বাণীর মুরতি গড়ি (Banir Murati Gori) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষলেখা (১৯৪১) কাব্যগ্রন্থের একটি গম্ভীর ও দার্শনিক কবিতা। এখানে কবি সৃষ্টির প্রক্রিয়া, তার অসম্পূর্ণতা ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থহীন হয়ে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে গভীর চিন্তন প্রকাশ করেছেন। কবিতাটি শিল্পের অপূর্ণতা, ভগ্ন স্বপ্ন এবং ধূলিতে মিশে যাওয়ার চক্রকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ: শেষলেখা
কবিতার নাম: বাণীর মূর্তি গড়ি
প্রকাশকাল: ১৯৪১
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: শিল্প, দার্শনিক ভাবনা, সৃষ্টির অপূর্ণতা, সময়ের ক্ষয়
বাণীর মূর্তি গড়ি – কবিতার পাঠ
বাণীর মুরতি গড়ি
একমনে
নির্জন প্রাঙ্গণে
পিণ্ড পিণ্ড মাটি তার
যায় ছড়াছড়ি,
অসমাপ্ত মূক
শূন্যে চেয়ে থাকে
নিরুৎসুক।
গর্বিত মূর্তির পদানত
মাথা ক’রে থাকে নিচু,
কেন আছে উত্তর না দিতে পারে কিছু।
বহুগুণে শোচনীয় হায় তার চেয়ে
এক কালে যাহা রূপ পেয়ে
কালে কালে অর্থহীনতায়
ক্রমশ মিলায়।
নিমন্ত্রণ ছিল কোথা, শুধাইলে তারে
উত্তর কিছু না দিতে পারে–
কোন্ স্বপ্ন বাঁধিবারে
বহিয়া ধূলির ঋণ
দেখা দিল
মানবের দ্বারে।
বিস্মৃত স্বর্গের কোন্
উর্বশীর ছবি
ধরণীর চিত্তপটে
বাঁধিতে চাহিয়াছিল
কবি,
তোমারে বাহনরূপে
ডেকেছিল,
চিত্রশালে যত্নে রেখেছিল,
কখন সে অন্যমনে গেছে ভুলি–
আদিম আত্মীয় তব ধূলি,
অসীম বৈরাগ্যে তার দিক্বিহীন পথে
তুলি নিল বাণীহীন রথে।
এই ভালো,
বিশ্বব্যাপী ধূসর সম্মানে
আজ পঙ্গু আবর্জনা
নিয়ত গঞ্জনা
কালের চরণক্ষেপে পদে পদে
বাধা দিতে জানে,
পদাঘাতে পদাঘাতে জীর্ণ অপমানে
শান্তি পায় শেষে
আবার ধূলিতে যবে মেশে।
ভাবার্থ
কবিতায় কবি এক সৃষ্টির প্রতীকী চিত্র অঙ্কন করেছেন। মাটির পিণ্ড থেকে গড়া অসমাপ্ত মূর্তির মতো অনেক শিল্প ও সৃজনশীল প্রচেষ্টা পূর্ণতা পায় না অথবা সময়ের সাথে তাদের অর্থ হারিয়ে যায়। কোন এক অদৃশ্য অনুপ্রেরণা বা স্বপ্নের ডাকে সৃষ্টি শুরু হলেও, মানবজীবনের ব্যস্ততা ও বিস্মৃতির কারণে তা থেমে যায়। শেষে সবকিছু ধূলির কাছে ফিরে যায়—যেখান থেকে তার উৎপত্তি। এটি জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব, শিল্পের নশ্বরতা ও সময়ের অবধারিত ক্ষয়ের প্রতীক।
শব্দার্থ
মূর্তি: শিল্পকর্ম, বিশেষ করে ভাস্কর্য।
পদানত: পায়ের নিচে অবনত অবস্থা।
উর্বশী: পুরাণকথিত স্বর্গীয় অপ্সরা।
বাণীহীন রথ: অর্থহীন বা শূন্য শিল্পকর্মের প্রতীক।
ধূসর সম্মান: পুরনো, মলিন গৌরব।