সুধিয়া sudhiya [ কবিতা ] -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুধিয়া

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাব্যগ্রন্থ : ছড়ার ছবি [ ১৯৩৭ ]

কবিতার শিরনামঃ সুধিয়া 

সুধিয়া sudhiya [ কবিতা ] -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

সুধিয়া sudhiya [ কবিতা ] -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গয়লা ছিল শিউনন্দন, বিখ্যাত তার নাম,

গোয়ালবাড়ি ছিল যেন একটা গোটা গ্রাম।

গোরু-চরার প্রকাণ্ড খেত, নদীর ওপার চরে,

কলাই শুধু ছিটিয়ে দিত পলি জমির ‘পরে।

জেগে উঠত চারা তারই, গজিয়ে উঠত ঘাস,

ধেনুদলের ভোজ চলত মাসের পরে মাস।

মাঠটা জুড়ে বাঁধা হত বিশ-পঞ্চাশ চালা,

জমত রাখাল ছেলেগুলোর মহোৎসবের পালা।

গোপাষ্টমীর পর্বদিনে প্রচুর হত দান,

গুরুঠাকুর গা ডুবিয়ে দুধে করত স্নান।

তার থেকে সর ক্ষীর নবনী তৈরি হত কত,

প্রসাদ পেত গাঁয়ে গাঁয়ে গয়লা ছিল যত।

বছর তিনেক অনাবৃষ্টি, এল মন্বন্তর;

শ্রাবণ মাসে শোণনদীতে বান এল তারপর।

ঘুলিয়ে ঘুলিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে গর্জি ছুটল ধারা,

ধরণী চায় শূন্য-পানে সীমার চিহ্নহারা।

ভেসে চলল গোরু বাছুর, টান লাগল গাছে;

মানুষে আর সাপে মিলে শাখা আঁকড়ে আছে।

বন্যা যখন নেমে গেল বৃষ্টি গেল থামি,

আকাশজুড়ে দৈত্যে-দেবের ঘুচল সে পাগলামি।

শিউনন্দন দাঁড়ালো তার শূন্য ভিটেয় এসে–

তিনটে শিশুর ঠিকানা নেই, স্ত্রী গেছে তার ভেসে।

চুপ করে সে রইল বসে, বুদ্ধি পায় না খুঁজি;

মনে হল, সব কথা তার হারিয়ে গেল বুঝি।

 

আমি যে আর সইতে পারি নে ami je ar soite pari ne [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

ছেলেটা তার ভীষণ জোয়ান, সামরু বলে তাকে;

  এক-গলা এই জলে-ডোবা সকল পাড়াটাকে

  মথন করে ফিরে ফিরে তিনটে গোরু নিয়ে

  ঘরে এসে দেখলে, দু হাত চোখে ঢাকা দিয়ে

  ইষ্টদেবকে স্মরণ ক’রে নড়ছে বাপের মুখ;

  তাই দেখে ওর একেবারে জ্বলে উঠল বুক–

  বলে উঠল, “দেবতাকে তোর কেন মরিস ডাকি।

  তার দয়াটা বাঁচিয়ে যেটুক আজও রইল বাকি

  ভার নেব তার নিজের ‘পরেই, ঘটুক-নাকো যাই আর,

  এর বাড়া তো সর্বনাশের সম্ভাবনা নাই আর।”

  এই বলে সে বাড়ি ছেড়ে পাঁকের পথে ঘুরে

  চিহ্ন-দেওয়া নিজের গোরু অনেক দূরে দূরে

  গোটা পাঁচেক খোঁজ পেয়ে তার আনলে তাদের কেড়ে,

  মাথা ভাঙবে ভয় দেখাতেই সবাই দিল ছেড়ে।

  ব্যাবসাটা ফের শুরু করল নেহাত গরিব চালে,

  আশা রইল উঠবে জেগে আবার কোনোকালে।

  এদিকেতে প্রকাণ্ড এক দেনার অজগরে

  একে একে গ্রাস করছে যা আছে তার ঘরে।

  একটু যদি এগোয় আবার পিছন দিকে ঠেলে,

  দেনা পাওনা দিনরাত্রি জোয়ার-ভাঁটা খেলে।

  মাল তদন্ত করতে এল দুনিয়াচাঁদ বেনে,

  দশবছরের ছেলেটাকে সঙ্গে করে এনে।

  ছেলেটা ওর জেদ ধরেছে– ঐ সুধিয়া গাই

  পুষবে ঘরে আপন ক’রে ওইটে নেহাত চাই।

সামরু বলে, “তোমার ঘরে কী ধন আছে কত

আমাদের এই সুধিয়াকে কিনে নেবার মতো

ও যে আমার মানিক, আমার সাত রাজার ঐ ধন,

আর যা আমার যায় সবই যাক, দুঃখিত নয় মন।

মৃত্যুপারের থেকে ও যে ফিরেছে মোর কাছে,

এমন বন্ধু তিন ভুবনে আর কি আমার আছে।”

বাপের কানে কী বললে সেই দুনিচাঁদের ছেলে,

জেদ বেড়ে তার গেল বুঝি যেমনি বাধা পেলে।

শেঠজি বলে মাথা নেড়ে, “দুই চারিমাস যেতেই

ঐ সুধিয়ার গতি হবে আমার গোয়ালেতেই।”

 

তোমায় চিনি বলে আমি করেছি গরব tomaay chini bole aami karechhie garab [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

কালোয় সাদায় মিশোল বরন, চিকন নধর দেহ,

সর্ব অঙ্গে ব্যাপ্ত যেন রাশীকৃত স্নেহ।

আকাল এখন, সামরু নিজে দুইবেলা আধ-পেটা;

সুধিয়াকে খাওয়ানো চাই যখনি পায় যেটা।

দিনের কাজের অবসানে গোয়ালঘরে ঢুকে

ব’কে যায় সে গাভীর কানে যা আসে তার মুখে।

কারো ‘পরে রাগ সে জানায়, কখনো সাবধানে

গোপন খবর থাকলে কিছু জানায় কানে কানে।

সুধিয়া সব দাঁড়িয়ে শোনে কানটা খাড়া ক’রে,

বুঝি কেবল ধ্বনির সুখে মন ওঠে তার ভরে।

সামরু যখন ছোটো ছিল পালোয়ানের পেশা

ইচ্ছা করেছিল নিতে, ঐ ছিল তার নেশা।

খবর পেল, নবাববাড়ি কুস্তিগিরের দল

পাল্লা দেবে– সামরু শুনে অসহ্য চঞ্চল।

বাপকে ব’লে গেল ছেলে, “কথা দিচ্ছি শোনো,

এক হপ্তার বেশি দেরি হবে না কখ্‌খোনো।”

ফিরে এসে দেখতে পেলে, সুধিয়া তার গাই

শেঠ নিয়েছে ছলে বলে গোয়ালঘরে নাই।

যেমনি শোনা অমনি ছুটল, ভোজালি তার হাতে,

দুনিচাঁদের গদি যেথায় নাজির মহল্লাতে।

“কী রে সামরু, ব্যাপারটা কী” শেঠজি শুধায় তাকে।

সামরু বলে “ফিরিয়ে নিতে এলুম সুধিয়াকে।”

শেঠ বললে, “পাগল নাকি, ফিরিয়ে দেব তোরে,

পরশু ওকে নিয়ে এলুম ডিক্রিজারি করে।”

“সুধিয়া রে” “সুধিয়া রে” সামরু দিল হাঁক,

পাড়ার আকাশ পেরিয়ে গেল বজ্রমন্দ্র ডাক।

চেনা সুরের হাম্বা ধ্বনি কোথায় জেগে উঠে,

দড়ি ছিঁড়ে সুধিয়া ঐ হঠাৎ এল ছুটে।

 

আলো যে alo je [ কবিতা ] - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]

দু চোখ বেয়ে ঝরছে বারি, অঙ্গটি তার রোগা,

অন্নপানে দেয়নি সে মুখ, অনশনে-ভোগা।

সামরু ধরল জড়িয়ে গলা, বললে, “নাই রে ভয়,

আমি থাকতে দেখব এখন কে তোরে আর লয়।–

তোমার টাকায় দুনিয়া কেনা, শেঠ দুনিচাঁদ, তবু

এই সুধিয়া একলা নিজের, আর কারো নয় কভু।

আপন ইচ্ছামতে যদি তোমার ঘরে থাকে

তবে আমি এই মুহূর্তে রেখে যাব তাকে।”

চোখ পাকিয়ে কয় দুনিচাঁদ, “পশুর আবার ইচ্ছে!

গয়লা তুমি, তোমার কাছে কে উপদেশ নিচ্ছে।

গোল কর তো ডাকব পুলিশ।” সামরু বললে, “ডেকো।

ফাঁসি আমি ভয় করিনে, এইটে মনে রেখো।

দশবছরের জেল খাটব, ফিরব তো তারপর,

সেই কথাটাই ভেবো বসে, আমি চললেম ঘর।”

আরও দেখুনঃ 

Amar Rabindranath Logo

মন্তব্য করুন