ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাব্যগ্রন্থ : ভগ্নহৃদয়

কবিতার শিরোনামঃ ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ

ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কানন

 রাত্রি

অনিল ললিতা। নলিনী ও সখীগণ। বিজয় সুরেশ বিনোদ প্রমোদ অশোক নীরদ

কাননের এক পাশে ললিতার প্রতি অনিলের গান
              বউ! কথা কও!
সারাদিন বনে বনে   ভ্রমিছি আপন মনে,
সন্ধ্যাকালে শ্রান্ত বড়– বউ, কথা কও!
শুন লো, বকুল-ডালে   লুকায়ে পল্লবজালে
পিক-সহ পিকবধূ মুখে মুখ মিলায়ে
দু জনেতে এক প্রাণ   গাহিতেছে এক গান,
রাশি রাশি স্বরসুধা বাতাসেরে বিলায়ে।
সারাদিন তপনের কিরণেতে তাপিয়া
সন্ধ্যাকালে নীড়ে ফিরে আসিয়াছে পাপিয়া।
প্রিয়ারে না দেখি তার   ঢালিতেছে স্বরধার
অধীর বিলাপ তার লতাপাতা-ভিতরে,
গলি সে আকুল ডাকে   বসি অতি দূর-শাখে
প্রাণের বিহগী তার “যাই যাই” উতরে।
অতি উচ্চ শাখে উঠি   দেখ লো কপোত দুটি
মুখে মুখে কানে কানে কত কথা বলিছে,
বুকে বুক মিলাইয়া   চঞ্চুপুট বুলাইয়া,
কপোতী সে কপোতের আদরেতে গলিছে!
এস প্রিয়ে, এস তবে   মধুর– মধুর রবে
জুড়াও শ্রবণ মোর– বউ! কথা কও!
যদি বড় হয় লাজ   আমার বুকের মাঝ
পাখার ভিতরে মুখ লুকাও তোমার!
অতি ধীরে মৃদু-মধু   বুকের কাছেতে, বধূ,
দু-চারিটি কথা শুধু বল একবার!
[কিছুক্ষণ থামিয়া]
তবে কি কবে না কথা, পূরাবে না আশা?
ভাল ভাল, কোয়ো নাকো,   মুখ ফিরাইয়া থাকো,
বুঝিনু আমার পরে নাই ভালবাসা।
ললিতা।
ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
         [স্বগত]   কি কহিব কথা সখা?   কহিতে না জানি!
বুদ্ধি নাই– ক্ষুদ্র নারী– ফুটেনাকো বাণী।
মনে কত ভাব যুঝে,  হৃদয় নিজে না বুঝে,
প্রকাশ করিতে গিয়া কথা না যোগায়।
হৃদয়ে যে ভাব উঠে হৃদয়ে মিলায়।
তবে কি কহিব কথা– ভেবে নাহি পাই–
কথা কহিবার, সখা,  ক্ষমতা যে নাই!
কি এমন কথা কব   ভাল যা লাগিবে তব?
তুমি গো শুনাও মোরে কাহিনী বিরলে,
এক মনে শুনি আমি বসি পদতলে।
মাথার উপর দিয়া তারাগুলি যত
একটি একটি করি হবে অস্তগত।
শ্রান্তি তৃপ্তি নাহি জানি   ও মুখের প্রতি বাণী
তৃষিত শ্রবণে মোর শুনিতে শুনিতে
কখন প্রভাত হ’ল নারিব জানিতে।
অনিল।
           জান ত– জান ত, সখি, মানুষের মন?
যে কথা সে ভালবাসে   শত শতবার তা সে
ঘুরে ফিরে শুনিবারে চায় প্রতিক্ষণ।
জানি ভালবাস তুমি, ললিতা, আমারে–
তবু, সখি, প্রতিক্ষণে   বড় সাধ যায় মনে
বাহিরে সে প্রেমের প্রকাশ দেখিবারে।
দু-দিনে নীরব প্রেম হয় পুরাতন।
বিচিত্রতা নাহি তায়, শ্রান্ত হয় মন।
আদরতরঙ্গ-মালা    নিয়ত যে করে খেলা,
তাইতে দেখায় প্রেমে নিয়ত-নূতন।
নিত্য নব নব উঠি আদরের নাম
নিয়ত নবীন রাখে প্রণয়ের ধাম।
আদর প্রেমের, সখি, বরষার জল–
না পেলে আদর-ধারা    হয় সে যে বলহারা,
ভূমে নুয়াইয়া পড়ে মুমূর্ষু বিকল।
ওকি বালা, কেন হেন কাতর নয়ানে
এক দৃষ্টে চেয়ে আছ ভূমিতল-পানে!
হাসিতে হাসিতে, সখি, দুটা ক্ষুদ্র কথা
কহিনু, তা’তেই মনে পেয়েছে কি ব্যথা?
ললিতা।
         [স্বগত]   একা বসে ভাবিয়াছি কত– কতবার,
কোন গুণ নাই মোর, কি হবে আমার?
হা ললিতা! কি করিস্‌– দেখিস্‌ না চেয়ে?
শুধু দুটা কথা হা– রে–     পারিস্‌ না কহিবারে?
দুটা আদরের কথা– বুদ্ধিহীন মেয়ে!
দেখিস্‌ না– দুটা কথা কহিলি না ব’লে,
আদরের ধন তোর–   প্রাণের সর্ব্বস্ব তোর
হারায়– হারায় বুঝি– যায় বুঝি চলে!
শুধু দুটা কথা তুই কহিলি না ব’লে!
কি কহিবি? হা অবোধ, ভাবনা কি তায়!
মুক্তকণ্ঠে বল্‌ মন যা বলিতে চায়?–
মনের গোপন ধামে    ডাকিস যে শত নামে
সেই নাম মুখ ফুটে ডাক্‌ রে তাহার!
একবার প্রাণ খুলে বল্‌ প্রাণেশ্বরে–
“মোর প্রেম, চিন্তা, আশা সব তোমা-‘পরে;
নির্ব্বোধ নিগুZ ব’লে– নাথ– স্বামী– প্রভু,
অসহায় অবলারে ত্যজিও না কভু!”
দিবস রজনী ভুলি    বুকে তারে রাখ্‌ তুলি,
“ভালবাসি” “ভালবাসি” বল্‌ শতবার,
আলিঙ্গনে বেঁধে বেঁধে হৃদয় তাহার!
কিন্তু লজ্জা?– দূর হ রে– লজ্জা, দূর হ রে–
বিষময় বাহু তোর     বাঁধি বাঁধি শত ডোর
জীর্ণ করিয়াছে মোর মন স্তরে স্তরে!
আর না– আর না লজ্জা– দূর হ এখন!
চূর্ণ চূর্ণ ভেঙ্গে আর ফেলিস না মন!
শিথিল করে দে তোর     শতেক বন্ধন-ডোর,
মুহূর্ত্তের তরে মুখ তুলি একবার–
বন্ধনজর্জর মন শুধু রে মুহূর্ত্ত ক্ষণ
বাহিরে বাতাসে গিয়া বাঁচুক আবার!
অনিল।
    আজি শুভদিনে ওকি অশ্রুবারিপাত?
অশ্রুজলে কাটাবে কি ফুলশয্যা-রাত?
[কাননের অপর পার্শ্বে
অভিমান করিয়া বিজয়ের প্রতি]
ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
নলিনী।
          মিছে বোলোনাকো মোরে   ভালবাস ভালবাস!
নয়নেতে ঝরে বারি   হৃদয়ে হৃদয়ে হাস!
সারহীন– ভাবহীন   দুটা লঘু কথা ব’লে–
হেসে দুটা মিষ্টি হাসি,   দুই ফোঁটা অশ্রু ফেলে,
শূন্য রসিকতা করি   দুই দণ্ড কাল হরি’
সরলহৃদয় চাহ লভিবারে অবহেলে!
অবশেষে আড়ালেতে কহ হাসি হাসি কত
রমণীর ক্ষুদ্র মন লঘু তৃণটির মত!
ভালবাসা খেলা নয়, খেলেনা নহে গো হৃদি,
নারী ব’লে মন তার দলিতে সৃজে নি বিধি!
ভাল যদি বাস, তবে ভালবাস প্রাণপণে–
ক্ষুদ্র মনে ক’রে খেলা করিও না মোর সনে!
হৃদয়ের অশ্রু ফেল দিবানিশি পদতলে,
মিছা হাসিও না হাসি– কথা কহিও না ছলে!
বিজয়।
           কেন বালা, আমি ত লো দিনরাত্রি ভুলে
অশ্রু ঢালিয়াছি তব প্রেমতরুমূলে,
আজিও ত কিছু তার হয় নিকো ফল,
ব্যর্থ হইয়াছে মোর এত অশ্রুজল!
নলিনী।
          ওই যে সুরুচি হোথায় আছে,
যাই একবার তাহার কাছে!
[দূরে গিয়া ফিরিয়া আসিয়া]    দেখি নি এমন জ্বালা!
হাত হতে খসি পড়েছে কোথায়
      বেল ফুলে গাঁথা বালা!
[সহসা উপরে চাহিয়া] ওই দেখ হোথা কামিনী-শাখায়
      ফুটেছে কামিনীগুলি–
পাতাগুলি সাথে দু-চারিটি, সখা,
      দাও-না আমারে তুলি!
বিজয়।
                কি পাইব পুরস্কার?
নলিনী।
                পুরস্কার?– মরি লাজে!
একটি কুসুম যদি ঠাঁই পায়
      আমার অলকমাঝে–
একটি কুসুম নুয়ে পড়ে যদি
      এ মোর কপোল-‘পরে,
একটি পাপড়ি ছিঁড়ে পড়ে পায়ে
      শুধু মুহূর্ত্তের তরে,
ভুলে যদি রাখি একটি কুসুম
      রচিতে এ কণ্ঠহার–
তার চেয়ে বল আছে ভাগ্যে তব
      আর কিবা পুরস্কার!
[বিজয়ের ফুল তুলিয়া দেওন ও তাহা চরণে দলিয়া ]
নলিনী।
                 এই তব পুরস্কার!
অনুগ্রহ করি এ চরণ দিয়া
ফুলগুলি তব দিলাম দলিয়া,
      এই তব পুরস্কার!
বিজয়।
            আহা! আমি যদি হতেম, সজনি,
      একটি কুসুম ওর–
ওই পদতলে দলিত হইয়া
      ত্যজিতাম দেহ মোর!
[গাছের দিকে চাহিয়া নলিনীর মৃদুস্বরে গান]
ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      খেলা কর্‌– খেলা কর্‌–
তোরা        কামিনী-কুসুমগুলি!
দেখ্‌, সমীরণ লতাকুঞ্জে গিয়া
কুসুমগুলির চিবুক ধরিয়া
ফিরায়ে এ ধার– ফিরায়ে ও ধার
দুইটি কপোল চুমে বার বার
      মুখানি উঠায়ে তুলি!
তোরা খেলা কর্‌– তোরা খেলা কর্‌
      কামিনী-কুসুমগুলি!
কভু পাতা-মাঝে লুকা রে মুখ,
কভু বায়ু-কাছে খুলে দে বুক–
মাথা নাড়ি নাড়ি নাচ্‌ কভু নাচ্‌
      বায়ু-কোলে দুলি দুলি!
দু-দণ্ড বাঁচিবে– খেলা’ তবে খেলা’,
প্রতি নিমেষেই ফুরাইছে বেলা,
বসন্তের কোলে খেলা-শ্রান্ত প্রাণ
      ত্যেজিবি ভাবনা ভুলি!
অশোক।
              [দূর হইতে দেখিয়া]
ওই যে হোথায় নলিনী রয়েছে
      বসি বিজয়ের সাথে!
কত কাছাকাছি!– কত পাশাপাশি!
      হাত রাখি তার হাতে!
অসার হৃদয়, লঘু, হীন মন
      কোন গুণ নাই যার–
শুধু ধন দেখে বিকাবি, নলিনী,
      তারে দেহ আপনার?
কতবার, প্রেম,   যাস্‌ পলাইয়া
      ভয়ে ফুলডোর দেখি–
ধনের সোনার শিকল হেরিয়া
      আজ ধরা দিলি একি?
সুরেশ।
           খুঁজিয়া খুঁজিয়া পাই না দেখিতে
      নলিনী কোথায় আছে।
ওই যে হোথায় লতাকুঞ্জতলে
      বসিয়া বিজয়-কাছে!
কি ভয় হৃদয়!   জানি গো নিশ্চয়
      সে আমারে ভালবাসে,
মন তার আছে আমারি কাছেতে
      থাকুক সে যার পাশে!
বিনোদ।
          কথা শুনে তার– ভাব দেখে তার
      কতবার ভাবি মনে–
নলিনী আমার– আমারেই বুঝি
      ভালবাসে সঙ্গোপনে!
      সত্য হয় যদি আহা!
সে আশ্বাসবাণী, সে হাসি মধুর,
      সত্য যদি হয় তাহা!
নীরদ।
                  কে আমার সংশয় মিটায়!
কে বলি দিবে সে ভাল বাসে কি আমায়?
তার প্রতি দৃষ্টি হাসি   তুলিছে তরঙ্গরাশি
এক মুহূর্ত্তের শান্তি কে দিবে গো হায়!
পারি নে পারি নে আর   বহিতে সংশয়ভার,
চরণে ধরিয়া তার শুধাইব গিয়া,
হৃদয়ের এ সংশয় দিব মিটাইয়া!
কিন্তু এ সংশয়ও ভাল,   পাছে গো সত্যের আলো
ভাঙ্গে এ সাধের স্বপ্ন বড় ভয় গণি–
হানে এ আশার শিরে দারুণ অশনি!
[নলিনীর নিকট হইতে বিজয়ের দূরে গমন, ও নলিনীর  নিকটে গিয়া প্রমোদের গান ]
ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
আঁধার শাখা উজল করি,
হরিত পাতা ঘোমটা পরি
বিজন বনে, মালতীবালা,
      আছিস কেন ফুটিয়া?
শুনাতে তোরে মনের ব্যথা
শুনিতে তোর মনের কথা
পাগল হয়ে মধুপ কভু
      আসে না হেথা ছুটিয়া!
মলয় তম প্রণয়-আশে
ভ্রমে না হেথা আকুল শ্বাসে,
পায় না চাঁদ দেখিতে তোর
      সরমে-মাখা মুখানি!
শিয়রে তোর বসিয়া থাকি
মধুর স্বরে বনের পাখী
লভিয়া তোর সুরভিশ্বাস
      যায় না তোরে বাখানি!
নলিনী।
           [হাসিয়া] শুনিয়া ধীরে মালতীবালা
      কহিল কথা সুরভি-ঢালা,–
“আঁধার বনে আছি গো ভাল,
      অধিক আশা রাখি না!
তোদের চিনি চতুর অলি,
মনো-ভুলানো বচন বলি
ফুলের মন হরিয়া লয়ে
      রাখিয়া যাস যাতনা!
অবলা মোরা কুসুমবালা
সহিব মিছা মনের জ্বালা
চিরটি কাল, তাহার চেয়ে
      রহিব হেথা লুকায়ে!
আঁধার বনে রূপের হাসি
ঢালিব সদা সুরভিরাশি,
আঁধার এই বনের কোলে
      মরিব শেষে শুকায়ে!”
[অশোকের নিকটে গিয়া]
অশোক, হোথায় দূরে কেন তুমি
      দাঁড়াইয়া এক ধার?
কত দিন হ’ল আমার কাছেতে
      আস নি ত একবার!
ভুলেছে যে প্রেম, ভুলেছ যে মোরে,
      তোমার কি দোষ আছে?
এ মুখ আমার এ রূপ আমার
      পুরাতন হইয়াছে?
ভাল, সখা, ভাল, প্রেম না থাকিলে
      আসিতে নাই কি আছে?
যেচে প্রেম কভু পাওয়া নাহি যায়,
      বন্ধুত্বে কি দোষ আছে?
যদি সারাদিন রহিয়া তোমার
      প্রাণের রূপসী-সাথে
কোনো সন্ধ্যাবেলা মুহূর্ত্তের তরে
      অবকাশ পাও হাতে,
আমাদের যেন পড়ে গো স্মরণে–
      এসো একবার তবে!
দু-চারিটা গান গাব সবে মিলি
      দু-চারিটা কথা হবে!
অশোক।
ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
          [স্বগত]   পাষাণে বাঁধিয়া মন মনে করি যতবার
কাছে তার যাবনাকো মুখ দেখিব না আর,
তার মুখ হতে তিল আঁখি ফিরায়েছি যবে–
দূরে যেতে এক পদ শুধু বাড়ায়েছি সবে,
অমনি সে কাছে ঢ’লে   দু একটি কথা ব’লে
পাষাণ প্রতিজ্ঞা মোর ধূলিসাৎ করিয়াছে!
শুধু দুটি কথা ব’লে, একবার এসে কাছে!
জানি না কি শুধু সে গো মন ভোলাবার কথা?
হে হাসি– সে মিষ্টি হাসি– নিদারুণ কপটতা?
জানে জানে সব জানে–   তবু মন নাহি মানে,
প্রতিবার ঘুরে ফিরে তবুও সে যায় তথা।
জেনে শুনে তবু তার ভাল লাগে কপটতা,
সেই মিষ্টি হাসি, সেই মন ভুলাবার কথা!
যবে ভুলাবার তরে    কপট আদর করে,
মোর মুখপানে চেয়ে গাহে প্রণয়ের গীত,
সাধ করে মন যেন হতে চায় প্রতারিত!
হা হৃদয়! লঘু, নীচ, হীন– হীন অতি–
খেলেনার ‘পরে তোর এতই আরতি?
কখনো না– কখনো না– হোক যা হবার,
এই যে ফিরানু মুখ ফিরিব না আর!
ধিক্‌– ধিক্‌– শিশু-হৃদি!   ধিক্‌ ধিক্‌ তোরে–
লজ্জার পাথারে আর ডুবাস্‌ নে মোরে!
কপট রমণী এক, অধম, চপল,
নির্দ্দয়, হৃদয়হীন, অসার দুর্ব্বল–
দুর্ব্বল হাতে সে তার    যেথা ইচ্ছা সেই ধার
টলাইয়ে নুয়াইবে এ মোর হৃদয়?
তৃণ– শুষ্ক পত্র এক– দুর্ব্বলতা-ময়?
কাঁদাইবে, হাসাইবে–   দূরে যেতে নাহি দিবে–
নিশ্বাসে উড়ায়ে দেবে প্রতিজ্ঞা আমার!
ইচ্ছা, সাধ, চিন্তা, আশা–   দুঃখ, সুখ, ভালবাসা
সমস্ত রাখিবে চাপি পদতলে তার!
শিকলি– পশুর সম–   বাঁধিবে গলায় মম,
মুহূর্ত্ত নাহিবে শক্তি মাথা তুলিবার–
ধূলিতে পড়িবে লুটি এ মাথা আমার!
হা হৃদয়, কি করিলি?   তুই কি উন্মাদ হলি?
সমস্ত সংসার তুই দিলি বিসর্জ্জন!
ধন, মান, যশ, আশা–   সখাদের ভালবাসা,
লুটিতে শুধু কি এক নারীর চরণ?
নিশ্বাসে প্রশ্বাসে তার উঠিতে পড়িতে?
কাঁদিতে হাসিতে তার কটাক্ষে ইঙ্গিতে?
খেলেনা হইতে তার ভ্রূকুটি-হাসির?
কেন এত গেলি গ’লে!   শুধু রূপ আছে ব’লে?
ক্ষণস্থায়ী জড়রূপ গঠিত মাটির!
কুঞ্চিত-কুন্তল তার, আরক্ত কপোল,
সুদীর্ঘ নয়ন তার কটাক্ষ বিলোল,
তাই কি ত্যজিলি তুই সমস্ত সংসার?
জীবনের উদ্দেশ্য করিলি ছারখার?
সমস্ত জগৎ হাসে ধিক্‌ ধিক্‌ বলি–
প্রতিক্ষণে আত্মগ্লানি উঠে জ্বলি জ্বলি–
তবু তার পদতলে লুটাইবে গিয়া
শুধু তার আঁখি দুটি সুদীর্ঘ বলিয়া?
কি মদিরা আছে, বালা, নয়নে তোমার!
ফেলেছ বিহ্বল করি হৃদয় আমার!
ফিরাও ফিরাও আঁখি–   পাতা দিয়া ফেল ঢাকি–
হৃদয়েরে দূরে যেতে দাও একবার!
করেছি দারুণ পণ    করিবারে পলায়ন,
নিষ্ঠুর মধুর বাক্যে ফিরায়ো না আর!
ভগ্নহৃদয় পঞ্চম সর্গ [ কবিতা ]- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore ]
ও অনল হতে সাধ দূরে থাকিবার–
ফিরায়ো না মোরে, সখি, ফিরায়ো না আর!

আরও পড়ুনঃ

শ্রান্তি shranti [ কবিতা ] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মন্তব্য করুন