম্বরপরে বসিয়া!
গ্রহমণ্ডল হয়েছে পাগল,
ফিরিছে নাচিয়া চিরচঞ্চল,
গগনে গগনে জ্যোতি অঞ্চল,
পড়িছে খসিয়া খসিয়া।
ওগো কে বাজায় (কে শুনিতে পায়!)
না জানি কি মহা রাগিণী।
দুলিয়া ফুলিয়া নাচিছে সিন্ধু
সহস্রশির নাগিনী।
ঘন অরণ্য আনন্দে দুলে,
অনন্ত নভে শত বাহু তুলে,
কি গাহিতে গিয়ে কথা যায় ভুলে’,
মর্ম্মরে দিন যামিনী!
নির্ঝর ঝরে উচ্ছ্বাস ভরে
বন্ধুর শিলা-সরণে।
ছন্দে ছন্দে সুন্দর গতি
পাষাণ হৃদয় হরণে!
কোমল কণ্ঠে কুলু কুলু সুর,
ফুটে অবিরল তরল মধুর,
সদা-শিঞ্জিত মাণিক নূপুর
বাঁধা চঞ্চল চরণে!
নাচে ছয় ঋতু না মানে বিরাম,
বাহুতে বাহুতে ধনিয়া।
শ্যামল, স্বর্ণ, বিবিধ বর্ণ,
নব সব বাস পরিয়া।
চরণ ফেলিতে কত বনফুল
ফুটে ফুটে টুটে হইয়া আকুল,
উঠে ধরণীর হৃদয় বিপুল
হাসি ক্রন্দনে ভরিয়া!
পশু বিহঙ্গ কীট পতঙ্গ
জীবনের ধারা ছুটিছে।
কি মহা খেলায় মরণ-বেলায়
তরঙ্গ তার টুটিছে!
কোনখানে আলো কোনখানে ছায়া,
জেগে জেগে ওঠে নব নব কায়া,
চেতনা পূর্ণ অদ্ভুত মায়া
বুদ্বুদ সম ফুটিছে।

ওই কে বাজায় দিবস নিশায়
বসি অন্তর আসনে
কালের যন্ত্রে বিচিত্র সুর,
কেহ শোনে কেহ না শোনে!
অর্থ কি তার ভাবিয়া না পাই,
কত গুণী জ্ঞানী চিন্তিছে তাই,
মহান্ মানব-মানস সদাই
উঠে পড়ে তারি শাসনে!
শুধু হেথা কেন আনন্দ নাই,
কেন আছে সবে নীরবে?
তারকা না দেখি পশ্চিমাকাশে,
প্রভাত না দেখি পূরবে।
শুধু চারিদিকে প্রাচীন পাষাণ
জগৎ-ব্যাপ্ত সমাধি সমান
গ্রাসিয়া রেখেছে অযুত পরাণ,
রয়েছে অটল গরবে।
সংসার-স্রোত জাহ্নবী সম
বহু দূরে গেছে সরিয়া।
এ শুধু ঊষর বালুকাধূসর
মরুরূপে আছে মরিয়া।
নাহি কোন গতি, নাহি কোন গান,
নাহি কোন কাজ, নাহি কোন প্রাণ,
বসে আছে এক মহা নির্ব্বাণ
আঁধার মুকুট পরিয়া!
হৃদয় আমার ক্রন্দন করে
মানব-হৃদয়ে মিশিতে।
নিখিলের সাথে মহা রাজপথে
চলিতে দিবস নিশীথে।
আজন্মকাল পড়ে আছি মৃত,
জড়তার মাঝে হয়ে পরাজিত,
একটি বিন্দু জীবন অমৃত
কে গো দিবে এই তৃষিতে।

জগৎমাতানো সঙ্গীত তানে
কে দিবে এদের নাচারে!
জগতের প্রাণ করাইয়া পান
কে দিবে এদের বাঁচায়ে!
ছিঁড়িয়া ফেলিবে জাতিজালপাশ,
মুক্ত হৃদয়ে লাগিবে বাতাস,
ঘুচায়ে ফেলিয়া মিথ্যা তরাস
ভাঙ্গিবে জীর্ণ খাঁচা এ!
বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
বাজুক্ বিশ্ব বাজনা!
উঠুক্ চিত্ত করিয়া নৃত্য
বিস্মৃত হয়ে আপনা!
টুটুক্ বন্ধ, মহা আনন্দ!
নব সঙ্গীতে নূতন ছন্দ!
হৃদয় সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাক্ নবীন বাসনা!
- হরিণী কবিতা | horini kobita | বীথিকা কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- সন্ন্যাসী কবিতা | sonyasi kobita | বীথিকা কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- ভীষণ কবিতা | bhishon kobita | বীথিকা কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বনস্পতি কবিতা | bonospoti kobita | বীথিকা কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- অন্তরতম কবিতা | ontorotomo kobita | বীথিকা কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর