হঠাৎ দেখা কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থে মোট ২১টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত, যা মূলত গদ্যছন্দে রচিত। কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতী রানী মহলানবীশকে উৎসর্গ করেছিলেন। শ্যামলী তাঁর “অন্ত্যপর্ব”-এর অংশ, যেখানে কবির কাব্যভাষা আরও সংযত, গভীর এবং দার্শনিক হয়ে উঠেছে। হঠাৎ দেখা কবিতায় অতীত স্মৃতি, আকস্মিক সাক্ষাৎ এবং অব্যক্ত আবেগের এক মনোমুগ্ধকর মেলবন্ধন ঘটেছে।
Table of Contents
কবিতার মৌলিক তথ্য
কবি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থ: শ্যামলী
প্রকাশকাল: ১৯৩৬
বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি: রোম্যান্টিক স্মৃতিচারণ, আকস্মিক সাক্ষাৎ, সম্পর্কের অন্তর্গত দূরত্ব
হঠাৎ দেখা – কবিতার পাঠ
রেলগাড়ির কামরায় হ-ঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু —
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় —
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
“কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, “বলব।”
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
“আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।”
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
“রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।”
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, “থাক্, এখন যাও ও দিকে।”
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।
ভাবার্থ
এই কবিতায় কবি এক পুরনো পরিচিতার সাথে রেলগাড়িতে হঠাৎ সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। অতীতের উজ্জ্বল স্মৃতি ও বর্তমানের মধ্যে দূরত্বের আবহ ফুটে উঠেছে কালো পোশাক ও নীরবতার মাধ্যমে। সম্পর্কের মধুর স্মৃতি, অব্যক্ত প্রশ্ন ও অপ্রকাশিত আবেগ—সব মিলিয়ে এক গভীর মানসিক টানাপোড়েন প্রকাশ পেয়েছে। কবিতার শেষাংশে “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”—এই প্রতীকী বাক্য অতীত স্মৃতির চিরন্তনতা ও আড়াল হয়ে থাকা সৌন্দর্যের ইঙ্গিত বহন করে।
শব্দার্থ
নীলাঞ্জন: গাঢ় নীলাভ রঙের প্রান্তর বা বনভূমি।
সর্ষেখেত: সরিষার ক্ষেত।
ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনি: দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতার আবহমণ্ডল তৈরি করা দৃষ্টি।
গাম্ভীর্য: গুরুগম্ভীর ভাব।